প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবস (National Consumers Right Day)
প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্বর সমগ্র ভারত জুড়ে পালিত হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবস।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভোক্তাদের সঠিক মূল্যের বিনিময়ে উপযুক্ত পরিষেবা দান কিংবা সঠিক পণ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে এবং কোনো ভোক্তাই যাতে পণ্য কেনা বা পরিষেবা লাভের সময়ে অযৌক্তিক হয়রানি বা প্রতারণার শিকার না হন তার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয়ে থাকে। সমগ্র বিশ্বে একই উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে ১৫ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস।
১৯৮৬ সালে যখন ভারতে প্রথম ভোক্তা সুরক্ষা আইন চালু হয়, সেই বছর থেকেই জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবস পালিত হয়ে আসছে। ভোক্তা হল সেই ব্যক্তি যিনি কোনো পণ্য ক্রয় করেন বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে কোনো পরিষেবা লাভ করেন। তবে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কোন পণ্যের ক্রেতা বা পরিষেবার গ্রহীতাকে যথাযথ ভোক্তা বলা যায় না। ১৯৮৬ সালে ভোক্তা সুরক্ষা আইন পাস হয় এবং সেই সাথে ভারতের ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, খাদ্য ও বিতরণ দপ্তর (Ministry of Consumer Affairs, Food and Public Distribution) ঘোষণা করে যে, কোনো ভোক্তার মূলত ৬টি অধিকার রয়েছে – সুরক্ষার অধিকার, সঠিক তথ্য জানার অধিকার, পছন্দের অধিকার, প্রত্যুত্তর শোনার অধিকার, প্রতিকারের অধিকার এবং ভোক্তার উপযুক্ত শিক্ষার অধিকার। এই সমস্ত অধিকার পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসংঘ দ্বারাও স্বীকৃত হয়েছে। এই আইনেই প্রথম ভোক্তাদের সুরক্ষার্থে কিছু অধিকার (Rights) ঘোষণা করা হয় যেগুলি হল এইরূপ –
ক. জীবন ও সম্পদের জন্য বিপজ্জনক পণ্যের বিক্রয় বন্ধ করার অধিকার।
খ. পণ্যের মান, পরিমাণ, বিশুদ্ধতা এবং দাম সম্পর্কে অবহিত করে অনুপযুক্ত বিপণন থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করা।
গ. অন্যায্য বিপণন এবং ভোক্তাদের হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগের অধিকার
এই সমস্ত বিষয়গুলির অন্যথা ঘটলে উপভোক্তা মন্ত্রক জেলা, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় আদালতে বিশেষ আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে থাকে। ১৯৮৬ সালের এই আইনে অনুপযুক্ত পণ্য সরবরাহের ক্ষতিপূরণ ভোক্তা বিক্রেতা বা পরিষেবাদাতার থেকে আদায় করতে পারতেন না। ২০১৯ সালে এই ভোক্তা সুরক্ষা আইনটির পরিমার্জন করা হয়। নতুন পরিমার্জনে ভোক্তার অধিকারের বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় ভোক্তা সুরক্ষা মন্ত্রণালয়ের (Central Consumer Protection Authority) আওতায় আনা হয় এবং ভোক্তার ক্ষতিপূরণ দাবি করার অধিকার স্বীকার করা হয় এই আইনে। আগের আইনে আদালত কোনোপ্রকার আইনি হস্তক্ষেপ করতে পারত না, কিন্তু ২০১৯ সালের এই পরিমার্জিত আইনে ভোক্তা ও বিক্রেতার মধ্যে আইনি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আদালত সমস্যাবহুল ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করতে পারে। এমনকি কোনো মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভোক্তাকে প্রতারণা করলে, বিভ্রান্তির সৃষ্টি করলে ভোক্তা আদালতের কাছে প্রামাণ্য অভিযোগ দায়ের করা মাত্রই আদালত বিচারে বিক্রেতা-সংস্থার ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা এবং দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের নির্দেশ দিতে পারে। পরবর্তীকালে ঐ সংস্থা একই অপরাধ করলে ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ধার্য হতে পারে তাদের উপর। খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সবজির মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে ভেজাল কিংবা ওজন-পরিমাপে প্রতারণা থেকে ভোক্তাদের সচেতন করতে ২০০৯ সালে ভারত সরকারের ভোক্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, খাদ্য ও বিতরণ দপ্তর ‘জাগো গ্রাহক জাগো’ নামে একটি সচেতনতা কর্মসূচি চালু করে। এই কর্মসূচিতে মুদ্রণ মাধ্যম, টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, রেডিও সম্প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতবাসীকে ভোক্তা সুরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে অবগত করে ভারত সরকার।
সাধারণত এই দিনে প্রতি বছর সরকারি উদ্যোগে দেশের নানা স্থানে সেমিনার, রেডিও অনুষ্ঠান কিংবা সভা-সমিতি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ২০২০ সালে একটি সেমিনার আয়োজনের উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার যার বিষয় নির্ধারিত হয় ‘ভোক্তা সুরক্ষা আইন এবং ভারতীয় ভোক্তাদের দিনবদল’। ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য সহ পালিত হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘গ্রাহকের ক্ষতির বিকল্প নিষ্পত্তি’ (Alternate Consumer Disputes Redressal)। ২০১৭-তে ‘ডিজিটাল বাজারের অগ্রগতি : ভোক্তা সুরক্ষার সমস্যা ও প্রতিকূলতা’ (Emerging of Digital Markets : Issues and Challenges for Consumer Protection) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। ২০১৮ সালে এই দিনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সঠিক সময়ে ভোক্তার অভিযোগের সমাধান’ (Timely Disposal of Consumer Complaints)। ২০১৯ সালে প্রতিপাদ্য ছিল ‘গ্রাহকের ক্ষতির অথবা অভিযোগের বিকল্প নিষ্পত্তি’ (Alternate Consumer Grievance / Disputes Redressal) এবং ২০২০ সালে এই বিশেষ দিনটির প্রতিপাদ্য স্থির হয় ‘স্থায়ী ভোক্তা’ (Sustainable Consumer)।
One comment