প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলির মধ্যেই একটি হল জাতীয় আইনি পরিষেবা দিবস (National Legal Service Day)।
প্রতি বছর ৯ নভেম্বর সারা ভারত জুড়ে জাতীয় আইনি পরিষেবা দিবস পালিত হয়। মূলত ১৯৮৭ সালে পাশ হওয়া ইণ্ডিয়ান লিগাল সার্ভিসেস অ্যাক্ট-এর বিভিন্ন ধারায় সাধারণ মানুষের কাছে আইনি পরিষেবাকে উপলব্ধ করতে সহায়তা করা এবং আইনি পরিষেবা পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে মানুষকে অবগত করানোর জন্যে এই বিশেষ দিনটি প্রতি বছরই উদ্যাপিত হয়। বহু মানুষ ভাবেন যে আইনি পরিষেবা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয় এবং প্রচুর ঝঞ্ঝাটের ও অর্থকরী ক্ষতির বিষয়। এই ভাবধারা বদলাতে এবং প্রতিটি সাধারণ মানুষকে আইনি পরিষেবা লাভের মৌলিক অধিকার মেটাতে প্রয়াসী করে তুলতে এই দিনটি পালনের গুরুত্ব রয়েছে। ভারতের আইনবিধি এবং সংবিধান প্রতিটি মানুষকেই সমান মনে করে। ফলে প্রতিটি মানুষের সমান ভাবেই আইনি পরিষেবা লাভের অধিকার রয়েছে। আইন সকলের জন্য এই ভাবধারা প্রচার করাই এই দিনটি পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়াও সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য যে সকল প্রকার আইনি পরিষেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া সম্ভব তাও এই দিনটি তুলে ধরে। অর্থনৈতিক সামর্থ্য বা কোনো প্রকার অক্ষমতার মানদণ্ডে বিচার ব্যবস্থা প্রভাবিত হবে না, এমন বার্তাই প্রচার করা হয় এই দিনের মাধ্যমে।
আইনি পরিষেবা দানের সুবিধে সকল স্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে এবং উপলব্ধ করে তুলতে বিভিন্ন দেশের মতো ভারতেও প্রতিটি রাজ্যে স্থাপিত হয়েছে লোক আদালত, মধ্যস্থতাকারী এবং আইনি সহায়তা কেন্দ্র ইত্যাদি সংস্থা। এখন আইনি পরিষেবা বলতে বোঝায় আদালত কর্তৃক যে কোনো বিষয়ে মামলা পরিচালনা এবং আইনি পরামর্শ দানের বিষয়টিকেই আইনি পরিষেবা বলা হয়। আগে একেই বলা হতো আইনি সাহায্য। ১৯৮৭ সালের ১১ অক্টোবর যে আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ আইন পাশ হয় সেখানে আইনি সাম্যের আদর্শের কথা বলা হয়। এই আইনবলে একটি স্বশাসিত সংস্থার জন্ম হয় যার নাম জাতীয় আইনি পরিষেবা অধিকার সংস্থা (National Authorities of Legal Services Act)। এই সংস্থা ক্রমে কেন্দ্রীয় স্তর থেকে রাজ্যস্তরে এবং জেলাস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এই আইনে নতুনভাবে সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দুর্বল, লাঞ্ছিতদের আইনি পরিষেবার সুবিধে দিতে হবে এমন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। ১৯৮৭ সালে পাশ হওয়া এই আই ইণ্ডিয়ান লিগাল সার্ভিসেস অ্যাক্টের ১৪ ও ৩৯(ক) ধারায় রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে প্রতিটি রাজ্য তাঁর অধিবাসীদের জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আইনি পরিষেবা দিতে বাধ্য থাকে। এমনকি সেই অ্যাক্টের ১২ নং ধারায় কারা কারা এই আইনের পরিষেবা নিতে পারে তাদের বিশদ বিবরণে বলা হয়েছে –
১) মহিলা বা শিশু
২) তপশিলি জাতি বা উপজাতির সদস্য
৩. কোনো শিল্প শ্রমিক
৪. মানুষ নিয়ে অবৈধ কারবারের শিকার
৫. মানসিকভাবে অসুস্থ
৬. ব্যাপক দুর্বিপাক, জাতপাত জনিত বর্বরতা, বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার কোনো ব্যক্তি
৭. মানসিক হাসপাতাল বা হোমে আছেন এমন ব্যক্তি
৮. সুপ্রিম কোর্ট ব্যতীত অন্য আদালতে মামলা লড়ার ক্ষেত্রে যাদের বার্ষিক আয় এক লক্ষ টাকার কম আর সুপ্রিম কোর্টের মামলার ক্ষেত্রে আড়াই লক্ষ টাকার কম তারা সকলেই এই পরিষেবা পেতে পারে।
উকিলের পরিষেবা, আদালতের ফি, পিটিশন বা অন্যান্য কাগজপত্র টাইপ করা, সাক্ষী-শমনের জন্য ব্যয় ইত্যাদি খাতে বিভিন্ন রকমের পরিষেবা পাবেন সকল স্তরের মানুষ। এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এই আইনে। আইনি পরিষেবার এত বিপুল সম্ভাবনার কথা জানাতেই বিশেষভাবে পালিত হয় জাতীয় আইনি পরিষেবা দিবস। ১৯৮৭ সালে সেই আইনটি পাশ হলেও ১৯৯৫ সালের ৯ নভেম্বর থেকে এই আইনটি কার্যকর হয়। তাই এই দিনেই পালন করা হয় জাতীয় আইনি পরিষেবা দিবস। ১৯৯৫ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে স্থাপিত হয়েছিল জাতীয় আইনি পরিষেবা অধিকার সংস্থা যার মুখ্য অধিকর্তা হিসেবে ছিলেন মুখ্য বিচারপতি সম্মানীয় এ এস. আনন্দ। জাতীয় আইনি পরিষেবা অধিকার সংস্থা কর্তৃক রাজ্যের বেশিরভাগ অংশে আইনি পরিষেবা সহজলভ্য করে তোলার জন্য লোক আদালত স্থাপন করা হয়েছে। এই লোক আদালতের কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকে জাতীয় আইনি পরিষেবা অধিকার সংস্থা যার মুখ্য অধিকর্তা হলেন উচ্চ আদালতের মুখ্য বিচারপতি। এখন রাজ্যস্তর থেকে প্রতিটি জেলাতেই এই আইনি পরিষেবা সুলভ করে তুলতে স্থাপিত হয়েছে ডিস্ট্রিক্ট লিগাল সার্ভিসেস অথরিটি। এই সংস্থার প্রস্তাবিত কার্যক্রমগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
১. সমস্ত জেলায় লোক আদালত গড়ে তোলা
২. পাবলিক সেক্টর, সরকারি চাকুরি এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ক্ষেত্রে স্থায়ী লোক আদালতের ব্যবস্থা করা
৩. আইনি শিক্ষা ও আইনি সচেতনতা প্রচার করা
৪. দেশের প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘লিগাল এইড কাউন্সেল’ নিয়োগ করা
৫. পুরনো পদ্ধতিতেই লোক আদালত মারফত বিভিন্ন মামলা পর্যবেক্ষণ করা
৬. বিভিন্নভাবে আইনি পরিষেবার ব্যাপারে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাতে মানুষ সহজেই এই ব্যাপারে জানতে পারে
৭. বিভিন্ন কারাগারেও এই আইনি পরিষেবার ব্যবস্থা চালু রাখা
৮. কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ‘ন্যায়দীপ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা।
৯. লোক আদালতের মাধ্যমে আদালতের ফি কমানোর প্রচেষ্টা করা
এই সমস্ত কর্মসূচি গ্রহণের জন্য লোক আদালত সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। সরাসরি আদালতে এসে বড়ো সড়ো মামলায় না গিয়ে তার আগেই লোক আদালতের মাধ্যমে জাতীয় আইনি পরিষেবা অধিকার সংস্থা বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে। লোক আদালতের বিচারকেরা প্রয়োজনে মামলায় হস্তক্ষেপ করেন। লোক আদালত তাই বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষের আলোচনার সাপেক্ষে এবং পারস্পরিক সম্মতিতে মামলার নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে। আপোষ রফার মাধ্যমে যদি কোনো সমস্যার সমাধান হয়েই যায়, সেক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় যাওয়ার দরকারই পড়ে না। এর ফলে বহু দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষ বিচারপ্রার্থী হিসেবে উপযুক্ত পরিষেবা পেয়ে থাকেন। এই কারণেই আইনি পরিষেবা সম্পর্কে সচেতনতা প্রচার করতে ভারত জুড়ে ৯ নভেম্বর তারিখে উদ্যোগপূর্ণভাবে জাতীয় আইনি পরিষেবা দিবস পালন করা হয়।