মুজাফফর আহমেদ

মুজাফফর আহমেদ

মুজাফফর আহমেদ (Muzaffar Ahmed) ভারতের একজন বিখ্যাত বাঙালী কম্যুনিস্ট যিনি সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন তাঁর ছদ্মনাম ‘দ্বৈপায়ন’ নামে। অনুগামীদের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘কাকাবাবু’। রাজনীতি ছাড়া সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতেও তাঁর দক্ষতা ছিল সুবিদিত। বাংলায় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনিই।

১৮৮৯ সালের ৫আগস্ট অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সন্দ্বীপ উপজেলার মুসাপুর গ্রামে মুজাফফর আহমেদের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম মনসুর আলি ও মায়ের নাম ছিল চুনাবিবি। আহমেদের তিন দাদা ছিলেন, তাঁদের নাম মহব্বত আলী,মকবুলী আহমদ ও খুরশিদ আলম। বাবা ছিলেন স্বল্প আয়ের আইনজীবী বা ‘মোক্তার’। আর্থিক সমস্যার জন্য তিনি চাষবাসও করতেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে আহমেদের বিবাহ হয়। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল হাফেজা খাতুন। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা আফিকা খাতুন, পরে তাঁর বিবাহ হয় কবি আবদুল কাদিরের সঙ্গে।

ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ইচ্ছে ছিল আহমেদের। ১৮৯৭ সালে তিনি ভর্তি হন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানকার পড়া শেষ করে ১৮৯৯ সালে ইংরেজি মাধ্যম হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুল-এ ভর্তি হন, যার বর্তমান নাম সন্দ্বীপ কার্গিল হাইস্কুল। কিন্তু ১৯০৫ সালে তাঁর বাবার আকস্মিক মৃত্যু হওয়ায় তীব্র অর্থকষ্টে পড়ে গোটা পরিবার। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের বেতন মেটাতে না পারায় তাঁর নাম কাটা যায়। অর্থ রোজগারের তাগিদে তখন তিনি বাড়ি-বাড়ি গৃহ-শিক্ষকতা করতেন। তারপর তিনি চলে আসেন গ্রামের অবৈতনিক মাদ্রাসায়। সেখান থেকে ১৯১০ সালে ভর্তি হন নোয়াখালী জেলা স্কুলে। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন আহমেদ। তারপর ভর্তি হন হুগলি কলেজে। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ হয় পড়ায় সেই বছরই চলে যান বঙ্গবাসী কলেজে। এখান থেকেই তিনি আই.এ পরীক্ষায় বসেন। কিন্তু পাশ করতে না পারায় এখানেই তাঁর প্রথাগত শিক্ষার ইতি ঘটে।

কলেজে পড়ার সময় থেকেই সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পথ চলা শুরু হয়। ইসলামধর্মী ‘সাপ্তাহিক সুলতান’ পত্রিকায় তিনি সন্দ্বীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন। এইসময় তিনি বাংলা সরকারের ছাপাখানা বিভাগে চাকরি করতেন। কিছুদিন অনুবাদ বিভাগেও উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদের কাজ করেছিলেন। কলেজে পড়াকালীন খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করেন ও কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেন। কৈশোর থেকেই তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতিতে যোগদান করেন। এই সমিতি থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা’র যুগ্ম সম্পাদক রূপে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এই পত্রিকার সূত্রেই পত্রের মাধ্যমে তাঁর যোগাযোগ হয় কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। করাচির সেনানিবাস থেক্ব কাজী নজরুলের পাঠানো কবিতা ও গল্প এই পত্রিকায় প্রকাশিত হত। সেখান থেকে ফিরে নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সদর দপ্তরে এসে ওঠেন। সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার জন্য আহমেদও থাকতেন ওখানেই। ফলে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব। আমৃত্যু তাঁরা একে অন্যের সুহৃদ ছিলেন। তাঁরা দুজন মিলে পরামর্শ করে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন। অর্থের সমস্যার জন্য এই প্রস্তাব নিয়ে তাঁরা দেখা করেন ‘শের-ই-বঙ্গাল’ ফজলুল হকের সাথে। সমস্ত কথা শোনার পর হকসাহেব অর্থসাহায্য করতে সম্মত হন। ১৯২০ সাল থেকে আহমেদ ও নজরুল যুগ্মভাবে প্রকাশ করতে থাকেন ‘নবযুগ’ নামে একটি পত্রিকা। আহমেদ মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা ত্যাগ করেন ও শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মার্কুইস লেনের একটি বাড়ির ঘরে থাকতে শুরু করেন আহমেদ ও নজরুল। পরে আহমেদ চলে যান তালতলা লেনের একটি বাড়িতে। এখান থেকেই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তার যোগাযোগ সংস্থাপিত হয়। ভারতে কমিউনিস্ট সাহিত্যের প্রকাশ তখন নিষিদ্ধ ছিল। অথচ গোপনে এই সংক্রান্ত পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কমিউনিজমের প্রচার। তাঁর জীবনে তখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দারিদ্র্য। অনাহার ও দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে অবিরত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, সেই সঙ্গে ছিল পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানো। এইসময় সর্বদা তিনি পাশে পেয়েছিলেন একমাত্র কমরেড আবদুল হালিমকে।

এই বছরই ঘটে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ায় জারতন্ত্রের আবাসন ঘটেছিল ও গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ধীরে ধীরে তার আঁচ ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা বিশ্বে। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তারিখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে সর্বপ্রথম ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই দলের নেতা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। এর এক মাসের মধ্যেই বাংলায়ও গঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক দল, এবং তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুজাফফর আহমেদ। তাঁর হাত ধরেই বঙ্গদেশে শুরু হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। ১৯২০ সালে তিনি ‘বঙ্গীয় খেলাফত কমিটি’র সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু তা গ্রহণ করেননি। এই সময় থেকেই আহমেদ রাজনীতিকে পেশা হিসেব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৯২২ সালে কাজী নজরুল আরও একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম ছিল ‘ধূমকেতু’। এই পত্রিকাতেই ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাবলী নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন আহমেদ।

আহমেদ ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২২ সালে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভারত সাম্যতন্ত্র সমিতি’ এবং নিজে এই সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯২৪ সালে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার জন্য এস.এ.ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত ও শওকত উসমানির সঙ্গে আহমেদেরও চার বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য ১৯২৫ সালেই মুক্তি পানীয় আহমেদ। সেই বছরেই নভেম্বর মাসে কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার প্রমুখদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দ্য ইন্ডিয়ান কংগ্রেস’। পার্টির মুখপত্র হিসেব নজরুল ইসলামের পরিচালনায় প্রকাশিত হতে থাকে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা। কানপুর থেকে ফিরে এসে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন আহমেদ। কয়েকমাস পর পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর লাঙ্গল নাম পরিবর্তন করে প্রকাশিত হয় ‘গণবাণী’। গঙ্গাধর বিশ্বাস সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এই পত্রিকার প্রকৃত সম্পাদক ছিলেন আহমেদই। ১৯২০-এর দশকের প্রথম থেকেই আবদুল হালিম ও আবদুর রেজ্জাক খানের সাথে তাঁর নামও অন্যতম প্রধান কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে।

১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৩১ জন শ্রমিক কর্মীকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। এস.এ.ডাঙ্গে, শওকত উসমানি, পি.সি.জোশী প্রমুখের সঙ্গে আহমেদের নামও প্রধান আসামীর তালিকায় ছিল। বিচারে তাঁদের কারাদণ্ড হয়। ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত আহমেদ কারারুদ্ধ ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আহমেদ পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশে) না গিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালের ২৫শে মার্চ ভারত সরকার ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারারুদ্ধ করা হয় আহমেদকে। ১৯৫১ সালে তিনি ছাড়া পান। পুনরায় তাঁকে ১৯৬২ সালে বন্দী করা হয় এবং ১৯৬৫ সালে তিনি মুক্তি পান। ভারতের স্বাধীনতার পর তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বেশ কয়েকবারই আহমেদকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল।

আহমেদ সারা জীবনই রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সাক্ষী থেকেছিলেন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনেরও। এর সম্পর্কে তিনি লিখেছেন এই আন্দোলন আসলে ছিল মূলত বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একধরণের রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্যই বাংলার যুবসমাজ এতে অংশগ্রহণ করেছিল, কিন্তু এর পিছনে ছিল গভীর নৈরাশ্য। যদিও আহমেদ সারা জীবন এই আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধা করতেন।

অন্যদিকে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই ছিল তাঁর কাছে অভিজাত শ্রেণীর মানুষদের স্বার্থরক্ষার জন্য তৈরি দল। কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা থাকলেও এই দল ছিল বর্ণ-হিন্দুদের অধীন। অপরদিকে মুসলিম লিগের কিছু সদস্য ধর্মনিরপেক্ষ হলেও তাঁরা রাজনৈতিক সুবিধার্থে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করতেন। তাঁর মতে, হিন্দু সুবিধাভোগীদের একাধিপত্য রোধ করার কারণেই মুসলিম একাধিপত্যকামীদের দ্বারা এই দলের উৎপত্তি হয়।

মানুষের কল্যাণ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। রাজনীতির ফাঁকে ফাঁকে তিনি লিখতেও ভালোবাসতে। তাঁর রচিত দুটি বইয়ের নাম হল, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ এবং ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’।

১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর চুরাশি বছর বয়সে কলকাতায় মুজাফফর আহমেদ -এর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের ‘ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি’ তাঁদের সদর দপ্তরের নামকরণ করে তাঁর নামে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আহমেদের স্মৃতিতে কলকাতার রিপন স্ট্রিটের নাম বদলে করেন ‘মুজাফফর আহমেদ স্ট্রিট’।

4 comments

  1. প্রথমেই তথ্য সংশোধন করে দেবেন। কমরেড মুজাফফরের জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলায়, যা মূলত একটি দ্বীপ।

    1. আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। শুধু ধরিয়ে নয় তা সংশোধন করে দেওয়ার জন্যও আপনাকে জানাই আমাদের তরফ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা রাখি এভাবেই পরবর্তীকালে আমাদের পাশে থাকবেন।

আপনার মতামত জানান