নাতাশা ডেমকিনা

নাতাশা ডেমকিনা – এক্স রে বালিকা

আমাদের পৃথিবীতে আশ্চর্য কত ঘটনাই ঘটে। কখনও আবার দেখা মেলে এমন কিছু বিস্ময়-মানবের, সারা বিশ্ব যাঁদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। হঠাৎ বিশ্বাস করাই কঠিন দাঁড়ায়। তেমনই এক অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী হলেন রাশিয়ার সতেরো বছর বয়সী নাতাশা ডেমকিনা (Natasha Demkina)। নাতাশার বিশেষত্ব হচ্ছে, তাঁর চোখের মধ্যেই এক্স রে-র ক্ষমতা রয়েছে। তিনি খালি চোখেই মানবদেহের শরীরের অভ্যন্তরীন অংশ দেখতে পান। এই এক্স রে মানবের খবর ছড়িয়ে পড়তেই চতুর্দিকে আলোড়ন তৈরি হয়। নাতাশা রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসার কাজেও দারুণ অবদান রাখেন। সংবাদমাধ্যমে, সংবাদপত্রে তাঁকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান, সাক্ষাৎকার চলতে থাকে। আবার কখনও কখনও তাঁর এমন অভূতপূর্ব দৃষ্টিশক্তিতে যে ত্রুটি আছে, তেমন ঘটনাও ঘটেছে। ডকুমেন্টারি ফিল্মও তৈরি হয়েছে এই এক্স রে গার্ল নাতাশাকে নিয়ে।

১৯৮৭ সালে রাশিয়ার মর্দোভিয়ার অন্তর্গত সারানস্কে নাতাশা ডেমকিনার জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম নাটলিয়া হলেও শৈশবের ‘নাতাশা’ নামটিতেই তিনি পরিচিত সারা বিশ্বে। নাতাশার মায়ের নাম তাতায়ানা ভ্লাদিমোভনা। তাতায়ানা জানিয়েছেন যে, নাতাশা ছোট থেকেই খুব দ্রুত যে-কোনো জিনিস শিখে নিতে পারতেন, যাকে বলে ফাস্ট লার্নার। মাত্র ছয় মাস বয়সেই নাকি তিনি কথা বলতে শিখেছিলেন, এবং এক বছর বয়সে আলেকজান্ডার পুশকিনের লেখা আবৃত্তি করতে পারতেন। তিন বছর বয়সে শিখে গিয়েছিলেন বর্ণমালা। দশ বছর বয়স পর্যন্ত পাঁচজন শিশুর মতোই সাধারণ শৈশব ছিল নাতাশার। কিন্তু বলা হয় যে, অ্যাপেনডিক্স অপসারণের জন্য অপারেশনের পরই নাকি দশ বছর বয়স থেকে নাতাশার মধ্যে একটা অদ্ভুত ক্ষমতা প্রকট হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন নাকি তিনি তাঁর মায়ের শরীরের আভ্যন্তরিক কাঠামোসহ সবটাই খালি চোখে দেখতে পান। মায়ের শরীরের ভিতরে যা যা দেখতে পাচ্ছিলেন সবই তিনি মাকে জানিয়েছিলেন তখন। বলেন, প্রথমে কিছু সেকেন্ডের জন্য তিনি কোনো এক ব্যক্তির ভিতরে রঙিন ছবি দেখতে পান, তারপর ধীরে ধীরে সেটিকে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন।

এমন বিস্ময়কর এক শক্তির অধিকারিনী নাতাশার এই গল্প এরপর জনে জনে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকায়, এলাকা ছাড়িয়ে আরও দূরের মানুষের মধ্যেও। খবরটা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর থেকেই নাতাশাদের বাড়িতে লোক সমাগম শুরু হয়, এবং সকলেই প্রায় চিকিৎসার নিমিত্ত নিজের শরীর পর্যবেক্ষণ করিয়ে নেবার জন্য আসছিলেন নাতাশার কাছে। একটি স্থানীয় সংবাদপত্র ২০০৩ সালে তাঁর গল্প প্রকাশ করেছিল। সেবছরই নভেম্বর মাসে টেলিভিশনেও নাতাশার এই খবরটি প্রচারিত হয়েছিল। টেলিভিশনে এই খবর দেখে এক ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র তাঁকে লন্ডনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল দৃষ্টিশক্তির প্রদর্শনের জন্য। নিউইয়র্ক এবং টোকিওর গ্রুপ থেকেও আমন্ত্রণ এসেছিল তাঁর।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

নাতাশার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক রোগ নির্ণয়ের ঘটনাটিও বেশ বিস্ময়কর। এক ব্যক্তি পেশাদার একজন ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ চিকিৎসার পরের তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। তখন নাতাশা সম্পর্কে জানতে পারেন তিনি এবং সাহায্যের জন্য ছুটে যান তাঁর কাছে। নাতাশা নিজের এক্স রে দৃষ্টি দিয়ে লোকটির শরীরের ভিতরে ফুসফুসে কিছু একটা দেখতে পান কিন্তু বর্ণনা করতে পারেন না। ফলে সেই বস্তুটির একটি ছবি এঁকে দেন নাতাশা এবং তা দেখে মস্কোর একজন ডাক্তার সিদ্ধান্তে আসেন যে, সেটি সারকোইডোসিস গ্রাণুলোমা নামক একটি প্রদাহজনক রোগের ক্ষত নির্দেশ করছে৷

এছাড়াও রাশিয়াতেই নাতাশার নিজের শহরের শিশু হাসপাতালের ডাক্তাররা সত্যিই তাঁর ক্ষমতা আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি কাজ করতে বলেছিলেন তাঁকে। নাতাশা একজন ডাক্তারের পেটের ভিতরকার যে ছবি এঁকেছিলেন, তা থেকে ধরা পড়েছিল সেই ডাক্তারের আলসার রয়েছে। এছাড়াও একজন রোগীর ক্যান্সার প্রসঙ্গেও তিনি দ্বিমত পোষণ করেন এবং জানান যে, তিনি সামান্য ছোট একটি সিস্ট দেখতে পাচ্ছেন কেবল। সতেরো বছর বয়সে নাতাশা সপ্তাহের পাঁচটি সন্ধের প্রত্যেকটিতে কুড়িজন করে রোগী দেখতেন। সেখান থেকে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করে পরিবারকে আর্থিল সঙ্কট থেকেও মুক্ত করেছিলেন তিনি।

যাই হোক, ২০০৪ সাল থেকে নাতাশা মস্কোর সেমাশকো স্টেট স্টোমাটোলজিকাল ইউনিভার্সিটির পূর্ণসময়ের ছাত্রী ছিলেন। সেবছরই ইউনাইটেড কিংডমের ডিসকভারি চ্যানেলে এবং জাপানের এক টেলিভিশন শো-তে উপস্থিত হয়েছিলেন নাতাশা। ২০০৪-এর জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘দ্য সান’ নাতাশাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। সেখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় ডেমনস্ট্রেশন দেন তিনি এবং তাঁর রোগনির্ণয়ের সঙ্গে পেশাদার চিকিৎসকদের রোগনির্ণয়কে তুলনা করা হয়েছিল।

ডিসকভারি চ্যানেল নাতাশাকে নিয়ে যে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছিল, তাতে দেখানো হয়, কত সফলভাবে নাতাশা একজন গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত একজন মহিলার শরীরের সমস্ত ভাঙন এবং মেটাল পিনগুলি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে। যুক্তরাজ্য ত্যাগ করার পর হঠাৎ কথা ওঠে যে নাতাশার রোগনির্ণয়ে ত্রুটি রয়েছে। ক্রিস স্টিল নামক একজন টেলিভিশন-চিকিৎসককে নাতাশা বলেছিলেন যে, কিডনিতে পাথর, গল ব্লাডারের সমস্যা, লিভার বর্ধন এবং অগ্ন্যাশয়ের সমস্যায় ক্রিস ভুগছেন। কিন্তু পরে নানারকম পরীক্ষায় জানা যায় ক্রিস স্টিলের স্বাস্থ্য আদতে ভালোই রয়েছে এবং নাতাশার বলা রোগগুলির কোনো উপস্থিতি তাঁর ভিতরে নেই।

এক্স রে দৃষ্টির ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য ডিসকভারি চ্যানেল ‘দ্য গার্ল উইথ এক্স রে আইজ’ শিরোনামের একটি ডকুমেন্টারিতে নিউইয়র্কে নাতাশা ডেমকিনাকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কমিটি ফর স্কেপটিকাল ইনকোয়ারি (সিএসআই)-এর গবেষক রে হাইম্যান, রিচার্ড ওয়াইজম্যান এবং অ্যান্ড্রু স্কলনিক পরীক্ষাটি পরিচালনা করেছিলেন। প্রথম পর্বের পরীক্ষায় সেখানে উপস্থিত ছয়জন রোগীর সঙ্গে নাতাশাকে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে যোগাযোগ এবং কথা বলতে দেওয়া হয়। সেই ছয়জনের মধ্যে পাঁচজন তাঁর নির্ভুল রোগনির্ণয়ে মুগ্ধ হয়ে যান। যদিও হাইম্যান এবং ওয়াইজম্যান এতে খুব একটা খুশি ও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁদের মতে, নাতাশা রোগীদের সামনে নানারকম রোগের পরিস্থিতি হাজির করেছেন এবং সঠিক পরিস্থিতি অনুযায়ী রোগীর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকেই রোগনির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছেন নাতাশা। তাঁরা দুজন নাতাশার এক্স রে দৃষ্টির ক্ষমতাকে প্রথমেই এভাবে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ছিল সাতজন রোগী। তার মধ্যে ছয়জন স্বাস্থ্যের সমস্যায় ভুগছিলেন এবং বাকি একজন ছিলেন সুস্থ। নাতাশাকে মোট ছটি টেস্ট কার্ড দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি কার্ডে শারীরবৃত্তীয় অঙ্কনের সঙ্গে মেডিকেল অবস্থার বর্ণনা দেওয়া। নাতাশার কাজ ছিল কোন রোগীর কোন ধরনের মেডিকেল ইস্যু তা শনাক্ত করা। মোট পাঁচটির জবাব সঠিক দিতে পারলে তবেই কৃতকার্য মানা হবে নচেৎ নয়। কিন্তু নাতাশা মোট চারটি সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছিল। এক ব্যক্তির মস্তিষ্কের ভিতর থেকে একটি বড় টিউমার বাদ দেওয়ার পর সেই অনুপস্থিত অংশকে ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত বৃহৎ ধাতব প্লেটকে শনাক্ত করতে সক্ষম হননি নাতাশা। হাইম্যানের বক্তব্য ছিল, নাতাশা হয়তো রোগীদের চেহারা এবং কাজ দেখে তাদের অবস্থা সম্পর্কিত সূত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু এই পরীক্ষার ভিত্তিতে নাতাশার ক্ষমতাকে খাটো করা হলেও এই পরীক্ষাটিকে ঘিরে সমালোচনা হয়েছিল৷ বলা হয় যে, জেট-ল্যাগড অবস্থায় নাতাশাকে চাপের মুখে ফেলে এই পরীক্ষা করা হয়, ফলে এটি গুরুতরভাবে ত্রুটিপূর্ণ একটি পরীক্ষা। নাতাশা নিজেও অভিযোগ করেছিল যে, ধাতব প্লেটটি দেখার জন্য তাঁর আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল। এছাড়াও তিনি বলেন মূল পরীক্ষাগুলি পরিচালিত হওয়ার পরে তিনি তাঁর নিজের রোগনির্ণয়ের সঙ্গে স্বাধীন চিকিৎসা নির্ণয়ের তুলনা করতে সক্ষম হননি, ফলে, পরীক্ষার পরিচালনাকারীদের কাছে অজানা থাকা কোনো অবস্থার নির্ণয় তিনি করেছেন কিনা, তা যাচাই করতে পারেননি। সিএসআইসিওপি (CSICOP) এবং সিএসএমএমএইচ (CSMMH) দ্বারা সম্পাদিত নিউইয়র্ক পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি স্ব-প্রকাশিত মন্তব্যে , নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী এবং প্যারাসাইকোলজির সমর্থক ব্রায়ান জোসেফসন হাইম্যানের দ্বারা ব্যবহৃত পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন এবং গবেষকদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি কিশোরিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করার জন্য এটি একধরনের ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়েছে জোসেফসনের।

নিউইয়র্ক পরিদর্শনের পর অস্বাভাবিক মানবিক ক্ষমতা নিয়ে গবেষণাকারী অধ্যাপক ইয়োশিও মাচির আমন্ত্রণে জাপানের টোকিও ইলেকট্রিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ভ্রমণ করেন নাতাশ। পূর্ববর্তী পরীক্ষার সমালোচনা ও বিতর্ক থেকে শিক্ষা নেওয়ার পর টোকিও পরীক্ষায় রোগীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা উল্লিখিত মেডিকেল সার্টিফিকেট আনার কথা বলা হয়। দাবি করা হয় যে, নাতাশা সেখানে এক মহিলার গর্ভাবস্থার প্রাথমিক পর্যায় এবং অন্য একজনের মেরুদণ্ডের বক্রতা শনাক্ত করতে সফল হয়েছিলেন। মাচি পশুচিকিৎসা ক্লিনিকে একটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে নাতাশাকে একটি কুকুরের মধ্যেকার অসঙ্গতি নির্ণয় করতে বলা হয়েছিল। নাতাশা বলেন তাঁর ক্যানাইন অ্যানাটমি সম্পর্কে কিছু জানা নেই, তবুও তিনি বুঝতে পারেন, যে কুকুরটির পিছনের ডান পায়ে একটি কৃত্রিম যন্ত্র ছিল। টোকিও পরীক্ষাটি যে তিনজন জাপানী বিশেষজ্ঞ পর্যালোচনা করেছিলেন, তাঁরা হলেন, জাদুবিদ্যা সমালোচক হাজিমে ইউমু, মনোবিজ্ঞানী হিরোয়ুকি ইশিই এবং টন্ডেমো-বন সোসাইটির হিরোশি ইয়ামামোতো। চুড়ান্ত পরীক্ষায় একটি পাসপোর্ট ফটো থেকে একজন ব্যক্তির অবস্থা নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন নাতাশা। সঠিকভাবে সে-ব্যক্তির লিভার ক্যান্সার শনাক্ত করেন তিনি। সেখান থেকে তাঁকে একটি নথি প্রদান করা হয়েছিল যা তার যোগ্যতাকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। ডঃ মাচির পরীক্ষা এবং তিন সমালোচকের আলোচনা ২০০৫ সালের ১২ মে ফুজি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল।

নাতাশা সর্বোচ্চ সম্মান-সহ উচ্চবিদ্যালয়ে স্নাতক হন এবং মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে স্থান করে নেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় তাঁর। ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে তাঁর নিজের অনুশীলন এবং মানসিক ও অন্যান্য রোগ নিরাময়ের জন্য নির্মিত ‘সেন্টার অব স্পেশাল ডায়াগনস্টিক অব দ্য নাটালিয়া ডেমকিনা’র জন্য কাজ করেন।এমন এক বিস্ময়-বালিকা মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অভিনব সংযোজন নিঃসন্দেহে।

আপনার মতামত জানান