আমাদের রোজকার জীবনে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গাড়ি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে উঠেছে। সময় যত এগিয়েছে গাড়ি ততই যাতায়াতের দ্রুত মাধ্যম থেকে ক্রমশই বিলাসিতার একটি অন্যতম পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে ব্যক্তিগত যাতায়াতের গাড়ির দুনিয়ার মুকুটহীন সম্রাট হল ইংল্যান্ডের অভিজাত গাড়ি কোম্পানি রোলস রয়েস। আভিজাত্যের শেষ কথা হল রোলস রয়েস। সময় যত গড়িয়েছে আভিজাত্যের সাথে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে রোলস রয়েস নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে ততই। এই রোলস রয়েসের সর্বাধিক বিক্রিত মডেল হল রোলস রয়েস ঘোস্ট ।
২০০৯ সালে প্রথমবার এই রোলস রয়েস ঘোস্ট মডেলটি আত্মপ্রকাশ করে৷ ক্রমে এই সিরিজের অনেকগুলি সংস্করণ বেরোয় বিভিন্ন আধুনিক বৈশিষ্ট্য সহকারে। প্রত্যেক নতুন সংস্করণে গাড়ির অভ্যন্তরীন কিছু পরিবর্তন ঘটানো হয়। ২০২০ সালে রোলস রয়েস ঘোস্টের যে সংস্করণটি প্রকাশ করা হয় সেটির সবথেকে বড় চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এর শব্দ প্রতিরোধক ক্ষমতা। অনেক গাড়ি বিশেষজ্ঞের মতে এই গাড়ির সবথেকে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হল এর ভিতরে বাইরের কোন আওয়াজ ঢোকে না। পৃথিবীর নিঃশব্দতম গাড়ি বলা যেতে পারে এই মডেলটিকে।
রোলস রয়েস ঘোস্ট মডেলের এই গাড়ির দরজা বন্ধ করার সাথে বাইরের কোলাহলমুখর জগৎ থেকে এক নিমেষে নিস্তব্ধতার এক অনন্য দুনিয়ায় যেন চলে যাওয়া যায়। রোলসের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা এই গাড়িটিকে শব্দহীন করে তুলতে গিয়ে এতটাই নিস্তব্ধ করে তুলেছিলেন প্রথমে যে গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীর হৃদস্পন্দনের শব্দ থেকে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসার সময় সামান্য নড়াচড়া এমনকি শ্বাস প্রশ্বাসের স্বাভাবিক শব্দকেও গাড়ির ভেতর প্রতিধ্বনিত করে তুলছিল। গাড়ির ভেতর এই চরম নৈঃশব্দ্য আনতে রোলসের সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা প্রথমেই গাড়িটির কাঠামো তৈরী করতে ইস্পাতের পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করেন। ইস্পাতের তুলনায় অ্যালুমিনিয়ামের শব্দ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। গাড়িটির ছাদ, মেঝে জুড়ে মোট ২২০ পাউন্ড ওজনের শব্দ নিরোধক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গাড়ির বনেট সহ ইঞ্জিনের অংশটি দুই স্তর বিশিষ্ট অত্যন্ত শক্তিশালী শব্দ নিরোধক আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই উপাদানটি জানলার ভিতর দিকের কাচে এবং টায়ারের মধ্যেও রাখা হয়েছিল। এমনকি ইঞ্জিনিয়াররা উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার এবং এয়ার ভেন্টের মতো ছোট ছোট উপাদান যেগুলি খুবই সূক্ষ্ম শব্দ তৈরি করে, যা সচেতনভাবে অনেক সময় অনুভব করাও যায় না, সেগুলির দিকেও যথেষ্ট মনোযোগ দিয়েছিলেন যাতে সেই উৎসগুলি থেকেও আগত শব্দকে রোধ করা যায়।
কিছু ক্ষেত্রে এই অত্যধিক নৈঃশব্দ্য যাত্রী বা চালকের স্নায়ুতে এতটাই প্রভাব বিস্তার করছিল যে গাড়িতে বসা ব্যক্তি নিজের হৃদ স্পন্দন বা শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দতো শুনতে পেতই এমনকি বমি করার মত পরিস্থিতিও তৈরী হয়ে যেত অনেক সময়। তাছাড়া সম্পূর্ণ শব্দহীন এক দুনিয়ায় গাড়ি চালাতে চালাতে চালকের দিকভ্রান্তি হয়ে যাওয়ার কিছু নমুনাও দেখতে পান ইঞ্জিনিয়াররা। এই সমস্ত অসুবিধার দিকগুলি চিন্তা করে ইঞ্জিনিয়াররা ঠিক করেন গাড়ির ভেতর একটি মৃদু সুরেলা শব্দতরঙ্গ তৈরি করা দরকার যা যাত্রীর মনে একটি প্রশান্তির ভাব আনবে।
এই সুরেলা ফিসফিসে মৃদু ধ্বনি তৈরী করতে গিয়ে রোলসের ইঞ্জিনিয়াররা গাড়ির বসার জায়গা, তার ড্যাম্পিং ইউনিট এবং ৫০০ লিটারের বুট স্পেস সহ সমস্ত অংশ থেকে যাতে একটি সমান মৃদু কম্পাঙ্কবিশিষ্ট ধ্বনি তৈরী হয় সেটি নিশ্চিত করেন। এমনকি এই গাড়ির এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমের অন্তর্গত পাইপগুলিকে আরও মসৃণ করা হয় এগুলিকে শব্দ নিরোধক করে তুলতে।
এইভাবে রোলস রয়েসের ঘোস্ট সিরিজের গাড়িগুলি নানারকম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এই গাড়ির যাত্রীদেরকে বাইরের জগতের কোলাহল থেকে মুক্তি দিয়ে শান্তিপূর্ণ বা বলা ভালো এক শ্রুতিমধুর শব্দের আবহের মধ্যে দিয়ে যাত্রার অভিজ্ঞতা প্রদান করার লক্ষ্যে সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে রোলস রয়েস ঘোস্ট সিরিজের এই গাড়ি।
আপনার মতামত জানান