ভারতীয় বিচারালয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে বিচিত্র সব মামলার ভিড়ে এমন কয়েকটি মামলার হদিশ পাওয়া যাবে যার সঙ্গে বিখ্যাত মানুষেরা জড়িত ছিলেন। নন্দিনী সৎপতি বনাম পি এল দানি মামলা সেই তালিকারই অন্তর্ভুক্ত। নন্দিনী সৎপতি ছিলেন ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ক্ষমতায় থাকাকালীন নানারকম দুর্নীতি এবং অবৈধ উপায়ে তাঁর বিরূদ্ধে সম্পত্তি বাড়ানোর অভিযোগ তুলে তদন্ত শুরু হয়েছিল। সেই সূত্রেই নন্দিনীকে কটকের ভিজিল্যান্স থানায় উপস্থিত হতে বলা হয় এবং তাঁকে লিখিতভাবে দেওয়া একটি দীর্ঘ প্রশ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নন্দিনী প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন এবং সেই সঙ্গে সংবিধানের ২০(৩) ধারা অনুযায়ী নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া যে বাধ্যতামূলক নয় সেকথা এবং পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোন প্রশ্নের উত্তরে অভিযুক্তের নীরব থাকার অধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করেন। কটকের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করার জন্য নন্দিনীর বিরূদ্ধে ১৭৯ ধারার অধীনে বিচার করা শুরু হয়। নন্দিনী তখন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। পরে এই মামলা যায় সুপ্রিম কোর্টে। মূলত ২০(৩) এবং ১৬১(২) ধারা দুটি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করা হয়েছিল এই মামলাটিতে।
১৯৭৭ সালে ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নন্দিনী সৎপতির বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ১৬১, ১৬৫, ১২০বি এবং ১০৯ ধারায় দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল যে, নন্দিনী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নানারকম গর্হিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন এমনকি বিপুল পরিমাণ বেআইনী সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। সেই কারণে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কটক ভিজিল্যান্স থানায় নন্দিনীকে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তদন্তের সময় লিখিত কিছু প্রশ্নের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় যার মধ্যে অধিকাংশ প্রশ্ন ছিল তাঁর হিসেব বহিৰ্ভূত সম্পত্তি নিয়ে। কিন্তু নন্দিনী সৎপতি প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন এবং সংবিধানের ধারা ২০(৩) অনুযায়ী সুরক্ষার দাবি জানান।
আসলে এই ২০(৩) ধারায় সংবিধান একটি মৌলিক অধিকার প্রদান করে যা কিনা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্তের কোন প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকার অধিকারের কথা বলে। অর্থাৎ কিনা কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন কোন প্রশ্নের উত্তর দিলে তিনি সরাসরি সংশ্লিষ্ট অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবেন বা তিনি অপরাধী হয়ে পড়বেন, তবে সেই ব্যক্তি সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের বলে নীরব থাকতে পারবেন।
এখন এই ধারা অনুযায়ী নন্দিনী সৎপতি পুলিশের জিজ্ঞাসা করা দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রশ্নের কোন জবাব না দেওয়ায় ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ ১৭৯ ধারার অধীনে নন্দিনীর বিরূদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নন্দিনী সৎপতি সংবিধানের ২২৬ অনুচ্ছেদ এবং সিআরপিসি-এর ধারা ৪০১-এর অধীনে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতার যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেন হাইকোর্টে। যখন একজন অভিযুক্ত পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় ২০(৩) ধারার প্রসঙ্গ তুলে প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন, তখন ১৬১(২) ধারার সীমানা ঠিক কতটা হওয়া উচিত হাইকোর্ট তা নিয়ে কোনোরকম সিদ্ধান্ত বা উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। এই মর্মে একটি শংসাপত্র নিয়ে ১৩২(১) ধারার অধীনে নন্দিনী ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন।
মূলত এই মামলাটি থেকে আদালতের সামনে যে মূল বিচার্য বিষয়গুলি উঠে আসে সেগুলি হল – প্রথমত, ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্ত এমন ব্যক্তি বা অভিযুক্তের নীরব থাকার অধিকার প্রয়োগ করবার অধিকার আছে কি? দ্বিতীয়ত, পুলিশের তদন্ত চলাকালীন একজন অভিযুক্তের ধারা ২০(৩) আরোপ করার সম্ভাব্য মানদণ্ড কী কী? অভিযুক্তের কাছে কি এমন প্রশ্ন উপেক্ষা করার অন্য কোন বিকল্প (option) যুক্তি আছে যা তাঁর অপরাধটি প্রকাশ করতে পারে? তৃতীয়ত, এই যে নীরবতা এটা কি শুধু আদালতেই বৈধ নাকি পুলিশি তদন্তের সময়তেও নিজেকে রক্ষা করতে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে? এছাড়াও সিআরপিসি-এর ১৬১ ধারার সীমাও বিচারের বিষয় হয়ে উঠেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল ২০(৩) অনুচ্ছেদের পরিধি নিয়েও। কখন একটি উত্তর অভিযুক্তকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করে তোলে কিংবা একজনকে অভিযুক্ত হওয়ার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়, সে-প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছিল। আরেকটি প্রশ্ন ছিল যে, ধারা ১৬১তে উল্লিখিত ‘কোনো ব্যক্তি’ (Any Person) শব্দটি কেবল একজন সাক্ষীকেই কি বোঝায়, নাকি তার মধ্যে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিও পড়েন?
উপরোক্ত এই সমস্ত প্রশ্নের বিচার আসলে ২০(৩) এবং ১৬১ ধারা দুটি নিয়েই। আবেদনকারী অর্থাৎ নন্দিনী সৎপতি এবং বিবাদি পক্ষ অর্থাৎ পি এল দানি উভয়পক্ষই নিজেদের অবস্থানের সমর্থনে জোরালো যুক্তি সাজাতে থাকেন। আবেদনকারী অর্থাৎ নন্দিনী এবং তাঁর আইনজীবীর যুক্তি ছিল যে, ১৬১(১) ধারায় উল্লিখিত ওই ‘যে কোনো ব্যক্তি’ শব্দটির মধ্যে আসলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হন না। তাঁরা আরেকবার স্পষ্ট করে উল্লেখ করে দেন যে, আত্ম-অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অধিকার অভিযুক্তকে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা থেকে রক্ষা করে যার দ্বারা সে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করতে পারে। তাছাড়া তাঁরা এও বলেন যে, অভিযুক্তকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্ন মামলার সঙ্গে একটি যৌক্তিক যোগসূত্র তৈরি করবে কিন্তু যে-প্রশ্নগুলি সংশ্লিষ্ট মামলার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে না সেগুলি অভিযুক্তকে অন্যান্য ফৌজদারি অভিযোগে জড়িত হওয়ার দিকে পরিচালিত করতে পারে কারণ অন্যান্য অনেক মামলাই সেখানে রয়েছে যার বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেওয়া যেতে পারে।
নন্দিনী সৎপতিদের তরফ থেকে নিজেদের অবস্থার সমর্থনে উক্ত যুক্তিগুলি পেশ করা হয়। অপরদিকে বিবাদি পক্ষ পি এল দানির তরফ থেকে মূলত যে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল তা হল, পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর্যায়ে ধারা ২০(৩) এবং ১৬১(২)-কে প্রয়োগ করা যায় না। কেবলমাত্র অভিযুক্তকে আদালতে পেশ করা হলেই উক্ত দুটি ধারাকে ব্যবহার করা যেতে পারে নিজের পক্ষে। নন্দিনী সৎপতির ক্ষেত্রে যেহেতু পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় থেকেই সংবিধানের উক্ত দুই ধারাকে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেজন্যেই বিবাদি পক্ষ এইরকম যুক্তি হাজির করেছিল মহামান্য আদালতের সামনে।
দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পরে সুপ্রিম কোর্ট যেসব সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল এবং বিচার্য ধারাদুটি সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছিল তা আইনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলার দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি জেএস, বিচারপতি ভি ডি তুলজাপুরকর এবং বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার রায়।
কোন ক্ষেত্রে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে যা তাঁর আত্ম-অপরাধের কারণ হিসেবে গণ্য হতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তরে আদালত জানায়, আদালতের মধ্যে না থাকলেও একজন ব্যক্তি নীরব থাকার অধিকার দাবি করতে পারে। এভাবেই ২০(৩)-এর পরিধিকে ব্যাখা করেছিল আদালত এমপি শর্মার মামলার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে। আদালত জানিয়েছিল আদালতের মধ্যেই কেবল নয়, যদি পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করতে বাধ্য করা হয়, তখনও এই নীরবতার অধিকারটিকে প্রয়োগ করতে পারে সেই ব্যক্তি। আদালতের বাইরেও একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে। অবশ্য আদালত আরেকটি কথাও এপ্রসঙ্গে জানিয়ে দেয়, যে, ২০(৩) অনুচ্ছেদ সেই ব্যক্তিদের জন্যই উপলব্ধ হবে যাদের বিরূদ্ধে অভিযুক্ত হিসেবে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছে।
এই পরিধি ব্যাখা করার সময় আদালত অভিযুক্তকে জোরপূর্বক অন্যায় স্বীকার করানোর জন্য পুলিশি নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতাকে বিচারের আওতায় এনেছিল। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়, সেকারণে ফৌজদারি বিচারের এই প্রাথমিক পর্যায়টি থেকেই ২০(৩) ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে বলেই সংবিধান প্রণেতারা বিবেচনা করেন। আদালত সেই মর্মেই এই ধারার পরিধিকে আদালত চত্বরের বাইরেও প্রসারিত করেছে।
আদালত, একটি অপরাধমূলক বিবৃতি এবং একটি বাধ্যতামূলক সাক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য করেছিল। উল্লেখ করেছিল যে এটি প্রয়োজনীয় নয় যে সমস্ত প্রাসঙ্গিক উত্তর অপরাধমূলক হতে হবে এবং যে বিবৃতিগুলিকে অপরাধমূলক বলে মনে হয় সেগুলিকে স্বীকারোক্তি হিসেবে ধরা যাবে না। আদালত জানায় যে, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির পছন্দসই আইনজীবী নির্বাচন করতে চাওয়াকে অস্বীকার করা বা বাধা দেওয়া যাবে না৷ আদালত ১৬১ ধারা প্রসঙ্গে পাকালা নারায়ণ স্বামী বনাম সম্রাট মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায় উদ্ধৃত করে, যেখানে বিচারক সিআরপিসি-এর ১৬১ ধারার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে রায় দিয়ে বলেছেন যে, উল্লিখিত ‘যে কোনো ব্যক্তি’ কথাটি একজন অভিযুক্ত এবং সন্দেহভাজন অন্যায়কারী, যিনি কিনা পুলিশের চোখে মামলা সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে।
নন্দিনী সৎপতি বনাম পি এল দানি মামলা-য় আদালতের দেওয়া রায় যেমন অভিযুক্তের মানসিক বা শারীরিক শোষণ প্রতিরোধে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাকে সীমিত করেছে, তেমনি মহিলা অভিযুক্তকে বাড়িতেই জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে, থানায় ডাকা যাবে না, এমন নির্দেশিকা জারি করে নারী নিরাপত্তাকেও সুরক্ষিত করেছে আদালত। নন্দিনী সৎপতি মামলার এই রায় ২০(৩) এবং ১৬১(২) ধারাকে বিস্তৃতি প্রদান করেছিল এবং নীরবতার অধিকারকেও রক্ষা করেছিল।
Excellent! Very interesting