প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের পালনীয় সেই দিবসগুলির মধ্যে একটি হল জাতীয় পর্যটন দিবস (National Tourism Day)।
প্রতি বছর ২৫ জানুয়ারি সমগ্র ভারত জুড়ে পালিত হয় জাতীয় পর্যটন দিবস । ভারতের জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বিস্তার করার লক্ষ্যেই এই দিনটি পালন করা হয়। ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে এখানে পর্যটন শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই উন্নত এবং ভারতের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এই পর্যটন শিল্প। বহু বিদেশি পর্যটক ভারতে আসেন ভ্রমণের জন্য, ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে জানার জন্য। তাই গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়াও এই দিবস পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাছাড়া ভারতের আভ্যন্তরীণ পর্যটনের দিকেও উন্নয়নের মাধ্যমে ভারতকে একটি উৎকৃষ্ট ভ্রমণ ও পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা জাতীয় পর্যটন দিবস পালনের লক্ষ্য।
বিভিন্ন রকমের পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে ভারতে – সাংস্কৃতিক, ঐতিহ্যবাহী, প্রমোদ ভ্রমণ, প্রাকৃতিক, শিক্ষামূলক, বাণিজ্যিক, ক্রীড়ামূলক, গ্রামীণ এবং পরিবেশ-বান্ধব পর্যটন ইত্যাদি সবই ভারতের অন্যতম সম্পদ বলা যায়। পর্যটন শিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন জাতীয় নীতির প্রচার ও প্রসারে এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলির উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়ে ভারতের পর্যটন মন্ত্রক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতীয় চাকুরিজীবিদের প্রায় ৭.৭ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বিদেশি পর্যটক ভারতে আসেন। পরিসংখ্যান বলছে ২০১৪ সালে ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ২০ লক্ষ। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলির সুরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং ভারতের পর্যটন শিল্পের প্রচার ও প্রসারের জন্যই জাতীয় পর্যটন দিবস পালিত হয়ে আসছে। বেশিরভাগ ভারতীয় নাগরিক প্রায় বছরই বিদেশের নানা জায়গায় ভ্রমণে যায়, বিদেশ ঘোরার পরিকল্পনাতেই জোর দেয় বেশি। যেখানে প্রতি বছরই ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যাণ্ড, নিউজিল্যাণ্ড প্রভৃতি নানা দেশের মানুষ ভারতে আসেন ঘোরার জন্য, সেখানে ভারতীয়দের নিজের দেশের পর্যটন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠেনি এখনও। এই কারণেই ভারতের পর্যটন শিল্পের আরও প্রচার দরকার বলে মনে করে ভারত সরকার। ভারতের উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার সময় প্রত্যেক কিলোমিটার পথ পেরোলেই দেখা যায় ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ। আয়তনের দিক থেকে ভারত বিশ্বে সপ্তম বৃহত্তম দেশের মর্যাদায় আসীন। একইসঙ্গে নদী, গিরি, কান্তার, মরু সব রয়েছে এই দেশে, এতই বৈচিত্র্য। এমনকি ভারতের ভৌগোলিক পরিবেশ বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের থেকে একেবারে পৃথক, তার স্বাতন্ত্র্যের কারণে। রৌদ্রস্নাত বালিয়াড়ি, সমুদ্রের চরে বালির ঝিকিমিকি, বরফে ঢাকা পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, মোহনা, মরুভূমি, গভীর বন ইত্যাদি মিলিয়ে ভারত যে কতখানি সুন্দর তা তুলে ধরার মাধ্যমেই এই পর্যটন দিবসের তাৎপর্য সফল হবে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের অর্থনীতি তথা জিডিপিতে শুধুমাত্র পর্যটন শিল্পই মোট ৮ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এনে দিয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের পর্যটন শিল্প বেশ দ্রুতই উন্নত হয়েছে। সমীক্ষা অনুসারে বিশ্বের মধ্যে দ্রুত-উন্নয়নশীল পর্যটন শিল্প রয়েছে এখানেই। প্রায় ৪ কোটি মানুষ শুধুমাত্র এই পর্যটন শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত। ফলে ভারতের পর্যটন হয়ে উঠেছে অন্যতম কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র। ভারতের বিখ্যাত সুপ্রাচীন ঐতিহ্য সমন্বিত কুম্ভমেলাকে কেন্দ্র করে বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন। তাছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষ বিশেষ আঞ্চলিক ঐতিহ্য, আঞ্চলিক উৎসব-অনুষ্ঠান বহু পর্যটককে আকর্ষণ করে। প্রতিটি রাজ্যের নির্দিষ্ট পর্যটন দপ্তরের অধীনে সেখানকার বিশেষ বিশেষ জায়গা, ঐতিহ্যবাহী, ঐতিহাসিক স্থান, আধ্যাত্মিক স্থান, মন্দির-মসজিদ সবই রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এছাড়াও নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র, ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলাও ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই লক্ষ্যে ভারতের প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ইতিহাসকে রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং ইতিহাসের উজ্জ্বল দিকগুলিকে তুলে ধরে প্রচার করার মাধ্যমেই পর্যটন শিল্প আরও উন্নত হয়ে উঠবে। ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরে ভারতের পর্যটন শিল্প সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এই বিশেষ দিনটি পালিত হয়।
২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ‘আজাদি কা অম্রুত মহোৎসব’ শিরোনামে পর্যটন বিভাগের চেয়ারম্যান অরবিন্দ সিং এবং অন্যান্য পার্ষদদের মধ্যে একটি সম্মেলন হয় যেখানে পর্যটন বিভাগের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব পালনের পরিকল্পনা আছে। দুবাইয়ের ‘ইণ্ডিয়া এক্সপো ২০২০’তে ভারতীয় প্যাভেলিয়ানে দীর্ঘ পনেরো দিন ধরে এই বিশেষ দিন পালনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কেরালা পর্যটন দপ্তর ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’ এই শিরোনামে ভারতের পর্যটনের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে এই দিনটি পালন করেছে। তাছাড়া অন্যান্য রাজ্যও বিশেষ বিশেষ শিরোনাম (Tag line) স্থির করেছে এই বিশেষ দিনটি পালনকে ঘিরে। মধ্যপ্রদেশের বিজ্ঞাপনী বার্তা ছিল – ‘রং হ্যায় মলং হ্যায়’, ওড়িশা পর্যটনের বিজ্ঞাপনী বার্তা ছিল ‘অসাধারণ ভারতের আত্মা’, গুজরাতের পর্যটন বিভাগ ‘খুশবু গুজরাট কি’ এই বার্তা নিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালিয়েছে। তাছাড়া জাতীয় পর্যটন দিবসকে ঘিরে নানাবিধ সেমিনার, সভা, জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান আয়োজিত হয় ভারত জুড়ে।
প্রতিবছরই এই দিনটি পালনের কিছু প্রতিপাদ্য বা থিম থাকে। ২০২১ সালের থিম ছিল -‘নিজের দেশ দেখো’ (Dekho Apna Desh)। ২০২২ সালের থিম – ‘জাতীয় পর্যটন দিবস একটি গ্রামীণ এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক পর্যটন।’ (National Tourism Day is Rural and Community Centric Tourism)
2 comments