সতীপীঠ সপ্তশ্রুঙ্গী মহারাষ্ট্রের নাসিকে সহ্যাদ্রী পর্বতমালার চূড়ায় অবস্থিত। সতীপীঠ সপ্তশ্রুঙ্গী একান্ন সতীপীঠের একটি পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, এখানে সতীর চিবুক পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ভ্রামরী এবং ভৈরব হলেন বিকৃতাক্ষ।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়, বলা হয় সতীর চিবুক পড়ে সপ্তশ্রুঙ্গী সতীপীঠটি গড়ে উঠেছে।
কথিত আছে, সত্যযুগে ভগবান ব্রহ্মা এই জায়গায় পদ্মাসনে বসে সৃষ্টির কথা চিন্তা করেছিলেন, তাই এর নাম ‘পদ্মনগর’। ত্রেতাযুগে গভীর বনে ঘেরা এই নাসিকে খর, দূষণ এবং ত্রিশির নামে তিনজন রাক্ষসের বিচরণ ভূমি ছিল, তাই এর নাম হয়েছিল ‘ত্রিকণ্টক’। জনকরাজা এখানে অনেক যজ্ঞ করেছিলেন বলে দ্বাপরে এর নাম হয়েছিল ‘জনস্থান’। এই জায়গাতেই লক্ষ্মণ রাক্ষসরাজ রাবণের বোন শূর্পণখার নাক ও কান কেটে দিয়েছিলেন। তাই জনসাধারণের কাছে এই জায়গার নাম হয়েছে নাসিক।
দেবীমাহাত্ম্য অনুযায়ী, পুরাকালে অরুণ নামে এক অসুর ছিল। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কাছে সে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা শিখেছিল। তারপর থেকে সে সবসময় এই মন্ত্র জপ করত। আসতে আসতে এটি তার অভ্যাস হয়ে যায় এবং তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বনিত হতে থাকে গায়ত্রী মন্ত্র। ব্রহ্মার তপস্যা করে অরুণাসুর বর পেয়েছিল যে, কোনো অস্ত্র-শস্ত্র দিয়েই তাকে মারা যাবে না। এই বর পেয়ে সে খুব অত্যাচারী হয়ে ওঠে। তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে মুনি-ঋষিরা ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে প্রতিকার করার অনুরোধ জানান। বিষ্ণুদেবের পরামর্শ মেনে সব দেবতা ও মুনি-ঋষিরা মিলে ভগবতী মহামায়ার আরাধনা শুরু করলেন। ওদিকে দেবগুরু বৃহস্পতি গিয়ে মায়া প্রয়োগ করে অরুণাসুরকে গায়ত্রী মন্ত্র ভুলিয়ে দিলেন। তারপর দেবী মহামায়া ছয়টি পা যুক্ত বিশাল ভ্রমরের রূপ ধরে অরুণাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন এবং তার রক্ত চুষে নিয়ে তাকে হত্যা করলেন। ভ্রমরের রূপ ধরে অসুরকে বধ করেছেন বলে দেবীর নাম হল ‘ভ্রামরী’।
এই দেবীই অধিষ্ঠিত আছেন নাসিকে। মার্কণ্ডেয় মুনি স্বপ্নাদেশ পেয়ে সহ্যাদ্রী পর্বতে ভ্রামরী দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায়, মহিষাসুর মারা যাওয়ার পর ভীম নামে আর এক অসুর পৃথিবীতে ভীষণ অত্যাচার করতে শুরু করে। তার অত্যাচারে নাজেহাল দেবতারা দেবী চণ্ডিকাকে স্মরণ করলে দেবী অষ্টাদশভুজা রূপ ধারণ করে এই পর্বতেই তাকে বধ করেন।
কালের নিয়মে ঋষি মার্কণ্ডেয় প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যায়। বহুকাল পরে এক রাখাল এই পর্বতে ভেড়া চরাতে এলে পর্বতের গুহার মুখে একটি বিশাল মৌচাক দেখতে পায়। সেটিকে ভাঙতে গেলে দেখা যায় মৌচাকটির ছিদ্র দিয়ে মধুর বদলে গোলা সিঁদুর বেরিয়ে আসছে। এই দেখে ভয় পেয়ে রাখালটি গ্রামের মানুষদের খবর দেয়। গ্রামবাসীরা এসে চাকটিকে ভাঙতেই দেবী ভ্রামরীর মূর্তি উদ্ধার হয়। তারপর এই পর্বতেই দেবীকে আবার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভ্রামরী দেবীর মূর্তিটি আকারে অতি বিশাল। তিনি অষ্টাদশভুজা। তাঁর ডান দিকের হাতে মণিমালা, পদ্ম, বাণ, তরবারি, বজ্র, চক্র, ত্রিশূল, অঙ্কুশ ও কুড়ুল। বাম দিকের হাতে শঙ্খ, ঘণ্টা, পাশা, গদা, দণ্ড, ঢাল, ধনুক, পানপাত্র ও কমণ্ডলু। দেবীর চোখ দুটি লাল রঙের। ঘাড় বামদিকে সামান্য হেলানো। জনশ্রুতি অনুসারে, অসুর বধের সময় দেবী ভীষণ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিলেন। তাঁকে শান্ত করার জন্য মহর্ষি মার্কণ্ডেয় উচ্চৈস্বরে দেবীর স্তব আরম্ভ করেন। স্তবপাঠ শুনে দেবী মুগ্ধ হন এবং বামদিকে সামান্য ঘাড় কাত করে সেই স্তব শুনতে থাকেন। তাই এখনো দেবীর মুখ সেই অবস্থানেই রয়েছে। দেবীর পরনে শাড়ি, মাথায় রুপোর মুকুট, নাকে মরাঠি মেয়েদের মতো নথ। সর্বাঙ্গে মেটে সিঁদুরের প্রলেপ দেওয়া।
সহ্যাদ্রী পর্বতের সব থেকে উঁচু চূড়ায় দেবীর সতীপীঠ সপ্তশ্রুঙ্গী অবস্থিত। একটি ১৮ ফুট দীর্ঘ গুহাকে কেন্দ্র করে সাদা রঙের মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরের তোরণের সামনে ঘণ্টা ও আলো দিয়ে সাজানো একটি ত্রিশূল আছে। মন্দিরের সামনেই আছে একটি পাথরে বানানো মোষের মাথা। কথিত আছে, দেবী মহিষাসুরকে বধ করার পর তার মাথা কেটে এখানে ফেলে দিয়েছিলেন। পর্বতের নিচ থেকে মন্দির ওঠার জন্য লোহার রেলিং দেওয়া সিঁড়ি আছে। পেশোয়ার সর্দার খাণ্ডেরাও দাবাড়ের স্ত্রী উমাবাঈ দাবাড়ে ৪৭২টি ধাপযুক্ত এই সিঁড়ি ১৭১০ সালে তৈরি করে দিয়েছিলেন। এখানে দেবী ভ্রামরী ছাড়াও আছে গণেশ ও মার্কণ্ডেয় ঋষির মন্দির।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। সপ্তশ্রুঙ্গী সতীপীঠে দেবী হলেন ‘ভ্রামরী’ এবং ভৈরব হলেন ‘বিকৃতাক্ষ’। আবার মতান্তরে ভৈরবের নাম ‘সর্বসিদ্ধিশ’। সহ্যাদ্রী পর্বতের সাতটি চূড়া আছে। ‘সপ্ত’ (সাতটি) ‘শৃঙ্গ’ (চূড়া) যুক্ত পর্বতে বাস করেন বলে দেবীর নাম ‘সপ্তশৃঙ্গী’ বা ‘সপ্তশ্রুঙ্গী’। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে দেবীর নাম ‘ভ্রমরাম্বা’।
এখানে দেবীর নিত্যপুজোর ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন পুজোর আগে দেবীর অভিষেক হয়। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে এই পর্ব। প্রথমে জল দিয়ে দেবীর মুখ ধোয়ানো হয়। তারপর দেবীকে দুধে স্নান করানো হয়। এবার দেবীর সর্বাঙ্গে দই মাখিয়ে রাশি রাশি ঘি, মধু, এবং চিনি লেপন করা হয়। তারপর জল দিয়ে দেবীকে স্নান করানো হয়। এরপরে দুটি বালতিতে মেটেসিঁদুর গুলে দেবীর সর্বাঙ্গে প্রলেপ দেওয়া হয়। পরে কাজল দিয়ে চোখ এঁকে চক্ষুদান করা হয়। সব শেষে দেবীকে নতুন শাড়ি ও গয়না পরিয়ে পুজো শুরু হয়। নিত্যদিনের পুজো ছাড়াও নবরাত্রি, মহাশিবরাত্রি প্রভৃতি উৎসব এখানে ধুমধাম করে পালিত হয়।