লন টেনিস জগতের এক কিংবদন্তি নাম রাফায়েল নাদাল (Rafael Nadal)। তাঁকে লন টেনিস খেলার ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। নাদাল ২০৯ সপ্তাহ ধরে বিশ্বের ১নং পুরুষ টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। পুরুষদের সিঙ্গলস ইভেন্টে তিনি মোট ২২ বার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন যা সর্বকালের রেকর্ড। তাঁকে ‘ক্লে কোর্টের সম্রাট’ বলা হয়ে থাকে। তাঁর জেতা ৯২টি এটিপি সিঙ্গলস ম্যাচের ৬৩টিই এই ক্লে কোর্টে জেতা। তিনিই বিশ্বের একমাত্র টেনিস খেলোয়াড় যিনি ক্লে কোর্টে পর পর ৮১টি ম্যাচ জিতেছেন। রজার ফেডেরার ও নোভাক জকোভিচের সাথে তাঁকে একযোগে টেনিস খেলার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনজন খেলোয়াড় হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। অলিম্পিক স্বর্ণপদক সহ আন্দ্রে আগাসির পর তিনিই একমাত্র টেনিস খেলোয়াড় যিনি কেরিয়ার গোল্ডেন স্ল্যাম সম্পূর্ণ করেছেন।
১৯৮৬ সালের ৩ জুন স্পেনের বালেয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের মায়োর্কা দ্বীপের মানাকোর নামের একটি শহরে রাফায়েল নাদালের জন্ম হয়। তাঁর সম্পূর্ণ নাম রাফায়েল নাদাল পেরেরা। তাঁর বাবার নাম সেবাস্তিয়ান নাদাল হোমার এবং মায়ের নাম অ্যানা মারিয়া পেরেরা ফেমেনিয়াস। সেবাস্তিয়ান নাদাল পেশায় একজন ব্যবসায়ী যিনি একটি বীমা কোম্পানি, একটি কাচ ও জানালার কোম্পানি এবং সা পুন্তা নামের একটি রেস্তোরাঁর মালিক। রাফায়েলের ছোট বোনের নাম মারিয়া ইসাবেল। রাফায়েল নাদাল এর কাকা মিগুয়েল আনহেল নাদাল একজন অবসরপ্রাপ্ত পেশাদার ফুটবলার যিনি আরসিডি মায়োর্কা, এফসি বার্সেলোনা এবং স্পেনের জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। এই কাকার সুবাদেই ছোট্ট নাদাল একবার বার্সেলোনার ড্রেসিং রুমে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাঁর ছোটবেলার স্বপ্নের নায়ক ব্রাজিলের বিখ্যাত ফুটবলার রোনাল্ডোর সাথে একসঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন।
রাফায়েল নাদাল এর মধ্যে টেনিস খেলার প্রতিভা প্রথম লক্ষ্য করেন তাঁর আরেক কাকা টনি নাদাল যিনি পেশায় একজন টেনিস কোচ ছিলেন। তিনিই প্রথম রাফায়েলকে তিন বছর বয়সে টেনিস খেলার সাথে পরিচয় করান। পরবর্তীকালে ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল অবধি মূলত কাকার তত্ত্বাবধানেই রাফায়েল টেনিস খেলেছেন। রাফায়েল নাদালের যখন ৮ বছর বয়স সেই সময়ে তাঁর দুই হাতের ফোরহ্যান্ড স্ট্রোক ভালো করে লক্ষ্য করার পর তাঁর এই কাকাই তাঁকে পরামর্শ দেন টেনিস কোর্টে তাঁর সহজাত শক্তির পূর্ণ প্রয়োগ করতে তাঁর বাঁ হাত ব্যবহার করার। পরবর্তীকালে কাকাকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে নাদাল হয়ে ওঠেন টেনিস বিশ্বের অপ্রতিরোধ্য একজন বাঁ হাতি খেলোয়াড় যিনি পরিচিত হন অত্যন্ত জটিল কোণে তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী ফোরহ্যান্ড স্ট্রোকের কারণে।
পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে নাদাল তাঁর জীবন শুরু করেন ১৫ বছর বয়সে। মাত্র ১৫ বছর ১০ মাস বয়সে প্যারাগুয়ের রামন দেলগাদোকে পরাজিত করে নাদাল রাফায়েল নাদাল তাঁর প্রথম এটিপি ম্যাচ জেতেন। ২০০৩ সালে রাফায়েল দুটি চ্যালেঞ্জার শিরোপা জেতেন এবং ৪৯ নম্বর র্যাংকে বছর শেষ করেন। সেই বছর তিনি এটিপি সেরা নবাগত পুরস্কার জিতেছিলেন। ২০০৫ সালে রাফায়েল নাদাল কিশোর হিসেবে পরপর ২৪টি একক ম্যাচ জিতে আন্দ্রে আগাসির টানা ম্যাচ জয়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেন। উনিশ বছর বয়সে নাদাল ২০০৫ ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে শীর্ষ বাছাই রজার ফেডেরারকে পরাজিত করেন। এরপর ২০০৮ সালে বসন্তকালীন ক্লে-কোর্ট মরসুমে নাদাল চারটি একক শিরোপা জেতেন যার মধ্যে তিনটি ফাইনালে রজার ফেডেরারকে পরাজিত করেন তিনি। এরপর বার্সেলোনায় অনুষ্ঠিত ওপেন সাবাদেল আটলান্টিকো টুর্নামেন্টে নাদালের জয় অপ্রতিরোধ্য থাকে। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের ফাইনালে চিলির ফার্নান্দো গঞ্জালেজকে পরাজিত করে নাদাল তাঁর প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণপদক লাভ করেন। এরপর ইউএস ওপেনে নাদাল গ্র্যান্ড স্ল্যাম টুর্নামেন্টে জীবনে প্রথম শীর্ষ বাছাই খেলোয়াড় হিসেবে যোগদান করেন। তিনি তাঁর প্রথম তিনটি ম্যাচে একটি সেটও হারেননি।
২০১০ সাল নাদালের পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বছর হিসেবে পরিগণিত হয়। ২০১০ টেনিস মরসুমে নাদাল টেনিস ইতিহাসে প্রথম পুরুষ খেলোয়াড় হিসেবে এক ক্যালেন্ডার বছরে ক্লে, গ্রাস এবং হার্ড কোর্ট -এ গ্র্যান্ড স্লাম টুর্নামেন্ট জেতেন।
সারা জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন নাদাল। ২০১১ এবং ২০২১ সালে তিনি লরিয়াস ওয়ার্ল্ড স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ার পুরস্কারে সম্মানিত হন। এছাড়াও তিনি গ্র্যান্ড ক্রস অফ দ্য অর্ডার অফ ডস ডি মায়ো, গ্র্যান্ড ক্রস অফ নাভাল মেরিট, প্রিন্সেস অফ অস্ট্রিয়াস অ্যাওয়ার্ড এবং প্যারিস সিটির মেডেল দ্বারা সম্মানিত হয়েছেন। ২০২২ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিচারে ২০২২ সালের একশো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের মধ্যে নির্বাচিত হন।
One comment