ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়া নক্ষত্র হলেন ধ্যান চাঁদ (Dhyan Chand)। বলের উপর অকল্পনীয় দখল এবং সাথে ড্রিবলিংয়ের দক্ষতা তাঁকে পরিনত করেছিল ‘ হকির জাদুকর ‘-এ। ধ্যান চাঁদকে হকি খেলার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। ১৯২৮,১৯৩২,১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে ভারতের স্বর্নপদক জয়ের অন্যতম প্রধান কান্ডারী ছিলেন ধ্যান চাঁদ । সারা জীবনে ১৮৫ ম্যাচে ৫৭০ গোল করেছেন যে রেকর্ড এখনও পর্যন্ত অটুট। তাঁর জন্মদিন ২৯ আগস্ট ভারতে জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ধ্যান চাঁদের জন্ম ১৯০৫ সালের ২৯ আগস্ট এলাহাবাদ ( বর্তমানে প্রয়াগরাজ ) -এ এক রাজপুত পরিবারে। সামেশ্বর সিং এবং সারধা সিং এর প্রথম সন্তান ধ্যান চাঁদ। সামেশ্বর সিং ছিলেন ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সিপাহি। ক্রমাগত বদলির চাকরি হওয়ার ফলে ধ্যান চাঁদের জীবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বারবার বদলেছে। মাত্র ছ’বছর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর তাঁর পড়াশোনা স্থগিত হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিবার ঝাঁসি লতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করার পর, তাঁর পড়াশোনা পুনরায় শুরু হয়। ১৯৩২ সালে গোয়ালিয়র -এর ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে স্নাতক হন ধ্যান চাঁদ।
১৯২২ সালে ১৭ বছর বয়সে ধ্যান চাঁদ ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন সিপাহি হিসাবে যোগদান করেন। এখানেই তাঁর হকি খেলার সূত্রপাত। এর আগে পর্যন্ত তাঁর পছন্দের খেলা ছিল কুস্তি। ১৯২২ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত সেনাবাহিনীর হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নিয়মিত খেলতে থাকেন ধ্যান চাঁদ। দিনের খেলার সময় না পাওয়ার ফলে তিনি রাতে চাঁদের আলোয় অনুশীলন করতেন। তাই সতীর্থরা ‘চাঁদ’-এর সাথে সাজুয্য রেখে তাঁকে ধ্যান চাঁদ বলতেন।
১৯২৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দল নিউজিল্যান্ডে একটি সিরিজ খেলতে যায়। গোটা সিরিজে ১৮ টি জয়,২টি ড্র এবং একটি মাত্র ম্যাচে পরাজিত হয় এই দল। মাঝমাঠে অনবদ্য খেলার সুবাদে কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি ঘটে ধ্যান চাঁদের। ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতীয় দল প্রথম অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে। ১৯২৮, ১৯৩২, ১৯৩৬ পর পর তিনবার অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক পায় এই দল। ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে ধ্যান চাঁদ সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। মাত্র ৫ ম্যাচে ১৪ টি গোল করেন তিনি। এই সময় তাঁর ভাই রূপ সিংও ভারতীয় দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন।
১৯৩২ সালে আমেরিকার লস এঞ্জেলস -এ অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে বিজয়ী হয় ভারতীয় দল। সমগ্র টুর্নামেন্টে ভারতীয় দল মোট ৩৫টি গোল করে যার মধ্যে ‘হকি যমজ’ অর্থাৎ রূপ সিং এবং ধ্যান চাঁদের করা গোলের সংখ্যা ২৫। ধ্যান চাঁদের ব্যক্তিগত গোল সংখ্যা ছিল ৮। ১৯৩৬ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক থেকেই জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন ধ্যান চাঁদ। জার্মানি কে ৮-১ গোলে হারিয়ে তৃতীয় বারের জন্য সোনা জেতে ভারতীয় দল। ফাইনালে হ্যাট্রিক করেন তিনি। কোন কোন সংবাদমাধ্যম জার্মানির বিরুদ্ধে ভারতের করা ৮টি গোলের মধ্যে ধ্যান চাঁদের করা গোলের সংখ্যা ৬টি বলে দাবি করলেও, ধ্যাঁন চাঁদ তাঁর আত্মজীবনী ‘গোল’-এ লিখেছেন, তিনি তিনটি গোল সেই ম্যাচে করেছিলেন। ৩ টি অলিম্পিকে ১২টি ম্যাচ খেলে সর্বমোট ৩৩টি গোল করেন জাদুকর ধ্যান চাঁদ।
বার্লিন অলিম্পিকে ধ্যান চাঁদের খেলা দেখে তৎকালীন জার্মান প্রধান হিটলার অভিভূত হয়ে যান। তিনি ধ্যান চাঁদকে জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেন এমনকি জার্মান সেনাবাহিনীর কর্নেল হিসেবে যোগদান করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। ধ্যান চাঁদ তা প্রত্যাখ্যান করেন। বার্লিন থেকে ফিরে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে মনিপুর,বার্মা প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৪৮ সালে ‘ইস্ট আফ্রিকান’ সিরিজে তিনি ভারতীয় দলের অধিনায়ক ও সক্রিয় সদস্য হিসাবে শেষবার অংশ নেন। তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর। সেই সিরিজে তিনি ২২ ম্যাচে ৬১টি গোল করেন। তবে পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন তিনি বিভিন্ন প্রদর্শনী ম্যাচ, রেস্ট অফ ইন্ডিয়ার হয়ে ম্যাচ খেলতে থাকেন।
তাঁর ক্রীড়া জীবনের শেষ ম্যাচ খেলেন বাংলার বিরুদ্ধে। সেই ম্যাচেও তিনি একটি গোল করেন। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে জাতীয় দলের হয়ে করা ধ্যান চাঁদের গোল সংখ্যা ৪০০। হকি ময়দানে একজন মিডফিল্ডার হিসাবে এই পরিসংখ্যান বিস্ময়কর। নেদারল্যান্ডের একজন সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তি সন্দেহবশত ধ্যান চাঁদের হকি স্টিক ভেঙে পরীক্ষা করে দেখার প্রস্তাব রাখেন।
অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যান ১৯৩৫ সালে তাঁর খেলা দেখে মন্তব্য করেন, “ধ্যান চাঁদ ক্রিকেটে রান করার মতো হকিতে গোল করেন”।
ধ্যান চাঁদ তাঁর ৩৪ বছরের কর্মজীবনের শেষে ‘মেজর’ পদমর্যাদায় থাকাকালীন ২৯ আগস্ট ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সেবছরই ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের বহু সম্মান অর্জন করেন।
অবসর গ্রহণের পর প্রথমে কিছুদিন রাজস্থানের মাউন্ট আবু ক্যাম্পে হকি প্রশিক্ষণ দেন তিনি। পরবর্তীকালে পাতিয়ালায় জাতীয় হকি সংস্থার প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বেশ কিছু বছর তিনি এই দায়িত্ব সামলান।
জীবনের শেষ কিছুদিন ধ্যান চাঁদ ঝাঁসিতে তাঁর বাসভবনে কাটান। লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে দিল্লির এইমস হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর আত্মজীবনী ‘গোল’ ১৯৫২ সালে প্রকাশ পায়। ৩ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে, তাঁর মৃত্যুর ঠিক একবছর পর ভারত সরকার ধ্যান চাঁদের সম্মানে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে।