ভারতের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক এবং বাঙালি গবেষক শম্ভুনাথ দে (Sambhu Nath De) কলেরার জীবাণু নিঃসৃত টক্সিন আবিষ্কার করে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। এছাড়া তিনি কলেরার জীবাণু ‘ভিব্রিও কলেরি’র সংক্রমণ পদ্ধতিও সফলভাবে বর্ণনা করেন। বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় তাঁর এই গবেষণা সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও প্যাথোলজি ও ব্যাকটেরিওলজি বিষয়ের উপর বহু গবেষণাপত্র লিখেছেন তিনি। মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি কলেরার জিবাণু বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন শম্ভুনাথ দে ।
১৯১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হুগলী জেলার গড়বাটি গ্রামে শম্ভুনাথ দে র জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম দাশরথি দে এবং মায়ের নাম চট্টেশ্বরী দেবী। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। শম্ভুনাথের কাকা আশুতোষ দের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি একটি ছোটখাটো ব্যবসা চালাতেন। আদ্যোপান্ত বৈষ্ণব ধর্মানুসারী হওয়ায় ব্যবসায় লাভবান হতে পারেননি তিনি। শম্ভুনাথের ঠাকুরদার বিশাল বড় ব্যবসা ছিল, সমৃদ্ধিও ছিল সেই সময় শম্ভুনাথের পরিবারে। কিন্তু বন্যায় সব ডুবে গেলে আর্থিক অনটনে পড়েন তাঁরা। পরবর্তীকালে কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক শ্রী মণীন্দ্রচন্দ্র দের মেয়ে তরুবালার সঙ্গে শম্ভুনাথের বিয়ে হয়।
এই পরিবারে একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন শম্ভুনাথের কাকা। মূলত তাঁর সমর্থনেই শম্ভুনাথের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। কাকার উৎসাহেই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন স্থানীয় গড়বাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয় থেকে শম্ভুনাথ ডিস্টিংশন-এর সঙ্গে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য তিনি ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পান। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত হুগলী মহসিন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেও তিনি ভালোভাবে পাশ করেন এবং ভালো ফল করার জন্য তিনি ডি.পি.আই বৃত্তি পান। এই সময় শম্ভুনাথের কাকার মৃত্যু হয় এবং আর্থিক সমস্যার জন্য তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন কলকাতার এক বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী কেষ্টধন শেঠের সঙ্গে শম্ভুনাথের পরিচয় হয়। তাঁর প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হয়ে কেষ্টধন শম্ভুনাথকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাঁর সাহায্যের ফলেই শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কেষ্টধন তাঁর বসতবাড়ির একটি অংশে শম্ভুনাথের থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিক থেকেই মেধাবী শম্ভুনাথ অধ্যাপকদের নজর কেড়ে নিতে সক্ষম হন। বিশেষত ব্যাকটেরিওলজি ও প্যাথোলজির অধ্যাপক মণীন্দ্রচন্দ্র দে তাঁর উপর বিশেষ দৃষ্টি দিতেন এবং শম্ভুনাথের মেধায় তিনি অত্যন্ত প্রীত হন। ১৯৩৯ সালে মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি পরীক্ষায় পাশ করেন শম্ভুনাথ। এর তিন বছর পর ১৯৪২ সালে ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিষয়ে ডিপ্লোমা (DTM) ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
স্নাতক হওয়ার পরপরই তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্যাথোলজি বিভাগের একজন প্রদর্শক (demonstrator) হিসেবে যোগ দেন এবং অধ্যাপক বি. পি. ত্রিবেদীর অধীনে গবেষণা শুরু করেন। অর্থ উপার্জনের জন্য সেই সময় ক্লিনিক্যাল প্যাথোলজি নিয়ে বাইরেও স্বাধীনভাবে কাজ করছিলেন শম্ভুনাথ। ১৯৪৭ সালে শম্ভুনাথ উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন সুদূর লণ্ডনে। সেখানকার ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ হসপিটাল মেডিকেল স্কুল’-এ ‘মরবিড অ্যানাটমি’ (morbid anatomy) বিভাগে অধ্যাপক স্যার রয় ক্যামেরনের অধীনে গবেষণা শুরু করেন শম্ভুনাথ দে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মস্তিষ্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক হাইড্রোসেফালাসের প্রভাব। ১৯৪৯ সালে তিনি প্যাথোলজিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্যাথোলজি এবং ব্যাকটেরিওলজি বিভাগের প্রধান রূপে যোগ দেন। অবসরের আগে পর্যন্ত এই পদেই অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। এইসময় থেকেই তিনি কলেরা রোগ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। এর আগে বিজ্ঞানী রবার্ট কখ্ (Robert Koch) কলেরা রোগ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন এবং এই রোগের জীবাণু ‘ভিব্রিও কলেরি’কে কেলাসিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানী কখ্ বলতে পারেননি যে এই জীবাণু কীভাবে মানব শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। কখের কথা অনুযায়ী, এই জীবাণুটি দ্বারা নিঃসৃত বিষ হল একধরনের এণ্ডোটক্সিন যা কিনা ব্যাকটেরিয়াটির কোষপ্রাচীরের সাথে যুক্ত থাকে এবং এটি কোষকে পুরোপুরি মেরে ফেলে। অথচ এই প্রক্রিয়ারও কোনো সঠিক বর্ণনা দিতে তিনি ব্যর্থ হন। সংক্রমণ ক্রিয়া সঠিকভাবে জানা না থাকায় এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কোন ওষুধও তৈরি করা যাচ্ছিল না। এদিকে দেশে কলেরা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছিল। এই ঘটনা দেখে শম্ভুনাথ উদ্বুদ্ধ হন এবং কলেরা রোগের জীবাণুর সংক্রমণের পদ্ধতি জানার কাজে মনোযোগ দেন।
এক সময় চিকিৎসকদের ধারণা ছিল যে, কলেরার জীবাণুর অন্ত্রের পিচ্ছিল আবরণী যুক্ত পর্দা ভেদ করে অন্ত্রের ভিতরে ছড়িয়ে পড়া হল একটি গৌণ লক্ষণ। কিন্তু শম্ভুনাথ মনে করতেন যে এটিই এই জীবাণুর মূল মারণ প্রভাব এবং জীবাণু থেকে বের হওয়া বিষটি এক্সোটক্সিন প্রকৃতির। তাঁর এই মতের পক্ষে প্রমাণের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘বিচ্ছিন্ন আন্ত্রিক ফাঁস পরীক্ষা’ (Ligated Intestinal Loop Experiment)। তিনি খরগোশের অন্ত্রের কিছু অংশের উপর এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। শম্ভুনাথ প্রথমে খরগোশের অন্ত্রের একটি ছোট অংশ নিয়ে তার দুটি মাথা আটকে দিয়েছিলেন। এর ফলে যে ছোট নলের মতো প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছিল তাতে নেওয়া হয়েছিল কোষপ্রাচীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা ভিব্রিও কলেরি’র নির্যাস, কারণ বিজ্ঞানী কখ্ বলেছিলেন কোষপ্রাচীর থেকেই জীবাণুটির বিষ নির্গত হয়। এইভাবে সাজিয়ে রেখে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল অন্ত্রের প্রকোষ্ঠটির মধ্যে দেহ নিঃসৃত তরল এসে জমেছে। এর থেকে বোঝা যায় অন্ত্রের প্রকোষ্ঠে থাকা জীবাণুর বিষ অন্ত্রের দেওয়ালে ছিদ্র তৈরি করেছে এবং সেই ছিদ্র দিয়ে দেহতরল বেরিয়ে আসছে। অন্ত্রের দুটি মাথা আটকানো না থাকলে ওই তরল পায়ুপথের মাধ্যমে তরল মল রূপে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসত, যা ছিল কলেরার অন্যতম উপসর্গ। এভাবেই আস্তে আস্তে রোগীর দেহ থেকে প্রয়োজনীয় তরল পদার্থ বা জল বাইরে বেরিয়ে আসত এবং রোগীর মৃত্যু হত। এই পরীক্ষার মাধ্যমে শম্ভুনাথ দে কলেরা রোগ সংক্রান্ত অনেক ভ্রান্ত ধারণার আবাসন ঘটান এবং কলেরা রোগের জীবাণুর সংক্রমণ পদ্ধতির নির্ভুল ব্যাখ্যা দেন। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি সর্বপ্রথম কলেরা রোগের গবেষণায় খরগোশকে সফলভাবে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা বিষয়ক পত্রিকা ‘নেচার’ (Nature)-এ শম্ভুনাথের এই গবেষণা সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘এন্টারোটক্সিসিটি অফ ব্যাকটেরিয়া-ফ্রি কালচার-ফিলট্রেট অফ ভিব্রিও কলেরি’ (Enterotoxicity of bacteria-free culture-filtrate of Vibrio cholerae)। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর এই মূল্যবান গবেষণাটি সেই সময় প্রচার বা স্বীকৃতি, কোনটিই পায়নি। স্বীকৃতি না পাওয়ার জন্য তিনি পরবর্তী গবেষণার জন্য কোন আর্থিক সাহায্যও পাননি।
কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও থেমে থাকেনি শম্ভুনাথের গবেষণা। একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্র। এর মধ্যে কয়েকটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র হল- ‘অ্যান এক্সপেরিমেন্টাল স্টাডি অফ দ্য অ্যাকশন অফ কলেরা টক্সিন’, ‘কলেরা: ইটস প্যাথলজি অ্যান্ড প্যাথোজেনেসিস’, ‘অ্যাক্টিভিটিস অফ ব্যাকটেরিয়া-ফ্রি প্রিপারেশনস ফ্রম ভিব্রিও কলেরি’ ইত্যাদি।
১৯৭৩ সালে ৫৮ বছর বয়সে শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করার পর তিনি অন্য কোন উচ্চপদ গ্রহণ করার প্রতি কোন আগ্রহ দেখাননি। কলকাতায় অবস্থিত ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ থেকে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কলেরা টক্সিনকে পরিশুদ্ধ করার তাঁর যে ইচ্ছা ছিল, তা পূরণ হয়নি। কারণ সেই সময় প্রোটিন পরিশোধনের প্রযুক্তি উন্নত ছিল না। তিনি বেশি ক্ষতিকারক বিষ নির্গমনকারী কলেরার প্রাচীন স্ট্রেন ‘ভিব্রিও কলেরি ০১’ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সাল থেকে কলকাতায় সেই স্ট্রেনটির পরিবর্তে কম ক্ষতিকারক বিষ নির্গমন করে এমন একটি কলেরা জীবাণুর স্ট্রেন উদ্ভূত হয়। শম্ভুনাথের গবেষণা চালিয়ে যেতে না পারার পিছনে এটিও একটি বড় কারণ। ১৯৭৮ সালে ‘দ্য নোবেল ফাউণ্ডেশন’ ৪৩তম নোবেল পুরস্কার সম্মেলনে কলেরা এবং তৎ সম্পর্কিত ডায়েরিয়ার উপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য শম্ভুনাথ দে’কে আমন্ত্রণ জানায়। শম্ভুনাথ সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘কোটস পদক’ প্রদান করে সম্মান জানায়। এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শারীরবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। লণ্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অফ মেডিসিন শম্ভুনাথকে ‘ফেলো’ হিসেবে নির্বাচন করেছিল। তা ছাড়াও, গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যাণ্ডের প্যাথোলজিক্যাল সোসাইটি তাঁকে সদস্য হিসেবে নির্বাচন করেছিল। কিন্তু কলেরার মতো একটি মারণ রোগের উপর মূল্যবান গবেষণা করা সত্ত্বেও তাঁর নাম নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় স্থান পায়নি। আর এক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী জোশুয়া লেডারবার্গ বিচারকদের কমিটিতে বহুবার শম্ভুনাথের নাম এই পুরস্কারের জন্য উল্লেখ করেছেন। তবুও কোন নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়াই শম্ভুনাথ দে’র কাছে অধরাই থেকে গেছে নোবেল পুরস্কার।
১৯৮৫ সালের ১৫ এপ্রিল ৭০ বছর বয়সে কলকাতায় শম্ভুনাথ দে’র মৃত্যু হয়।
2 comments