নবদ্বীপ

নবদ্বীপ

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত নদীয়া জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ হল নবদ্বীপ। নবদ্বীপ শহরটি নবদ্বীপ মিউনিসিপ্যালিটির অধীনস্থ একটি জনপদ। নবদ্বীপের এক অংশ আবার গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন।

নবদ্বীপ জনপদটি ভৌগোলিক বিচারে ২৩.৮২ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৩৭ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে এই জনপদটি অবস্থিত। তবে আগে এমনটা ছিল না। ভাগীরথী বয়ে যেতো নবদ্বীপের পূর্ব দিক দিয়ে। ভূমিকম্পের ফলে নদীর প্রবাহপথের বদল ঘটেছে। ভাগীরথীর সঙ্গে আগে জলঙ্গী নদী এক স্রোতে মিশে বয়ে যেতো নবদ্বীপের পাশ দিয়ে। মহেশগঞ্জ-গাদিগাছার উত্তর সীমায় জলঙ্গীর সঙ্গে ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে। বারে বারে ভাগীরথীর গতি পরিবর্তনের ফলে নবদ্বীপে বহু খাল-বিল দেখা যায়। এই কারণে লোকশ্রুতিতে নবদ্বীপকে বলা হয় ‘বাঁশ-বাসক ডোবা, তিন নদের শোভা’।

নবদ্বীপ নামের উৎস ঠিক কোথা থেকে তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মিনহাজউদ্দিন সিরাজের লেখায় এই জনপদকে ‘নওদিয়ার’ বলা আছে যার অর্থ হল নতুন দেশ। আবার কবি কর্ণপুরের লেখা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ বইতে নবদ্বীপকে বলা হয়েছে নবীন দ্বীপ। অনেকে আবার মনে করেন গঙ্গার পাড়ে যে চরভূমি ছিল সেখানে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী রোজ নয়টি প্রদীপ জ্বালিয়ে সাধনা করতেন। প্রদীপকে তখন ‘দিয়া’ বলা হতো। লোকের বিশ্বাস যে এই ‘নয়দিয়া’ থেকেই নাকি নবদ্বীপ নামের উৎপত্তি হয়েছে। এমনকি বহু মানুষ নদীয়া এবং নবদ্বীপকে একই নাম থেকে জাত বলে মনে করেন। আবার অন্য জনশ্রুতি অনুযায়ী গঙ্গার মধ্যে একটি চর ছিল যা গঙ্গার গতিপথ বদলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে আকারে বড়ো হতে থাকে এবং একসময় সেখানে জনবসতি গড়ে ওঠে। সেই থেকেই নতুন দ্বীপ বা নবদ্বীপের উৎপত্তি। কৃত্তিবাসের রামায়ণে প্রথম নবদ্বীপ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে নরহরি চক্রবর্তী তাঁর ‘ভক্তি রত্নাকর’ গ্রন্থে নবদ্বীপকে নয়টি দ্বীপের সমষ্টি বলে মনে করেছেন। এই নয়টি দ্বীপ হল – অন্তরদ্বীপ, সীমান্তদ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ, মধ্যদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, ঋতুদ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ, মোদাদ্রুমদ্বীপ, কোলাদ্বীপ। এই সব মতামত, জনশ্রুতি একইভাবে সত্য এবং ভ্রান্ত হতেও পারে।

নবদ্বীপের ইতিহাস অনেক বিস্তৃত। এই জনপদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেমন চৈতন্যদেবের স্মৃতি, তেমনই সুদূর অতীতে সেন বংশ ও পাল বংশের রাজত্বকালের সাক্ষী থেকেছে এই জনপদ। মোটামুটিভাবে জানা গেছে ১০৬০ সালে এই জনপদের পত্তন ঘটে। ঐতিহাসিক জন ক্লার্ক মার্শম্যান নবদ্বীপকে আদিশূরের রাজধানী বলে চিহ্নিত করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর লেখাপত্রের মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে ভাগীরথী তীরবর্তী এই নবদ্বীপ শহরেই একসময় সেন বংশের রাজা সামন্ত সেন বাস করতেন। লক্ষণসেন ও বল্লাল সেনের রাজত্বকালে নবদ্বীপ ছিল সেনদের রাজধানী। এখনও বল্লালঢিপি দেখা যায় নবদ্বীপের বামনপুকুর অঞ্চলে। শূর বংশ এবং সেন রাজাদের আমলে এই নবদ্বীপ হয়ে উঠেছিল বাংলার এক অন্যতম বিদ্যাপীঠ। শ্রীধরভট্ট, উদয়নাচার্য, হলায়ুধ, শূলপাণি, ধোয়ী, জয়দেব গোস্বামী প্রমুখ বিখ্যাত পণ্ডিতদের উল্লেখ পাওয়া যায় সেই সময় যারা নবদ্বীপে বসেই তাঁদের বিদ্যাচর্চা করেছিলেন। রঘুনাথ শিরোমণির নেতৃত্বে এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম নবদ্বীপ-ন্যায়ের ধারণা এবং প্রতিষ্ঠান। বাসুদেব সার্বভৌম, রত্নাকর বিদ্যাবাচস্পতি প্রমুখ পণ্ডিতেরা নবদ্বীপ ন্যায় বিদ্যালয় স্থাপন করেন এই জনপদে। সময়টা ষোড়শ শতক। অন্যদিকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের নেতৃত্বে তন্ত্রশাস্ত্র ও তন্ত্রচর্চার বিস্তার হয়েছিল নবদ্বীপে। সবথেকে বড়ো ইতিহাস জড়িয়ে আছে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে। তাঁর আবির্ভাবের ফলেই নবদ্বীপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈষ্ণব ধর্ম। নবদ্বীপের তৎকালীন শাসক চাঁদ কাজী বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণে বাধা দিলে শ্রীচৈতন্য কাজীর বাড়ি গিয়ে কাজী দলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটান। তবে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে নবদ্বীপের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও তাঁর জন্ম নবদ্বীপে নাকি মায়াপুরে এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর মতে, ভাগীরথীর বর্তমান প্রবাহপথের মধ্যেই চৈতন্যের জন্মস্থান ছিল এবং ১৭৭৭ থেকে ১৭৮২ সালের মধ্যে ভাগীরিথীর দিক পরিবর্তনের ফলে তা জলের গভীরে তলিয়ে গেছে। বুনো রামনাথের মতো বিরাট মাপের নৈয়ায়িক অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই নবদ্বীপেই শিক্ষাবিস্তার করেছেন।

নবদ্বীপের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথমেই শ্রীচৈতন্যদেবের নাম করতে হয়। তাছাড়াও আছেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, উমাপতিধর, ধোয়ী, স্মার্ত রঘুনন্দন, রঘুনাথ শিরোমণি, প্রসন্নচন্দ্র ন্যায়রত্ন প্রমুখ সব বিখ্যাত পণ্ডিত।

একসময় বঙ্গ-সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই নবদ্বীপ। বাংলার বিদ্যাচর্চার ধারা এখানে বহমান ছিল নিয়ত। বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্ররা এখানে পড়তে আসতো। বৃন্দাবন দাসের লেখা থেকে অগণিত ছাত্রের কথা জানা যায় যারা নবদ্বীপে পড়াশোনা করতেন। প্রাচীনকালে এখানে টোলের মাধ্যমে শিক্ষাদান প্রথা চালু ছিল। বহু টোল খোলা হয়েছিল সেই সময়। প্রসন্নচন্দ্র তর্করত্ন ‘পাকটোল’ নামে যে বিদ্যালয় খোলেন তা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সময়। বর্তমানে আঠারোটি উচ্চ বিদ্যালয়ের মধ্যে নবদ্বীপ বকুলতলা উচ্চ বিদ্যালয়, নবদ্বীপ হিন্দু স্কুল, নবদ্বীপ শিক্ষা মন্দির, তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়।

নবদ্বীপে একইসঙ্গে গড়ে উঠেছে শাক্ত সংস্কৃতি এবং বৈষ্ণব সংস্কৃতি। বহু প্রাচীনকাল থেকে তন্ত্রসাধনার অন্যতম পীঠস্থান নবদ্বীপে প্রথম আগমেশ্বরী দক্ষিণা কালীর পূজা শুরু করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। শাক্তদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন মা পোড়ামা এবং এই শাক্ত পরিমণ্ডলকে কেন্দ্র করে নবদ্বীপের সবথেকে প্রাচীন শাক্তরাস উৎসব গড়ে উঠেছে। এই শাক্ত রাস উৎসবে কার্তিক পূর্ণিমায় বিভিন্ন দেব-দেবীর বিশাল মূর্তি নির্মাণ করিয়ে শক্তির উপাসনা করা হয়। কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই উৎসব খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শক্তি সাধনার পাশাপাশি বৈষ্ণব সংস্কৃতিও এখানে লক্ষণীয়। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবেই নবদ্বীপ রথযাত্রা উপলক্ষে কুড়ি-পঁচিশটি রথ বেরোয়। অদ্ভুতভাবে এখানে রথের বিগ্রহে জগন্নাথের পূর্ণ হাতটি দেখা যায় যা সচরাচর আর কোথাও দেখা যায় না। এছাড়াও চন্দনযাত্রা, গাজন উৎসব, দোল পূর্ণিমা, ঝুলন পূর্ণিমা, গুরু পূর্ণিমারও প্রচলন আছে এই নবদ্বীপে। নবদ্বীপের একটি অপ্রচলিত উৎসবের মধ্যে পড়ে ‘ধুলোট’ যা আসলে তেরো দিন ব্যাপী কীর্তনিয়াদের একটি সম্মেলন।

নবদ্বীপের মিষ্টি দই, ক্ষীরের সন্দেশের খ্যাতি গোটা বাংলায় খ্যাত। সেই চৈতন্যদেবের আমল থেকে পরমেশ্বর মোদক, কালীপদ মোদকের নাম জানা যায় যারা নবদ্বীপের বিখ্যাত মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। আর আছে তাঁতের শিল্প। নবদ্বীপের তন্তুবায়দের হাতে তৈরি জামদানী শাড়ির কদর রয়েছে বেশ। ব্রিটিশ শাসনকালেই ঢাকা থেকে বহু তাঁতি এখানে এসে বসবাস শুরু করেন এবং তার পাশাপাশি জামদানী ও টাঙ্গাইল শাড়ির বয়ন শুরু করেন। নবদ্বীপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কুটির শিল্প হিসেবে বস্ত্রশিল্পের খ্যাতি আজও বহমান। নবদ্বীপের মানুষেরা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন মূলত শাঁখা শিল্প, মৃৎ শিল্প, মিষ্টান্ন প্রস্তুত, স্বর্ণ শিল্প ইত্যাদির মাধ্যমে। এখানকার কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্রের কারুকার্যখচিত শিল্প বিখ্যাত। এখানকার কাঁসারিপাড়ায় এককালে সকল কাঁসারী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। পিতলের সিংহাসন, প্রদীপ, আমের সরা, ফুলসাজি ইত্যাদি পিতলের ও কাঁসার জিনিস নির্মাণে নবদ্বীপের কাঁসারীদের দক্ষতা তুঙ্গে। নবদ্বীপের শ্রীবাসঅঙ্গণ, ওলাদেবীতলায় শাঁখা নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠেছে ঘরে ঘরে। তাছাড়া তুলসীমালা তৈরি, মৃদঙ্গ-খোল তৈরির কাজেও নবদ্বীপের শিল্পীদের জুড়ি মেলা ভার।

শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব মিশেলে গড়ে ওঠা নবদ্বীপ জনপদ বর্তমানে হেরিটেজের আখ্যা পেয়েছে। অনেকে আবার নবদ্বীপকে মন্দিরনগরীও বলে থাকেন। নবদ্বীপের মহাপ্রভু পাড়ায় অবস্থিত ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দির, পোড়ামাতলায় মা ভবতারিণী ও পোড়ামা কালীর মন্দির, ভবতারণ শিবমন্দির, মালঞ্চপাড়ায় বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর জন্মস্থান, নবদ্বীপ মণিপুর রাজবাড়ি, বুড়ো শিব মন্দির এগুলি সবই এখানকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এছাড়াও আছে সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির, আগমেশ্বরী কালী মায়ের মন্দির, শ্রীবাস অঙ্গন, নিতাইবাড়ি, বুনো রামনাথের বাড়ি, রানি রাসমণির কাছারিবাড়ি, গোরাচাঁদের আখড়া এ সবই প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। নবদ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী পোড়ামার নামে বিখ্যাত পোড়ামাতলা অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে পড়ে। বুড়ো শিব মন্দিরে গেলে চোখে পড়বে নবরত্ন মন্দির নির্মাণের অপূর্ব শৈলী।

হেরিটেজের আখ্যা পেলেও সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে বহু ঐতিহ্যবাহী মন্দির। অযত্নে আর অবহেলার ধুলোয় ঢেকে গেছে নবদ্বীপের ইতিহাসে মোড়া অলি-গলি।

2 comments

আপনার মতামত জানান