মোহান্ত-এলোকেশী মামলা ।। তারকেশ্বর হত্যা মামলা

মোহান্ত-এলোকেশী মামলা।। তারকেশ্বর হত্যা মামলা

আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের বাংলায় বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ও অশ্লীলতার জন্য যে মামলা তথা ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলা জুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল তা মোহান্ত-এলোকেশী মামলা যার অপর নাম তারকেশ্বর হত্যা মামলা(Mohanto-Elokeshi-case-tarakeshwar-murder-case)। উনবিংশ শতকের বাংলার এক পারিবারিক কলঙ্কের খতিয়ান এঁকে দিয়েছিল এই মামলা যা পরবর্তী বেশ কয়েক দশক ধরে জনশ্রুতি ও গণমাধ্যমের এক লোভনীয় বিষয় হয়ে উঠেছিল। একটি খুন আর ব্যাভিচার জড়িয়ে রয়েছে এই মামলার কাহিনিতে, তাই এই কাহিনির উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল অজস্র বটতলার বই। বটতলার বইয়ের সহস্রাধিক পাঠকের মুখে মুখে আলোচনার কেন্দ্রে তখন একমাত্র ঘটনা হয়ে উঠেছিল এই মোহান্ত-এলোকেশী মামলা তথা তারকেশ্বর হত্যা মামলা। নানাবতী বনাম মহারাষ্ট্র মামলার মত এই মামলার ক্ষেত্রেও জনরোষের চাপে পড়ে আদালত মামলার রায় সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ব্রিটিশ সরকারের একজন কর্মচারী নবীনচন্দ্রের স্ত্রী এলোকেশী আর তারকেশ্বর শিব মন্দিরের প্রধান ব্রাহ্মণ তথা মোহান্তের মধ্যে বিবাহ-বহির্ভূত এক ব্যাভিচারী সম্পর্কের কারণে নবীনচন্দ্র নিজের হাতেই তাঁর স্ত্রীর শিরশ্ছেদ করেন। ১৮৭৩ সালে এই হত্যাকাণ্ডকে সামনে রেখে মামলা হুগলি সেশন আদালতে ওঠে এবং প্রথমে মামলার অভিযুক্ত ছিলেন নবীনচন্দ্র দাস। কিন্তু সেই আদালতে জুরিদের রায়ের সঙ্গে সহমত পোষণ না করায় হুগলী সেশন আদালতের বিচারপতি এই মামলাকে কলকাতা উচ্চ আদালতে পুনর্বিচারের জন্য পাঠান। উচ্চ আদালতে এই মামলার মূল অভিযুক্ত ছিলেন তারকেশ্বরের মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরি। তারকেশ্বর হত্যা মামলা আদপে ‘রানি বনাম নবীনচন্দ্র ব্যানার্জি’ নামেই আদালতে রুজু হয়েছিল। এই রানি বলতে রানি ভিক্টোরিয়াকেই বোঝানো হয়েছে। তারকেশ্বর হত্যা মামলায় নবীনচন্দ্রের পক্ষে সওয়াল-জবাব করেছিলেন ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সরকারের পক্ষের উকিল ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র। হুগলি সেশন আদালতে সেই সময় মুখ্য বিচারপতি ছিলেন এইচ টি প্রিন্সেপ। পরবর্তীকালে মামলার দ্বিতীয়বার শুনানির সময় কলকাতা উচ্চ আদালতে সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন জগদানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং বিচারপতি ছিলেন এ জি ম্যাকারসন এবং জি জি মরিম।  

তারকেশ্বরের পার্শ্ববর্তী কুমরুল গ্রামে সাধারণ দরিদ্র যজমান নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের বাস। তাঁর প্রথম পক্ষের কন্যা এলোকেশী এবং দ্বিতীয় পক্ষের কন্যা মুক্তকেশী। আট বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরে অপরূপা এলোকেশীর সঙ্গে কলকাতায় সরকারি ছাপাখানায় কর্মরত কম্পোজিটর নবীনচন্দ্র ব্যানার্জির বিবাহ ঠিক হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই কাটত এলোকেশীর স্বামী নবীনচন্দ্রের। ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাপের বাড়িতেই থাকতে হয় এলোকেশীকে। সপ্তাহান্তে আর ছুটি পেলে নিয়ম করে নবীনচন্দ্র বাড়িতে আসতেন। সন্তানলাভের অনেক চেষ্টা করেও যখন অসফল হলেন তাঁরা, বাধ্য হয়ে নিকটস্থ তারকেশ্বর মন্দিরের তথাকথিত অলৌকিক শক্তিশালী মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরির কাছে সন্তান উৎপাদনের সহযোগী একটি উর্বরতার ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন এলোকেশী। সেই অবসরেই মোহান্ত এলোকেশীকে ধর্ষণ করেন বলেই অভিযোগ ওঠে। শোনা যায় এলোকেশীর বিমাতাই তাঁকে মোহান্তের কাছে যেতে বাধ্য করেছিলেন। অন্যদিকে এও জানা যায় যে নীলকমল মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে তাঁদের জ্যেষ্ঠ কন্যা মন্দাকিনীকেও মোহান্তের কাছে পাঠাতেন, অভাবের সংসারে যাতে ভাত-কাপড়ের কোনও অভাব না ঘটে সেই কারণে। এই সুযোগে মন্দাকিনীর সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন মোহান্ত। তারকেশ্বরের প্রধান মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরি সম্পর্কে সমাজে আগে থেকেই নারীলোলুপতার অভিযোগ ছিলই। নবীনচন্দ্র যখন গ্রামে ফিরে আসেন, গ্রামের মানুষদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া মোহান্ত আর এলোকেশীর সম্পর্কের কথা কানে আসে তাঁর। এমনকি এই অবৈধ সম্পর্কের জের টেনে তাঁকে জনসমক্ষে চূড়ান্ত অপমান করা হয়। এর পরেই সোজাসুজি এলোকেশীকে এই সম্পর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে, মোহান্ত আর তাঁর ব্যাভিচারের কথা স্বীকার করেন এলোকেশী। নবীনচন্দ্র এই কথা শুনে তাঁকে ক্ষমা করে দেন বটে, কিন্তু একইসঙ্গে এলোকেশীকে সঙ্গে নিয়ে তারকেশ্বর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নবীনচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে যারপরনাই ভালোবাসতেন। কিন্তু মোহান্ত এই দম্পতিকে পালাতে দেননি। মোহান্তের ভাড়া করা দুষ্কৃতীরা এলোকেশীর মা-বাবার সহায়তায় তাঁদেরকে আটক করে। রাগে ও ঈর্ষায় নবীন তখন মাছ কাটার আঁশবঁটি দিয়ে এলোকেশীর শিরশ্ছেদ করেন। ১৮৭৩ সালের ২৭ মে এই ঘটনা ঘটে। এরপরে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নবীনচন্দ্র স্থানীয় থানায় গিয়ে আত্মসম্পর্ণ করেন এবং নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

এরপরই ১৮৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীরামপুরের হুগলী সেশন আদালতে শুরু হয় তারকেশ্বর হত্যা মামলা তথা মোহান্ত-এলোকেশী মামলা। এই মামলাটি আদপে রানি বনাম নবীনচন্দ্র ব্যানার্জি নামেই রুজু হয়েছিল আদালতে। প্রথম পর্বের বিচারে আদালতের জুরি নবীনচন্দ্রকে অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে খুন করার অপরাধ মকুব করে নির্দোষ হিসেবে বেকসুর খালাস দেয়, কিন্তু কিন্তু ব্রিটিশ বিচারক এইচ টি প্রিন্সেপ জুরির এই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন এবং মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য কলকাতার উচ্চ আদালতে পাঠান। সেখানে এলোকেশীর সঙ্গে মোহান্তের ব্যাভিচারী সম্পর্কের কথাটা প্রমাণসহ বিচার করা হয় এবং এলোকেশীর খুনি হিসেবে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর ঘোষিত হয় নবীনচন্দ্রের। অন্যদিকে মোহান্ত মাধবচন্দ্র গিরির ২০০০ টাকা জরিমানা হয় এবং সেই সঙ্গে তিন বছরের কারাবাসের সাজা ঘোষিত হয়। এই রায়ের পরেই জনতার মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে লাগল। নবীনকে ক্ষমা করা এবং তাঁর সাজা মকুবের দাবিতে সই সংগ্রহ চলতে লাগল। প্রায় দশ হাজার সই সহ একটি আবেদন জমা পড়ে সরকারের কাছে। সেই আবেদনের ভিত্তিতেই দু বছর পরেই নবীনচন্দ্র ব্যানার্জিকে মুক্তি দেওয়া হয়।

মোহান্ত এলোকেশীর এই ঘটনা সেকালের বাংলায় লোকমুখে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও তার ছাপ পড়েছিল। উনিশ শতকের বাংলায় সর্বাধিক চর্চিত বিষয় ছিল এই তারকেশ্বর হত্যা মামলা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বটতলা থেকে পরপর অনেকগুলি নাটক ও প্রহসন প্রকাশিত হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মোহান্তের যেমন কর্ম, তেমন ফল’, ‘উঃ! মোহান্তের এই কাজ!!’, ‘তারকেশ্বর নাটক’ ইত্যাদি। বেঙ্গল থিয়েটারে সেই সময়ে অভিনীত হচ্ছে লক্ষ্মীনারায়ণ দাসের ‘মোহন্তের এই কি কাজ!!’। এই থিয়েটারে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘কৃষ্ণকুমারী’ ইত্যাদি নাটকের শো বাতিল করে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল লক্ষ্মীনারায়ণ দাসের এই নাটকটি। বটতলার বইগুলি হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল নিমেষের মধ্যে আর একইভাবে দর্শকের অভাবে ধুঁকতে বসা বেঙ্গল থিয়েটারেও জনজোয়ার লক্ষ্য করা গেল। এছাড়াও লোকমুখে মোহান্ত এবং এলোকেশীকে নিয়ে বহু পাঁচালি, কবিগান প্রচারিত হয়েছিল সেই সময়। তাছাড়া সেই সময় প্রকাশিত ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে সাধারণ মানুষ লুইস থিয়েটারে ‘ওথেলো’ নাট্যাভিনয় দেখার মত হুগলি সেশন আদালতে ভিড় করতেন এই মামলা শোনার জন্য। ফলে ভিড় কমাতে বাধ্য হয়ে আদালত কর্তৃপক্ষ প্রবেশমূল্য ধার্য করে। এমনকি ইংরেজি জানা বাবু ছাড়া ছাপোষা মানুষদের ঢুকতেও দেওয়া হত না আদালতে। আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কালীঘাটের পটশিল্পীরা তাঁদের পটে এই কাহিনিকে স্থান দিয়েছিলেন। এইসব পটগুলির কোথাও দেখা যায় মোহান্ত এলোকেশীকে সুরাপানে বাধ্য করছেন, কোথাও আবার নবীন সেখানে সুদজ্জিত বাবু বেশে দাঁড়িয়ে। এলোকেশীকে বে বঁটির আঘাতে হত্যা করেছিলেন নবীন তাও এই সব কালীঘাটের পটে চিত্রিত হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় তারকেশ্বর হত্যা মামলা জনমানসে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে এলোকেশী ডিজাইনের পানের বাটা কিংবা মোহান্তের ছবি দেওয়া হুঁকোর চাহিদা উঠেছিল তুঙ্গে। বিখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক শ্রীপান্থ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন ‘মোহান্ত এলোকেশী সম্বাদ’।              

আপনার মতামত জানান