বঙ্গদেশে পর্তুগিজ

বঙ্গদেশে পর্তুগিজ

ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগিজরাই প্রথম ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। ১৪৪৫ খ্রিস্টাব্দে হালকা ও দ্রুতগামী জাহাজের তৈরী ও ১৪৫৬ খ্রিস্টাব্দে অক্ষাংশ নির্ণয়ে কৌণিক উচ্চতা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহারে পর্তুগিজদের দক্ষতা তাদের সমুদ্রযাত্রায় যথেষ্ট সহায়তা করে। ভাস্কো দা গামা প্রথম পর্তুগীজ যার নেতৃত্বে পর্তুগিজরা কালিকট বন্দরে জাহাজ নোঙর করাতে সমর্থ হয়। ভাস্কো দা গামার এই অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রিন্স অঁরি দ্য নেভিগেটর। তখন থেকেই উপমহাদেশে পর্তুগিজ প্রভাবের শুরু।

ভাস্কো দা গামার ভারতবর্ষে আগমনের কয়েক দশকের মধ্যেই বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে। প্রথম পরোক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয় ১৫১২-১৩ খ্রিস্টাব্দে। ধারণা করা হয় বাংলায় পর্তুগিজদের আগমন ঘটে সুলতান হুসেন শাহের শাসনামলে। ফ্লোরেন্সের বণিক, গিওভান্নি ডি এম্পলি কর্তৃক প্রেরিত পর্তুগিজ বণিক যোয়াও কোয়েলহো ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে গঙ্গায় এসে পৌঁছান। এটিকেই বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের সূচনা বলে ধরে নেওয়া যায়।

পর্তুগিজদের বাংলায় আগমনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্যবসা। শান্তিপূর্ণ না হয় জোরজবরদস্তি, যেভাবেই হোক না কেন ব্যবসার প্রসারই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। বলা হয়ে থাকে রোমান মেয়েদের নিকট ঢাকাই মসলিন ছিল এক বহু আকাঙ্খিত বস্তু। এছাড়া সুজলাসুফলা বাংলায় মসলাসহ নানা পণ্যের উৎপাদন ছিল প্রচুর। আরব বণিকরা এসব পণ্যের চালান দিত ভেনিস জেনোয়া ইত্যাদি বন্দরে। তাদের ব্যবসায় ভাগ বসানোই ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলায় উৎপন্ন পণ্যের বিপণনের জন্য পূর্বে ও পশ্চিমে গড়ে উঠেছিল দুটি প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। পূর্বে ছিল চট্টগ্রাম এবং পশ্চিমে সপ্তগ্রাম। পর্তুগিজরা মূলত এ দুটি কেন্দ্র থেকেই ব্যবসা করত।

চট্টগ্রামের নাম তারা দিয়েছিল ‘পোর্ট-গ্রান্ডী’, যার অর্থ বড় স্বর্গ। সপ্তগ্রামের নাম তারা দিয়েছিল ‘পোর্ট-পিকানো’, যার অর্থ ছোট স্বর্গ। তখনকার বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়।

১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হুগলী  নদীর তীরে বসতি স্থাপনের জন্য পর্তুগিজদের অনুমতি প্রদান করেন। পর্তুগিজরা তাদের বসতিকে বলত Porto Pequeno। ষোড়শ শতকে জায়গাটি প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে ওঠে।

প্রথম প্রথম পর্তুগিজদের ব্যবসার মূল সময়কাল ছিল বর্ষাকাল। বর্ষা শেষে তারা চলে যেত তাদের প্রধান আস্তানা পশ্চিম ভারতের গোয়ায়।

তৎকালীন ঐতিহাসিক বর্ণনামতে জানা যায় পর্তুগিজরা বিলাসী জীবনযাপন করত। তারা নবাবদের মত পোশাক-আশাক পরিধান করত, তাদের বাড়িতে দাস-দাসী থাকত প্রচুর। তাদের মূল কাজ ছিল আম, কমলা লেবু থেকে মিষ্টান্ন তৈরী করা। পর্তুগিজ ময়রারা কেক পেস্ট্রি ইত্যাদি পদ তৈরী করত। ঐতিহাসিকদের মতে দুধ থেকে ছানা তৈরীর প্রক্রিয়াটি পর্তুগিজদের কাছ থেকে আয়ত্ত করে বঙ্গবাসী।

তাছাড়া আমাদের দৈনন্দিন খাবারের অনেক উপকরণ পর্তুগিজদের অবদান। আনারস (পর্তুগীজ ভাষায় ‘আনানাস’), গোল আলু, মরিচ বা লঙ্কা, ঢেঁড়স, কামরাঙ্গা, কাজু বাদাম পর্তুগিজরাই প্রথম বঙ্গদেশে এনে চাষ শুরু করেছিল। বাঙালীর তামাক খাওয়াও শুরু হয় তাদের দেখাদেখি। এ নিয়ে পুঁথিও রচিত হয়েছে, বাংলায় যার নাম, ‘তামাকু মাহাত্ম’।

১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় পর্তুগীজ বংশোদ্ভুত ছিল প্রায় ২০ হাজার, যদিও এর মধ্যে মাত্র ৩০০ জনের মত ছিল বিশুদ্ধ। এর কারণ হিসেবে বলা চলে পর্তুগিজরা শুরু থেকেই স্থানীয় মহিলাদের বিয়ের ব্যপারে আপত্তি করেনি।

পর্তুগিজদের বাংলা আগমনকালে এখানকার শাসকরা ছিল মুসলিম। প্রধানত দুই ধর্মের মানুষের বাস ছিল তৎকালীন বঙ্গদেশে, হিন্দু এবং মুসলিম। পর্তুগিজরাই প্রথম বাংলার মাটিতে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার শুরু করে। তারা বিশ্বাস করত, খ্রিষ্টধর্মের প্রচারে সহযোগিতা করলে তাদের পূণ্য হবে এবং এর পাশাপাশি নিজের দেশ থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাও পাওয়া যাবে। তারা চট্টগ্রাম, বরিশাল, হুগলী, আরাকান সহ সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার দরিদ্র মানুষদেরকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করত। এমনকি মোঘল রাজদরবারেও ছিল তাদের প্রবেশাধিকার। সম্রাট আকবর পর্তুগিজ পাদ্রীদের নিকট থেকে খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপারে জানতেন। সমুদ্র তীরবর্তী স্থান থেকে শত মাইল দূরেও তারা ধর্ম প্রচারে চলে যেতেন। এমনকি তারা তৎকালীন সময়ে কয়েকজন বাঙালি জমিদারকেও খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন বলে জানা যায়।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে বেশ কিছু পর্তুগিজ শব্দ পাওয়া যায়। যেমন –আলমারি, চাবি, বালতি, বোতল, বারান্দা ইত্যাদি। পর্তুগিজ ভাষা এদেশে এতটা প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে লর্ড ক্লাইভ পর্যন্ত অনর্গল পর্তুগিজ বলতে পারতেন।

বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ লিখেছেন পর্তুগিজ পাদ্রী মনোএল দ্য আসসম্পুসাঁউ ।

১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রোমান হরফে তিনটি বাংলা বই বের হয়। সেগুলি হল, ব্রাহ্মন-রোমান ক্যাথোলিক সংবাদ, কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ এবং বাংলা ও পর্তুগিজ ভাষার শব্দ ও ব্যাকরণ। প্রসঙ্গত এখনও অব্দি প্রাপ্ত বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’  পর্তুগিজদের হাত ধরেই প্রকাশিত।

পর্তুগিজ সাধুরা অনেকেই এদেশের মানুষের সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছিলেন। তেমনই একজন সেইন্ট জেভিয়ার্স (১৫০৬ – ১৫৫২)। মহৎপ্রাণ এই সাধুর জীবনের আদর্শ ছিল ধর্ম। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজ তাঁর প্রতি সম্মানের নিদর্শন ।

আরেক পর্তুগিজের কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন এন্টনি ফিরিঙ্গি (১৭৮৬ – ১৮৩৬)। তাঁর আসল নাম ‘হ্যান্সম্যান এন্থনি’। তিনি ছিলেন কবিয়াল, বাংলা ভাষার প্রথম ইউরোপীয়ান কবিয়াল। সৌদামিনি নামে একজন বাঙালি ব্রাহ্মন মহিলাকে সতীদাহের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিয়ে করে তিনি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় গানটি হল – ‘সাধন ভজন জানিনে মা,জেতে তো ফিরিংগি’।

আগমনকাল থেকেই পর্তুগিজরা ছিল আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন। আর নদ-নদী বিধৌত বঙ্গদেশের মানুষ ছিলেন অনেকটাই নিরীহ এবং যুদ্ধবিমুখ। এই সুযোগে পর্তুগিজরা অবাধে গ্রামগুলোতে ঢুকে লুটতরাজ করত এবং নারী, শিশু ও সমর্থ যুবকদের দাস হিসেবে নিয়ে যেত। পর্তুগিজ নাবিকরা হার্মাদ বা জলদস্যুতে পরিণত হল কিভাবে এবং তাদের অত্যাচার সম্পর্কে বিশদে জানতে এখানে দেখুন।

পরবর্তীকালে ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের সাথে ব্যবসায় টিকতে না পেরে পর্তুগিজ বণিকেরা ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে চলে যান। ১৭৩৩ সালে ইংরেজরা পর্তুগিজদের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক না রাখার জন্য তাদের কর্মচারীদের নির্দেশ দেয়। তারপরও হুগলীতে ১৭৪০ সালে পর্তুগিজ বাণিজ্যিক জাহাজ আগমনের নথিপত্র পাওয়া যায়, যা থেকে মনে করা হয়ে থাকে পর্তুগিজরা বাংলায় আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাণিজ্য করে গেছে। তবে মুঘলদের পাল্টা আক্রমণে তাদের দস্যুবৃত্তি চিরতরে বঙ্গদেশের বুক থেকে লোপ পায়।

পর্তুগিজরা চলে গেছে আজ অনেকদিন। কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যে ও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে আজও রয়ে গেছে তাদের বিভৎসতার ইতিহাস। প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের সাথে বাংলার মানুষের স্মৃতি বিভীষিকার এবং ঘৃণার।

তথ্যসূত্র


  1. হিস্টরি অব দ্য পর্তুগিজ ইন বেঙ্গল, জোয়াকিম জোসেফ এ. ক্যাম্পোস, অনুবাদক: শানজিদ অর্ণব, দিব্য প্রকাশ
  2. http://itibritto.com/portuguese-in-bengal

আপনার মতামত জানান