বিদেশে রবীন্দ্রনাথ এর প্রভাব যে কতখানি ছিল তার প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যায়।সেখানে রবীন্দ্রকাব্যের আবেদন কতখানি ব্যাপক গভীর ছিল একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে সহজেই। ঘটনাটি খুব দুঃখের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বিরতির মাত্র এক সপ্তাহ আগে রণক্ষেত্রে মারা যান বিখ্যাত সৈনিক কবি উইলফ্রেড ওয়েন (Wilfred Owen)। ওয়েনে’র মার কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি পান। চিঠির তারিখ ২১শে আগস্ট ১৯২০। এই চিঠি থেকেই জানতে পারা যায় যে ওয়েন শেষবার যখন যুদ্ধে যায় তখন তিনি তাঁর মা’র সামনে রবীন্দ্রনাথ এর একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। যার প্রথম লাইনগুলো হল “When I go from here/Let this be my parting word.” ওয়েনের মৃত্যুর পর তার কোটের পকেট থেকে একটি ডায়রি পাওয়া যায়। ডায়রিতে লেখা ছিল ওয়েনের নিজের হাতে লেখা এবং তার নীচে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। ডায়রিটি ওয়েনের মা’র কাছে পাঠানো হয়। শোকাহতা জননী রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখে জানতে চান ঐ কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যাবে। কবিতাটি ইংরেজী গীতাঞ্জলির ৯৬ সংখ্যক কবিতা। যার মূল বাংলা হল-
‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই
যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।
এই জ্যোতিসমুদ্র মাঝে যে শতদল পদ্ম রাজে
তারি মধু পান করেছি ধন্য আমি তাই।
যাবার দিনে এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।
বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলাম দুটি নয়ন মেলে।
পরশ যাঁরে যায়না করা সকল দেহে দিলেন ধরা,
এইখানে শেষ করেন যদি শেষ করে দিই তাই-
যাবার বেলা এই কথাটি জানিয়ে যেন যাই।’
একজীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি মানুষের আর কিই বা থাকতে পারে।নোবেল প্রাপক এর তালিকা তো প্রতিবছরই ঘোষণা হয়, কিন্তু আমরা কজনই বা মনে রাখি সেই অসামান্য প্রতিভাধরদের।দেশ,কাল,অক্ষাংশ,দ্রাঘিমার সূচক অতিক্রান্ত করে মানুষের সৃষ্টিই তো রণক্লান্ত শরীরে হয়ে যায় প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড যা তাকে আবার চারিয়ে দেয় সংকল্পের আগুনে।সৃষ্টি তো আসলে চিরকালই বুলেটপ্রুফ।একটা নোবেল দিয়ে কি রবীন্দ্রনাথ কে মাপা যায়!
১৯২৬ সালে সেবার রবীন্দ্রনাথ ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছিলেন।তখন তাঁর সঙ্গী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী।একদিন রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবী ও আরও কয়েকজন ঘুরে ঘুরে পার্বত্য অঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। হঠাৎ রথীন্দ্রনাথের চোখে পড়ে একটি কুটীর এবং তার চারধারে তাল গাছের সারি।একে ইউরোপ তায় পার্বত্য এলাকা এরকম জায়গায় তালগাছের সারি ঘেরা কুটীর রথীন্দ্রনাথকে আশ্চর্য করল।ঐ কুটীরের মালিক সম্বন্ধে কৌতূহল জাগল।খোঁজ নিয়ে জানা গেল মালিক এক জন কৃষক। টেগর (Tagore) পদবী শুনে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারা কি কবি টেগরের কেউ হন?’ সম্পর্ক জানতে পেরে ঐ কৃষক তো দারুণ আনন্দিত হলেন।তিনি তাদের নিয়ে গেলেন অন্দরমহলের ওপরের ঘরে।আশ্চর্য!সেই ঘরে শুধু বই আর বই।তাঁর বোন জানালেন রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, ঘরে বাইরে এবং ডাকঘর তাঁর খুবই প্রিয়।রোজ সন্ধ্যায় তিনি বইগুলি থেকে পাঠ করে শোনান গ্রামের আর সব কৃষকদের।