নলহাটেশ্বরী মন্দির বীরভূমের নলহাটিতে অবস্থিত। এই মন্দির একান্ন সতীপীঠের একটি ,আবার মতান্তরে একে উপপীঠও বলা হয়ে থাকে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর গলার নলি বা কণ্ঠনালী পতিত হয়েছিল। এখানে প্রতিষ্ঠিত দেবীর নাম শেফালিকা ও এখানের ভৈরব হলেন যোগীশ। স্থানীয় বাসিন্দারা মাকে ললাটেশ্বরী বলে সম্বোধন করে থাকে। স্থানীয় অনেকেই জানেন না এটি সতীপীঠের একটি। প্রচারের আলো থেকে নলহাটেশ্বরী মন্দির এখনও অনেক দূরে।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় অনেক হাজার বছর আগে কামদেব প্রথম মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মায়ের আদেশে তিনি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নীচে যেখানে মায়ের কণ্ঠনালী পড়েছিল তার উপরেই দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। বলা হয় এখানে পাথরের টিলাতে সীতার চুল আঁচড়ানোর দাগ আছে ও কড়ি খেলার গর্ত আছে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী রাম এখানে কিছুকাল অস্থায়ী ভাবে বসবাস করেছিলেন।
জনশ্রুতি অনুযায়ী আনুমানিক পাঁচশো বছর আগে পাইক পাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী রামশরণ শর্মাকে মা স্বপ্ন দেন যে মা এখানে খোলা আকাশের নিচে রয়েছে, তাঁকে যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়। মায়ের আদেশে রামশরণ শর্মা এই মন্দির প্রতিষ্টা করেছিলেন। পাহাড়ের মাঝে একটি গাছের নিচে মায়ের প্রস্তরীভূত দেহাংশটি পড়েছিল। সেখানেই মন্দির স্থাপিত হয়।
এই মন্দির থেকে একটু দূরে যকধরী নদী বয়ে চলেছে,যার আসল নাম ব্রাহ্মণী নদী। বহুকাল আগে এই নদী নাকি মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যেত। একসময় এই জায়গা ঘন জঙ্গলে ও জন্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। বলা হয় দিনের বেলাতেও এখানে সূর্যের আলো এসে পৌঁছত না। মায়ের পুজো করতে কেবল কাপালিক ও তন্ত্র সাধকরাই আসতেন এখানে। আর পুজো দিয়ে যেত তখনকার লুঠকারীরা। যারা কোথাও লুঠ করার আগে গোপন রাস্তা দিয়ে এসে মায়ের পুজো দিয়ে যেত। পরবর্তীকালে এর পরিস্থিতি বদলায়। পুরনো মন্দির সংস্কার করা হয়,আশপাশের জঙ্গল সাফ করা হয়। এই মন্দিরের ভৈরব ‘যোগীশ্বর’ মন্দিরের ভিত খোঁড়ার সময় একটি পাথর পাওয়া যায় যেখানে নারায়ণের পদচিহ্ন খোদিত ছিল। এই পাথরটিকে মন্দিরে গাঁথাই করা আছে। এখানে মাটির নীচে কিছু জায়গার কথা বলা হয় যেখানে নাকি বর্গীরা(লুঠকারী) আশ্রয় নিত। এছাড়াও মন্দিরের চারদিকে কতকগুলি গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। বলা হয়ে থাকে যেখানে মানুষ পড়ে গেলে আর তার সন্ধান পাওয়া যায় না। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এই গর্ত বা সুড়ঙ্গগুলো আসলে মন্দিরে যাবার পথ।
মা এখানে ত্রিনয়নী ও তার জিহ্বাটি সোনার। মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবীর দেহাংশ (প্রস্তরীভূত) রক্ষিত আছে। প্রত্যেক দিন দেবীকে স্নান করিয়ে মঙ্গলারতি করার পূর্বে দেবীর প্রস্তরীভূত অঙ্গ ভক্তদের দর্শন করানোর ব্যবস্থা থাকে। এখানে নারায়ণের পদচিহ্ন অঙ্কিত যে শিলাটি মন্দিরে গাঁথা আছে আগে তাকে প্রণাম জানিয়ে তারপর দেবীর পূজা করা হয়ে থাকে। প্রত্যহ দেবীকে অন্নভোগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
এখানে দুর্গাপুজোর সময় মাকে দুর্গারূপে ও কালীপুজোয় মাকে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা থাকে।বিশেষ বিশেষ অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরে হোমযজ্ঞের ব্যাবস্থা থাকে।তবে বিশেষ উৎসবের মধ্যে শিবরাত্রিতে দেবী মন্দির ও ভৈরব শিবের মন্দিরে হলুদ সুতো দিয়ে বেঁধে যোগসূত্র স্থাপন করা হয়।
তথ্যসূত্র
- একান্ন পীঠ, হিমাংশু চট্টোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৯৮, নলহাটির নলাটেশ্বরী
- https://bn.wikipedia.org/wiki/নলহাটেশ্বরী
- https://m.dailyhunt.in/nalahateshbari