বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সবথেকে বেশি সম্মানজনক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হল ‘অলিম্পিক গেমস’ (Olympic Games)। প্রত্যেক চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় প্রায় দুশোটিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেক দুই বছর অন্তর শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন এই দুই ভাগে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলির মধ্যে একে অন্যের সাথে সৌভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় এক মহৎ ভূমিকা পালন করে থাকে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রায় তিন হাজার বছর প্রাচীন এই অলিম্পিক গেমসের উৎপত্তির ইতিহাস কিন্তু খুবই ঐতিহ্যবাহী।
অলিম্পিক গেমসের জন্ম হয় প্রাচীন গ্রিসে। গ্রিক দেবতা জিউসের বাসস্থান অলিম্পিয়াতে দেবতার পূজার অঙ্গ হিসেবে অন্যান্য ধর্মীয় আচারের পাশাপাশি প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলি একজোট হয়ে মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, রথ চালনা ইত্যাদি ক্রীড়ায় অংশ নিত আর সেই থেকেই অলিম্পিকের জন্ম। জানা যায় ‘অলিম্পিকের যুদ্ধ বিরতির নীতি’ অনুযায়ী কোনো দেশের মধ্যে আগে থেকে যুদ্ধ চললে তা অলিম্পিক ক্রীড়া চলাকালীন বন্ধ থাকতো। প্রাচীন গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, দেবতা জিউস এবং তাঁর পুত্র হারকিউলিস এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্মদাতা এবং হারকিউলিসই এই বিশেষ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নাম দেন ‘অলিম্পিক’। গ্রিক উপকথায় বলা হয় যে হারকিউলিস বারোটি অভিযান শেষ করে তাঁর পিতা জিউসের সম্মানে একটি স্টেডিয়াম গড়ে তোলেন অলিম্পিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য। সেই স্টেডিয়ামে দুশো পা হেঁটে যে দূরত্ব তিনি অতিক্রম করেছিলেন পরবর্তীকালে ‘স্টেডন’ হিসেবে পরিমাপে ব্যবহৃত হয়।
প্রাচীন নথি অনুযায়ী, প্রথম ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীনকালে চার বছর অন্তর এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো আর এই চার বছরের ব্যবধানকে বলা হতো অলিম্পিয়াড। অলিম্পিকে বিজয়ীদের উদ্দেশ্যে গান-কবিতা লেখা হতো এবং তাঁদের মাথায় পরিয়ে দেওয়া হতো ‘কটিনোস’ নামের অলিভ পাতার মুকুট। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে পশ্চিম পেলোপ্পনিস উপদ্বীপের অলিম্পিয়া শহরে এই অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ৩৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ রোমান সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াসের নির্দেশে অলিম্পিক বন্ধ হয়ে যায় যা পরবর্তী বারোটি শতাব্দী ব্যাপী বন্ধ ছিল। এরপরে ১৬১২ সাল থেকে ১৬৪২ সালের মধ্যে ব্রিটেনে আইনজীবী রবার্ট ডোভার কোটসউল্ড অলিম্পিক গেমসের সূচনা করেন এবং ১৭৯৬ সালে ফ্রান্সে প্রাচীন অলিম্পিকের ঐতিহ্য মেনে ‘এল অলিম্পিয়েড ডি লা রিপাবলিক গেমস’ চালু হয়। সবশেষে ১৮৯৬ সালে ফরাসি শিক্ষক পিয়ের দে কৌবার্তিনের উদ্যোগে গ্রিসের এথেন্সে তেরোটি বিভিন্ন দেশ থেকে মোট দুশো আশি জন প্রতিযোগীকে নিয়ে তেতাল্লিশটি ক্রীড়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমসের জয়যাত্রা সূচিত হয়। এথেন্সের প্যান্থেইনিক স্টেডিয়ামে এই অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছিল। ১৮৯৬ সালের অলিম্পিকেই প্রথম ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার প্রচলন হয়। প্রাচীন গ্রিসের সৈনিক ফেইডিপ্পিডেস ম্যারাথনের যুদ্ধ জয়ের সংবাদ জানাতে ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ দৌড়ে এথেন্স নগরে এসে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই এইদৌড়ের নামকরণ করা হয় ম্যারাথন দৌড় যেখানে প্রতিযোগীকে ছাব্বিশ মাইল তিনশো পঁচাশি গজ দূরত্ব অত্রিক্রম করতে হয়।
অলিম্পিক বর্তমানে প্রায় চারশোটি বিভাগে তিরিশটি শাখায় সর্বমোট পঁয়ত্রিশটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে যদিও ভাগ রয়েছে। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ছাব্বিশটি খেলা থাকে যার মধ্যে দৌড়, সাঁতার, অসিচালনা, জিমন্যাস্টিক্স ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য আর শীতকালীন অলিম্পিকে মোট পনেরোটি খেলা থাকে যার মধ্যে ফিগার স্কেটিং, আইস হকি, স্কি জাম্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে অলিম্পিক বলতে সাধারণত গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককেই বোঝানো হয়ে থাকে, কিন্তু শীতকালীন অলিম্পিকেরও পৃথকভাবে গুরুত্ব রয়েছে। ১৯২৪ সালে ফ্রান্সের চেমনিক্স শহরে ১১ দিন ধরে যে শীতকালীন ক্রীড়া সপ্তাহ পালিত হয়েছিল সেটাই ছিল বিশ্বের প্রথম শীতকালীন অলিম্পিক আর এর পর থেকেই চার বছর অন্তর (গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের দুই বছর পরপর) এই শীতকালীন অলিম্পিক হয়। মূলত বরফ ও তুষারের উপর যে ক্রীড়াগুলি হয়ে থাকে সেগুলিকে প্রাধান্য দিতে আলাদাভাবে এই শীতকালীন অলিম্পিকের সূচনা হয়। এই প্রতিযোগিতায় একক বা দলগতভাবে পদক দেওয়া হয় যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারীকে। প্রথম স্থানাধিকারী অর্থাৎ চ্যাম্পিয়নকে দেওয়া হয় ‘স্বর্ণপদক’। অলিম্পিক কমিটির নিয়ম অনুযায়ী এতে ছয় গ্রাম খাঁটি সোনা থাকতেই হয়। এছাড়া দ্বিতীয় স্থানাধিকারীকে ‘রৌপ্য পদক’ এবং তৃতীয় স্থানাধিকারীকে ‘ব্রোঞ্জের পদক’ দেওয়া হয়। ১৮৯৬ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে মোট ৩১টি অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছে। ২০২১ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজিত হয়েছে জাপানের টোকিও শহরে।
অলিম্পিকের সমগ্র ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (International Olympic Committee, IOC) কর্তৃক । এই কমিটিতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থা, স্বীকৃত কিছু সংবাদমাধ্যম, জনপ্রিয় দক্ষ ক্রীড়াকুশলী, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিবর্গ, আন্তর্জাতিক বিচারকমণ্ডলী এবং যে সব প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক সনদের নিয়মাবলী মেনে চলে তারা উপস্থিত থাকে। আইওসি ঠিক করে কোন কোন খেলা অলিম্পিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে একটি ‘অলিম্পিক ক্রীড়া কমিশন’ গঠিত হয় যেখানে ঠিক হয় সাতটি শর্তের ভিত্তিতে কোনো ক্রীড়াকে অলিম্পিকে স্থান দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট ঐ ক্রীড়ার ইতিহাস, বিশ্বজনীনতা, ভাবমূর্তি, জনপ্রিয়তা, ক্রীড়া আয়োজনের খরচ, সংশ্লিষ্ট নিয়ামক সংস্থার বিকাশ এবং দক্ষ ক্রীড়াবিদ ইত্যাদি শর্তের উপর নির্ভর করে এই কমিশন কোনো ক্রীড়াকে স্বীকৃতি জানায় অলিম্পিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য।
প্রতি চার বছর অন্তর ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়ে থাকে। আগ্রহী দেশের জাতীয় কমিটির কাছে আগ্রহী শহরের নাম জমা পড়ে এবং সেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঠিক হয় কোন বছর কোন দেশের কোন শহরে অলিম্পিক আয়োজিত হবে। আয়োজক দেশকেই সেই বছর অলিম্পিকের খরচ বহন করতে হয়। পরিসংখ্যান অনুসারে, লণ্ডন সবথেকে বেশিবার অলিম্পিক আয়োজনকারী শহর হিসেবে রেকর্ড গড়েছে।
এই গেমসের একটি বিশেষ প্রতীক রয়েছে যার বিশেষ কিছু অর্থ রয়েছে। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রতীকে রয়েছে পাঁচটি বলয় যা আসলে আফ্রিকা, আমেরিকা, এশিয়া, ওশিয়ানিয়া এবং ইউরোপ মহাদেশকে নির্দেশ করে। পাঁচটি বলয়ের পাঁচ রকম রঙ – নীল, হলুদ, কালো, সবুজ ও লাল। ১৯১৪ সালের অলিম্পিকে প্রথম এই পতাকা ও প্রতীকটি গৃহীত হয়। দেখা গেছে প্রতিটি দেশের পতাকায় এই পাঁচটি রঙের মধ্যে অন্তত একটি বা সবকটি রঙই ব্যবহৃত হয়। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নীতিবাক্য হল – সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফোর্টিয়াস অর্থাৎ দ্রুততর, উচ্চতর ও বলবত্তর। প্রাচীন গ্রিক রীতিতে অলিম্পিক শুরুর আগে একটি মশাল দৌড়ের প্রচলন ছিল যা আজও সমানভাবে অব্যাহত আছে। আর রয়েছে অলিম্পিকের ম্যাসকট। অলিম্পিকের আয়োজনকারী দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কোনো পশু বা মানুষের মূর্তি ব্যবহৃত হয় এই ম্যাসকটে। ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিকে প্রথম এই ম্যাসকট প্রচলিত হয়।
সবমিলিয়ে সমস্ত দেশেই এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নিয়ে উন্মাদনা চরমে। দেশের ক্রীড়াকুশলীদের অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের গর্ব বৃদ্ধি করে। একইসঙ্গে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে সৌভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে।
5 comments