২০২১-এর ২৩ জুলাই। দীর্ঘ এক বছর স্থগিত থাকার পর নতুন উদ্যমে পুরনো ঐতিহ্য বহন করে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমস শুরু হয়ে গিয়েছে জাপানের টোকিও শহরে। খেলোয়াড়দের উল্লাস-হাসি-কান্না-ঘামে ভিজে উঠছে স্টেডিয়ামের বাতাস। করোনাকালীন সতর্কতা বজায় রাখতে দর্শকদের উপস্থিতি খুব কম, নেই জনকল্লোল, উচ্ছ্বাস প্রদর্শনের ঘনঘটা। কিন্তু তা বলে কী কমে যাবে উৎসাহ? একদমই নয়। নিজের দেশের জন্য জান-প্রাণ এক করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সকল প্রতিযোগীরা আর এই সবের মাঝেই অলিম্পিক সাক্ষী হয়ে থাকছে অনবদ্য সব মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের কিছু স্মরণীয় ঘটনা(memorable events of Tokyo Olympic 2020) এখানে তুলে ধরা হল।
একটা বেশ মজার ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। অলিম্পিকের মঞ্চে পা রেখে দুজন মার্কিন অ্যাথলিট সামাজিক মাধ্যমে বেশ মজা করে অলিম্পিক ভিলেজে তাদের থাকার জন্য বরাদ্দ কার্ডবোর্ড খাটের ছবি প্রকাশ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক স্কেট-বোর্ডার নিজাহ্ হাস্টন এবং ট্র্যাক অ্যাণ্ড ফিল্ড দৌড়বিদ পল শেলিমোর কথা বলছি। প্রথম শুনে অনেকেই আশ্চর্য হবেন যে শেষে এত বড় সম্মানের জায়গায় কিনা শুতে হবে কার্ডবোর্ডের বিছানায়? যদি ভেঙে যায়? নাহ ভয় পাওয়ারও কারণ নেই, হাসারও কারণ নেই এতে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির নির্দেশে বিশেষ পদ্ধতিতে এমনভাবে সেই কার্ডবোর্ড বেডগুলি তৈরি করা হয়েছে যাতে সেগুলি ব্যবহারের পরে পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাগজে পরিণত করে ফেলা যায়। কার্ডবোর্ড বেড থেকে তৈরি হয়ে যেতে পারে কাগজ। সারা বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতার যুগে জাপান সরকার এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির এই সিদ্ধান্ত সত্যই অনুপ্রাণিত করে আমাদের।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
টোকিও অলিম্পিক সাক্ষী থাকলো এক অতুলনীয় বন্ধুত্বের নিদর্শনের। ইতালির জিয়ান্মার্কো তাম্বেরি আর কাতারের মুতাজ্ বারশিম্। উভয়েই মেন্স হাই জাম্পের ফাইনালে ২.৩৭ মিটারের উচ্চতার রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক পায়। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় তাদের উভয়ের সিদ্ধান্তে। স্বর্ণপদকটি তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে বলে জানায়। সৌভ্রাতৃত্ববোধের এক চরম নিদর্শনের সাক্ষী থাকলো টোকিও অলিম্পিক। শুধুই জিতে যাওয়াটা বড়ো কথা নয়, তাম্বেরি আর বারশিম্ বুঝিয়ে দিল খেলার যে ‘স্পোর্টিং স্পিরিট’ সেটাই আসল। মনে পড়ে যায় এখানেই ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে জাপানি পোল ভল্টার সুহেই নিশিদা আর সুয়েদ ও তিয়েদ নামের সেই অভিন্নহৃদয় বন্ধুর কথা যারা উভয়ে রৌপ্য পদক আর ব্রোঞ্জের পদক পাওয়ার পর দুটোকে মিশিয়েই নিজেদের কাছে রেখেছিল। জয়ের উল্লাস আর পরাজয়ের কান্নার পাশে এইসব টুকরো মুহূর্তগুলি টোকিও অলিম্পিককে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
তবে কাহিনী এখানেই থেমে থাকেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার সাঁতারু তাৎজানা স্কুয়েনমেকার যখন ২০০ মিটার ব্রেস্ট-স্ট্রোকে এবারের সেরা রেকর্ডটি গড়েন, এক ঐতিহাসিক জয়ের আনন্দে চিৎকার করে ওঠেন তাৎজানা। আর তার এই আনন্দে সামিল হয় কারা? ঐ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানে লেজর, আমেরিকান লিলি কিং আর দক্ষিণ আফ্রিকার কেলেন করবেট প্রতিযোগিতার শেষে সাঁতরে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানান। এমন ঘটনা খুব কমই দেখেছে অলিম্পিকের মঞ্চ, অলিম্পিকের দর্শক এমনকি প্রতিযোগীরাও এই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছেন খুব কম। অবাক হচ্ছেন? আজ যখন সামান্য কিছু মনোমালিন্যেই ভেঙে যায় আমাদের সম্পর্ক, ভেঙে যায় পরিবার, তখন এই অলিম্পিয়ানরা আমাদের শিখিয়ে দেন ঠিক কাকে বলে ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’।
এবারে আমরা দেখবো ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের সহস্র আলোর ঝলকানির মাঝে একটি নিবিড়-নির্জন শান্তির ছবি। অনেকেই দেখে থাকবেন সামাজিক মাধ্যমে বহুল প্রচারিত সেই ছবি – অ্যাথলিট টম ড্যালে খেলার বিরতিতে গ্যালারিতে বসে কাঁটায় বুনছেন উলের বটুয়া, স্বর্ণপদকটি রাখার জন্য। জানা গেছে তিনি নাকি তাঁর স্বামীর জন্যেও সময় পেলেই উলের পোশাক, রুমাল ইত্যাদি বানিয়ে দেন। চমকে গেলেন? টম ড্যালে পুরুষ প্রতিযোগী তার স্বামী মানে? বিশ্বে সমকামিতা নিয়ে এত ছি-ছি রব, এত নিষিদ্ধ আড়াল, এত গোপনীয়তাকে পিছনে ফেলে সমস্ত এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের হয়ে অলিম্পিকে যোগ দিয়েছেন যেন টম ড্যালে। হ্যাঁ তিনি সমকামী, তাঁর স্বামীও একজন পুরুষ। কিন্তু সেই পরিচয়ের থেকেও বড়ো হয়ে উঠেছে তাঁর এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার ছবিটি। ক্রীড়াবিদের যেমন কোনো লিঙ্গ বিভাজন হয় না, জাত হয় না, ধর্ম হয় না, তেমনই ভালোবাসারও কোনো বিভেদরেখা হয় না। তাঁর স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় উল বুলতে দেখা যায় টম ড্যালেকে। হয়তো আজকের অলিম্পিকে ডাইভিং-এ স্বর্ণপদক পেয়ে নিভৃতে বসে উলকাঁটায় প্রতীকীভাবে তিনি একসূত্রে গাঁথতে চাইছিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের রূপান্তরকামী-সমকামী মানুষদের, মনে মনেই যেন বলছিলেন ‘জোট বাঁধো, তৈরি হও’। অলিম্পিকে টম ড্যালের জয় যেন সমস্ত এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের জয়। বিজয়বার্তা ঘোষণার সময় টম সকল রূপান্তরকামী-সমকামীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে তারা কখনোই যেন নিজেদের একা না মনে করে এবং তারা যা চায় সেটাই তারা করে দেখাতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের মুকুটে টম ড্যালের অলিম্পিক-জয় একটা নতুন পালক যোগ করলো যেন।
বয়স তো সামান্য একটা সংখ্যা মাত্র – এই কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ইকুয়েস্ট্রিয়ান প্রতিযোগী অ্যাণ্ড্রু হয়। ৬২ বছর বয়সে টোকিও অলিম্পিকে একটি রৌপ্য পদক এবং একটি ব্রোঞ্জ পদক জিতে তিনি অস্ট্রেলিয়ার জ্যেষ্ঠতম অ্যাথলিটের সম্মান পেয়েছেন। এই নিয়ে আটবার তিনি অলিম্পিকে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু এখানেই থামতে চান না তিনি। চিরতারুণ্যে ভরপুর এই মানুষটি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি এই অলিম্পিকের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। বয়স বাড়লেই সব আশা শেষ হয় না, প্রবল ইচ্ছা আর নিষ্ঠা থাকলে বয়স কোনো প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দেয় না। ৬২ বছরের ‘বৃদ্ধ’ অ্যাণ্ড্রু আমাদের যেন এই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন।
তবে তালিকা এখনো শেষ হয়নি। সতেরো বছরের মেয়ে লিডিয়া জ্যাকোবি – টোকিও অলিম্পিকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম আমেরিকান স্বর্ণপদকজয়ী। ওমেন্স ১০০ মিটার ব্রেস্ট-স্ট্রোকে সে যখন জয়লাভ করে, তাঁর শহর পুরো উত্তাল হয়ে ওঠে, আনন্দে ফেটে পড়ে। আলাস্কার সেই শহরের উল্লাসের ভিডিও ছেয়ে গিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে যা চোখ ভরে দেখার মতো। কত কত বছর পরে আলাস্কার কোনো মেয়ে সোনা জিতলো, সেই লিডিয়া যে তাঁদের ঘরেরই মেয়ে।
এভাবেই কখনো জাপানি স্কেটবোর্ডার ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মিসোগু ওকামোতোকে মাটি থেকে তুলে ধরেন তাঁর সহ-প্রতিদ্বন্দ্বীরা। প্রথম না হতে পারলেও ওকামোতোকে তাঁরা কাঁধে তুলে নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। বন্ধুতা কি আশ্চর্য রকমের! কখনো আবার ৮০০ মিটার দৌড়ের সেমি-ফাইনালে পড়ে গেলে একে অপরকে উঠতে সাহায্য করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসিয়াশ জুয়েট আর বোস্টওয়ানার নিজেল অ্যামোস। এমনই আশ্চর্য সব স্মরণীয় মুহূর্তে ভরা এবারের ২০২০ টোকিও অলিম্পিক যা আমাদের শেখায় সেই ছোটবেলার রচনার মতো খেলাধূলার আসল উদ্দেশ্যই চরিত্রগঠন – আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠা।
তথ্যসূত্র
