একাধারে বিখ্যাত প্রাচ্যবিশারদ, সাহিত্য সমালোচক, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সিংহল ও ভারততত্ত্ববিদ প্রবোধচন্দ্র বাগচী (Prabodh Chandra Bagchi)। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য ছিলেন তিনি। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত ‘ভারত ও চিন’ নামে তাঁর লেখা গবেষণামূলক বইটি আজও সমানভাবে তাঁর সুগভীর পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়। ফরাসী, ইংরেজি ও বাংলা এই তিন ভাষাতেই বহু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী।
১৮৯৮ সালের ১৮ নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের মগুরা জেলায় প্রবোধচন্দ্র বাগচীর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হরিনাথ বাগচী এবং মায়ের নাম তরঙ্গিনী দেবী। খুব ছোটোবেলাতেই তিনি তাঁর মাকে হারান। পরবর্তীকালে ১৯৬৬ সালে পাবনার রায়সাহেব তারকনাথ মৈত্র এবং হেমাঙ্গিনী দেবীর কন্যা পান্নারানি দেবীকে বিবাহ করেন তিনি। তাঁদের একটিমাত্র পুত্র প্রতীপ এবং পাঁচ কন্যা যথাক্রমে চিত্রা, কৃষ্ণা, গোপা, রত্না ও ইন্দ্রাণী।
মগুরা জেলার শ্রীকোলে একটি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্রবোধচন্দ্র বাগচীর। শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। ১৯১৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি এবং তারপরে ১৯১৮ সালে সংস্কৃতে সাম্মানিকসহ কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার জন্য মোহিনী মোহন রায় পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। শুধুমাত্র ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস জানবেন বলে গণিতে মেধা থাকা সত্ত্বেও সংস্কৃত বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন প্রবোধচন্দ্র। প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সামগ্রিকভাবে প্রথম হওয়ার পাশাপাশি ধর্ম বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন প্রবোধচন্দ্র।
স্যার আশুতোষ মুখার্জীর আহ্বানে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা শেষ করার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই লেকচারার পদে পড়াতে শুরু করেন তিনি। প্রাচীন ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করা দরকার বলে মনে করতেন তিনি এবং বিশেষ করে ভারতের বহুস্তরীয় ইতিহাসকে পুনর্বিন্যস্ত করতে গেলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বৃহত্তর এশীয় দৃষ্টিকোণ। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিমুরা ও মাসুদার কাছে চিনা এবং অধ্যাপক তারাপুরওয়ালার কাছে জাপানি ভাষা শিখতে শুরু করেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী। প্যারিসের সরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও ভারতীয় সংস্কৃতির অধ্যাপক সিলভিয়ান লেভির কাছে চিনা ও তিব্বতি ভাষা শেখার জন্য আশুতোষ মুখার্জী প্রবোধচন্দ্রকে নিযুক্ত করেন। সেই সময় সিলভিয়ান লেভি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ এবং সিলভিয়ান লেভি দুজনেই প্রবোধচন্দ্রকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেন যাতে তিনি বিভিন্ন ভাষা শিখে ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে পুনর্বিন্যস্ত করার জন্য ঐতিহাসিক উপাদানের একেবারে প্রাথমিক উৎসগুলির পাঠোদ্ধার করতে পারেন। ১৯২২ সালে নেপালে সিলভিয়ান লেভি ও মাদাম লেভিকে সহায়তা করেন নেপালের রয়্যাল দরবার লাইব্রেরিতে ভারতীয় ইতিহাসের একেবারে প্রাচীন পুঁথিগুলিকে খুঁজে বের করতে। প্রাচীন সংস্কৃত রচনাগুলি হারিয়ে গেলেও তিব্বতি ও চিনা অনুবাদে নিশ্চিতভাবে কোথাও না কোথাও রয়ে যাবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস ছিল। প্রথমবারের সন্ধানে প্রবোধচন্দ্র বাগচীর হাতে উঠে আসে ‘কৌল-জ্ঞান-নির্ণয়’ এবং ‘সম্মোহ তন্ত্র’ নামক দুটি তালপাতার পুঁথি যেগুলি প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধযুগ পরবর্তী সময়ে শাক্ত ধর্মাচারণের ইঙ্গিতবাহী। ঐ বছরই এক বছরের জন্য ‘রাসবিহারী ঘোষ ভ্রমণ বৃত্তি’ পান তিনি এবং এই সুযোগে চিন, জাপান, কম্বোডিয়া, লাওস, জাপান ঘুরে ফেলেন। সিলভিয়ান লেভি, লুইস ফিনট, জর্জ গ্রসলিয়ার, হেনরি মার্শাল, হেনরি পারমেনশিয়ার প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান প্রবোধচন্দ্র বাগচী। তাঁদের সঙ্গে একত্রে আঙ্কোরভাটের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস খুঁজতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ও আবিষ্কার কর্মের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারেন তিনি। হ্যানয়-এ ছিলেন প্রবোধচন্দ্র এবং তিনি সেখানে অধ্যাপক ঔরোশিয়ানের চিনা ভাষাশিক্ষার ক্লাসগুলি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন। জাপানের কোয়শিয়ান মঠে থাকাকালীন প্রবোধচন্দ্র বহুলভাবে উপকৃত হন। ১৯২৩ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার জন্য কিছু বছর ফ্রান্সে কাটিয়ে আসেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে তিনি সিলভিয়ান লেভির সঙ্গে সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্যিক নিদর্শনের উপর কাজ করেছেন, পল পেলিয়টের সঙ্গে মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় সভ্যতার প্রমাণ খোঁজার কাজে সঙ্গী ছিলেন, চিনে হেনরি মাসপেরোর সঙ্গে বৌদ্ধ সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। এছাড়া জুলস ব্লচের সঙ্গে প্রাচীন পালি সাহিত্য এবং অ্যান্টনি মেলিয়েটের সঙ্গে যৌথভাবে অবস্তী গাথা সম্পর্কে বহু গবেষণা করেছেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে স্টেট ডক্টরেটের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
১৯২৬ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণা করেন তিনি। ১৯২৯ এবং ১৯৩০ সালে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, চর্চাপদ, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য এবং দোহাকোষ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে আবার নেপালে পাঠানো হয়। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমার সেনের সঙ্গে মিলিতভাবে একটি আলোচনাচক্র গড়ে তোলেন যেখানে মূলত তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বিশদে আলোচনা হতো। ১৯৩৮ সালে ইণ্ডিয়ান লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটির সঙ্গে ফিলোলজিকাল সোসাইটি একত্রে মিলে যায় যার সম্পাদক হন ড. সুকুমার সেন এবং কোষাধ্যক্ষ হন ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী। তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে এক সময় বহু বুদ্ধিজীবী ও তাত্ত্বিকদের আড্ডা বসতো। ‘পরিচয়’ গোষ্ঠীর হিরণকুমার সান্যাল, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখরা তাঁর বাড়িতেই জড়ো হতেন বিভিন্ন আলোচনার জন্য। সরোজিনী নাইডু, প্রমথনাথ চৌধুরীও এই সভায় মাঝেমধ্যে উপস্থিত থাকতেন।
বহু জনসভা ও সমাবেশে তিনি সভাপতিত্ব করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। ১৯৩৭ সালে রংপুরে দিব্য মেমোরিয়াল কনফারেন্স, ১৯৩৯ সালে আসামের গৌহাটি, বর্মার রেঙ্গুনে আয়োজিত বৃহত্তর বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে এবং ১৯৪৬ সালে আলিগড়ের ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস আর নাগপুরের অল ইণ্ডিয়া ওরিয়েন্টাল কনফারেন্সে মননঋদ্ধ বক্তব্য রেখেছিলেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী। ১৯৪৫ সালে চিন সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাইনিজ কালচারাল স্টাডিজ স্কিম’-এর অধীনে ডিরেক্টর অফ রিসার্চ স্টাডিজ পদে নিযুক্ত হন তিনি। তাছাড়া পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার প্রফেসর পদে তিনি দুই বছর কর্মরত ছিলেন। চিন থেকে ফিরে বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের দায়িত্ব হাতে নেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী। ইকোল ফ্রান্সিস ডি এক্সট্রিম ওরিয়েন্ট-এর তরফে প্রাচ্যতত্ত্বে গভীর গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে সাম্মানিক ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯৪৯ এবং ১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমচন্দ্র বসু মল্লিক অধ্যাপক হিসেবে বহু বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। এই সব বক্তৃতাগুলির বিষয় ছিল প্রাচীন মধ্য এশিয়ায় আর্যদের অভিবাসন, তোখারিস্তান এবং পূর্ব ইরানের সম্পর্কের ইতিহাস, চাইনিজ তুর্কিস্তানের প্রাচীন জনপদ, মধ্য এশিয়ায় ভারতীয় হরফের ব্যবহার ইত্যাদি। ১৯৫৫ সালে এই বক্তৃতাগুলি একত্রে সংকলিত হয়ে দুই মলাটের মধ্যে প্রকাশিত হয় যাদবপুরের ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের পক্ষ থেকে যার নাম ‘ভারত ও মধ্য এশিয়া’। ১৯৫২ সালে শ্রীমতি বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের নেতৃত্বে স্বাধীন ভারতের পক্ষ থেকে প্রথম অতিথি হিসেবে চিনে সফর করেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী।
১৯৫৪ সালে প্রবোধচন্দ্র বাগচী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য হন এবং তিনিই ঠাকুর পরিবারের বহির্ভূত কোনো ব্যক্তি হিসেবে প্রথম উপাচার্য ছিলেন। মানবীবিদ্যার অঙ্গ হিসেবে বিশ্বভারতীর ইন্দোলজি বিভাগকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন তিনি। শ্রীনিকেতনের প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রমে প্রায়োগিক বলবিদ্যা এবং ধাতব কাজের প্রায়োগিক শিক্ষার অংশ দুটি সংযোজন করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতীর সিনো-ইণ্ডিয়ান স্টাডিজ বিভাগের বার্ষিক পত্রিকা এবং সমস্ত জার্নালগুলি তিনি নিজে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিতেন, প্রয়োজনে সম্পাদনার কাজও করতেন।
ফরাসী, ইংরেজি ও বাংলা এই তিন ভাষাতেই বহু গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী। তাঁর বাংলায় লেখা ‘বৌদ্ধধর্ম ও সাহিত্য’, ‘ভারত ও ইন্দোচিন’, ‘ভারত ও মধ্য এশিয়া’, ‘ভারত ও চিন’ ইত্যাদি বইগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দুর্লভ। এছাড়াও বহু প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি পত্র-পত্রিকার পাতায়।
তাঁর স্মরণে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি জ্যোতিভূষণ চাকীর সম্পাদনায় তাঁর প্রবন্ধ সমগ্র প্রকাশ করে আর তার পাশাপাশি ‘প্রবোধচন্দ্র বাগচী’ নামে একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করে। রত্না সিন্হা, অধ্যাপক কল্যাণ কুমার সরকার, অধ্যাপক সুনীতি পাঠক, অধ্যাপক হরপ্রসাদ রায় এবং অধ্যাপক বি.এন. মুখার্জি একত্রে মিলে এই বইটি রচনা করেছিলেন।
১৯৫৬ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মৃত্যু হয়।