বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু প্রতিভাশালী মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে, যাঁরা এদেশের প্রশাসনিক বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছেন নিজেদের অসাধারণ দক্ষতায়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতির পদে আসীন তিনি। তার আগে মূলত আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন বেশ কিছুদিন এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। মুজিবুর হত্যার পরে কারাবাসও করতে হয়েছিল সাহাবুদ্দিনকে। বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসেও কাজ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) পাবনা জেলার সদর উপজেলার শিবরামপুরের জুবিলি ট্যাঙ্ক এলাকায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন শরিফউদ্দিন আনসারী এবং মায়ের নাম খায়রুন্নেসা। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব রেবেকা সুলতানাকে বিবাহ করেন। তাঁদের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে, যাঁর নাম আরশাদ আদনান।
পাবনা জেলার গান্ধী স্কুলে সাহাবুদ্দিনের প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনার সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী কালে তিনি চলে যান রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই একাডেমি থেকেই বিদ্যায়লয়ের মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন সাহাবুদ্দিন। ১৯৬৬ সালে এখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। স্কুলের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ সমাপ্ত করবার পর উচ্চশিক্ষার তাগিদে সাহাবুদ্দিন প্রবেশ করেছিলেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে। সেখানে ১৯৬৮ সালে প্রথমে এইচএসসি এবং তারপর ১৯৭২ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অবশ্য সাহাবুদ্দিনের পড়াশুনার গতি এখানেই রূদ্ধ হয়ে যায়নি। এরপর তিনি মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৪ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে সফলভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভে সক্ষম হয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন। স্নাতকোত্তরের পরে আইনচর্চার প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয় তাঁর। সেকারণেই শহীদ আমিনউদ্দীন আইন কলেজে প্রবেশ করেন আইনের অধ্যয়নের জন্য এবং ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন সেখান থেকে।
কেবলমাত্র পড়াশোনা করেই সাহাবুদ্দিনের ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়নি। তাছাড়া তাঁর যখন ছাত্রাবস্থা তখন সেই ষাট-সত্তরের দশকে পূর্ব বাংলায় এক রাজনৈতিক অস্থিরতারও সময়। ফলত এই আবহের মধ্যে থেকে, একজন আইনের ছাত্রের পক্ষে রাজনীতির সংস্রবকে এড়িয়ে চলা সম্ভব হয়নি। ষাটের দশকের শেষ এবং সত্তর দশকের শুরুর দিকে সাহাবুদ্দিন ঐতিহাসিক আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব শাখার নেতা হিসেবে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে বাংলাদেশ উত্তাল। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য এই ঐতিহাসিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন সাহাবুদ্দিন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তেমনই ১৯৬৯ সালের যে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে সত্তর সালের যে নির্বাচন সবেতেই সাহাবুদ্দিন উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন। সেখানে ছাত্রনেতা এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়াও পরে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছিলেন সাহাবুদ্দিন।
১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হলে (পড়ুন শেখ মুজিবর হত্যাকান্ড) তার প্রতিবাদ করায় অন্য কয়েকজনের সঙ্গে সাহাবুদ্দিনকেও কারাবাস করতে হয়েছিল। তিনবছর কারাগারে বন্দী থাকতে হয় তাঁকে। এমনকি সেসময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেফাজতে মেজর এএলএম ফজলুর রহমান কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
১৯৮০ সাল থেকে দু’বছর তিনি দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিককতার কাজ করেছিলেন। তারপর ১৯৮২ সালে সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে জুডিশিয়াল ক্যাডারের মুন্সেফ (সহকারী বিচারক) হিসেবে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীকালে আবার ১৯৯৫ এবং ১৯৯৬ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সাহাবুদ্দিনকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল।
সাহাবুদ্দিন সরকারি চাকরি করাকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আইন সম্মেলনে যোগদানের জন্য চীনের বেইজিং-সহ বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমণ করেছিলেন। এছাড়াও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালকের দায়িত্ব যখন তাঁর কাঁধে তখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহকর্মীদের এবং সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার হয় তার তদন্তের জন্য গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন সাহাবুদ্দিন। পরবর্তীকালে সাহাবুদ্দিন যুগ্ম জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
অবসরের পর ২০১১ সালের ১৪ মার্চ থেকে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সময়কালে সাহাবুদ্দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনারের পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত এই পদের দায়িত্ব দক্ষ হাতে সামলেছেন তিনি। এই কমিশনে থাকাকালীন পদ্মাসেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলেছিলেন তিনি। এছাড়াও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাহাবুদ্দিন।
২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৭৪ বছর বয়সী সাবেক বিচারপতি, বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন। হামিদের মেয়াদ ছিল ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হতে হবে ক্ষমতাসীনদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ থেকে ৬০ দিন আগে। সেই হিসেবেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া গেলেও, কেবল সাহাবুদ্দিন ছাড়া বিএনপি-সহ অন্য কোনো বিরোধী দলের প্রার্থী এই শীর্ষ পদের জন্য তাদের মনোনয়ন দাখিল করেনি। বিএনপি-এর এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ হিসেবে সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর রিপোর্টকে সামনে রেখে বলা যায়, তাদের সমস্ত আইনপ্রণেতারা সাধারণ নির্বাচনের আগে তাদের সরকার বিরোধী প্রচারণার অংশ হিসাবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেছিলেন। অবশেষে ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের নাম ঘোষণা করেন। ২৪ এপ্রিল বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের বয়স বর্তমানে ৭৩ বছর।