ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

সমস্ত নারীদের যুধিষ্ঠিরের অভিশাপ

মহাভারতের শান্তি পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে জগতের সমস্ত নারীদের প্রতি যুধিষ্ঠিরের অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা বর্ণিত আছে। আঠারো দিন ধরে চলার পরে শেষ হল কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধ। কৌরব ও পাণ্ডব—এই দুই পক্ষের আঠারো অক্ষৌহিনী সেনা এই যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করলেন। একশোটি ছেলের মৃত্যুশোকে আকুল হয়ে উঠলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও রানী গান্ধারী। তারপর মৃতদের অন্তিম সৎকারের সময় এলে সঞ্জয় ও বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে বললেন, “মহারাজ! এখন মৃত ব্যক্তিদের পারলৌকিক কাজের সময় এসেছে। আপনি শোকের মোহে নিজের কর্তব্যে অবহেলা করবেন না।”

তখন নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে গান্ধারী ও অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করলেন। এদিকে পাণ্ডবরাও কৃষ্ণ, সাত্যকি, দ্রৌপদীকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রের দিকে আসছিলেন। পথের মধ্যে দুই দলের দেখা হল।পাণ্ডবরা একে একে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে নিজেদের নাম বলে তাঁকে প্রণাম করতে লাগলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র বাকিদের সাথে ভালো করে কথা না বলেই ভীমকে খুঁজতে থাকলে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝে কৃষ্ণ ভীমের একটি লোহার মূর্তি তাঁর সামনে এগিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র সর্বশক্তি দিয়ে মূর্তিটিকে আলিঙ্গন করতেই সেটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু তারপরেই ধৃতরাষ্ট্র ভীমকে হত্যা করেছেন ভেবে অনুতপ্ত হলেন। তখন ভীম এসে তাঁকে প্রণাম করলে ধৃতরাষ্ট্র আশীর্বাদ করলেন।

তারপর পাণ্ডবরা গান্ধারীর কাছে গেলেন। তাঁকে রাগে-দুঃখে আকুল দেখে তাঁর রাগ কমানোর জন্য যুধিষ্ঠির গান্ধারীর পায়ে ধরতে গেলেন। সেই সময় গান্ধারী তাঁর চোখের বাঁধনের ফাঁক দিয়ে যুধিষ্ঠিরের হাতের নখ দেখতে পেলেন। তার ফলে যুধিষ্ঠিরের সুন্দর নখ কুৎসিত হয়ে গেল। এই দেখে পাণ্ডবরা ভয় পেয়ে গেলে সেখানে উপস্থিত মহামুনি ব্যাস ও অন্যান্য ঋষিরা বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে গান্ধারীর মন শান্ত করলেন। তখন গান্ধারী মায়ের মত করে পাণ্ডবদের সান্ত্বনা দিলেন।

উপযুক্ত সময় এলে যুধিষ্ঠিরের আদেশে ধৌম্য, বিদুর, সঞ্জয়, ইন্দ্রসেন প্রভৃতিরা শত শত চন্দনকাঠের চিতা তৈরি করে যুদ্ধে নিহত বীরদের দেহের সৎকার করলেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্রকে সামনে রেখে সবাই মিলে গঙ্গার তীরে গেলেন ও বিধি অনুযায়ী তর্পণ করলেন।

তখন হঠাৎ দেবী কুন্তী শোকে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাণ্ডবদের ডেকে বললেন, “অর্জুন যাঁকে বধ করেছেন, সবাই যাঁকে সারথির ছেলে বলে মনে করত, সেই মহাবীর কর্ণের উদ্দেশ্যেও তোমরা তর্পণ কর। কারণ তিনি তোমাদের বড় ভাই ছিলেন। ভগবান সূর্যদেবের ঔরসে আমার গর্ভ থেকেই তাঁর জন্ম হয়েছিল।”

এই কথা শুনে পাণ্ডবরা বিস্ময়ে ও শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, “মা! এইসব কথা আপনি আগে কেন বলেননি? অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে এবং নিজেদের আত্মীয় ও বন্ধুদের মৃত্যুতে আমরা যত না দুঃখ পেয়েছি, কর্ণের জন্য তার শতগুণ বেশি দুঃখ এখন আমাদের পেতে হচ্ছে। আমরা যদি তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে পারতাম তবে ত্রিভুবনের কোনো জিনিসই আমাদের নাগালের বাইরে থাকত না, এই ভয়ানক যুদ্ধও হত না।” তারপর যুধিষ্ঠির কর্ণের স্ত্রীদের সঙ্গে কর্ণের উদ্দেশ্যে তর্পণ করলেন।
আত্মীয়দের সৎকার ও তর্পণের পর অশৌচের সময় কাটানোর জন্য যুধিষ্ঠির এক মাস গঙ্গাতীরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময় ব্যাস, নারদ, দেবল প্রভৃতি মহর্ষিরা এবং বেদজ্ঞ স্নাতক ব্রাহ্মণরা তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁদের সবাইকে অভ্যর্থনা করে বললেন, “আপনাদের আশীর্বাদে এবং ভীম ও অর্জুনের বীরত্বে আমি সারা পৃথিবী জয় করেছি। কিন্তু স্বজনদের মৃত্যুর পর এই জয় আমার কাছে পরাজয়েরই সামিল মনে হচ্ছে। বিশেষত কর্ণের মৃত্যু আমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তিনি যে আমাদের ভাই একথা জানার পরেও কৃতজ্ঞতার জন্য কর্ণ দুর্যোধনের পক্ষ ছেড়ে যাননি। পাশাখেলার সময় কৌরবরা যখন আমাদের অপমান করছিল, তখন কর্ণের পায়ের সঙ্গে আমাদের মায়ের পায়ের মিল দেখে আমার রাগ কমে গিয়েছিল, কিন্তু এই মিলের কারণ তখন আমি বুঝতে পারিনি।” এই বলে যুধিষ্ঠির চোখের জল ফেলতে লাগলেন।

দেবর্ষি নারদ তখন কর্ণের জন্ম ও অস্ত্রশিক্ষার সব ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, “মহারাজ! এটাই কর্ণের নিয়তি ছিল। তাঁর গুরু ভগবান পরশুরাম এবং একজন ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, ইন্দ্রদেব তাঁর আশ্চর্য কবচ ও কুন্ডল নিয়ে নিয়েছিলেন, এই সব কারণে এবং বাসুদেব কৃষ্ণের কূটনীতির ফলেই কর্ণ যুদ্ধে অর্জুনের হাতে নিহত হয়েছেন। তাঁর জন্য আপনার শোক করা উচিত নয়।”

এইসব কথা শুনে কুন্তী কাতর হয়ে বললেন, “যুধিষ্ঠির! আমি নিজে কর্ণের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, ভগবান সূর্যদেবও তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তবুও আমরা তোমার সঙ্গে কর্ণের মিল করাতে পারিনি।”

যুধিষ্ঠির তখন বললেন, “মা! কর্ণের আসল পরিচয় আমার থেকে লুকিয়ে আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন।” এরপর এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে মহাতেজা যুধিষ্ঠির জগতের সব নারীদের অভিশাপ দিলেন—স্ত্রীজাতি কখনোই কোনো কথা নিজেদের মনে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এই হল মহাভারতের শান্তি পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে জগতের সমস্ত নারীদের প্রতি যুধিষ্ঠিরের অভিশাপ দেওয়ার ঘটনা।

তথ্যসূত্র


  1. ‘মহাভারত’, কালীপ্রসন্ন সিংহ, স্ত্রীপর্ব, অধ্যায় ২৫-২৭,  পৃষ্ঠা ২৫-৩৬, শান্তি পর্ব, অধ্যায় ৫-৬, পৃষ্ঠা ১-৭
  2. ‘মহাভারত সারানুবাদ', রাজশেখর বসু, কলিকাতা প্রেস, তৃতীয় প্রকাশ, পৃষ্ঠা ৪৯৫-৪৯৯
  3. ‘নায়ক যুধিষ্ঠির’, ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ষষ্ঠ মুদ্রণ, পৃষ্ঠা ১২০-১২১
  4. ‘মহাভারতের একশোটি দুর্লভ মুহূর্ত', ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, নিউ এজ পাবলিকেশনস, দ্বিতীয় প্রকাশ, অধ্যায় ৯২, পৃষ্ঠা ৬২৫-৬৩৫

আপনার মতামত জানান