সববাংলায়

সারি গান

বাংলার লোকসংস্কৃতির সমৃদ্ধশালী ধারায় লোকসঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বুকে এমন বহু লোকসঙ্গীত আজও প্রচলিত রয়েছে, এমনকি শহুরে ছোঁয়া লেগে জনপ্রিয় সংস্কৃতির ধারার অঙ্গও হয়ে উঠেছে, যেগুলির শিকড় রয়েছে আদতে বহু প্রাচীনকালে। মূলত বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে প্রচলিত তেমনই একরকম গান হল সারি গান (Sari Song) এবং তৎসহ নৃত্য। তবে পশ্চিবঙ্গেও যে এই গানের অস্তিত্ব নেই তেমন নয়। এই সারি গানের সঙ্গে মানুষের কর্মজীবনের একটি সরাসরি সংযোগ রয়েছে। এই গান মূলত শ্রমজীবী মানুষদের গান। শ্রমিক, কৃষক, মাঝিমাল্লাদের মুখে মুখে ফেরা গান হল এই সারি গান। শ্রমের কষ্ট লাঘব করবার জন্য শ্রমিকেরা দল বেঁধে তাদের কাজের তালে তালে এই গান গেয়ে থাকে। বাইচ খেলায় কিংবা শ্রমিকদের ছাদ পেটানোর সময় গাওয়া গান, যেটি ছাদ পেটানোর গান নামেও পরিচিত, সেগুলি সবই এই সারি গানেরই অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে এই গানের ধারা বাংলার শ্রমজীবী কৃষক, শ্রমিকের মুখে মুখে চলে আসছে। সেইজন্য একে কর্মসঙ্গীতও বলা হয়ে থাকে।

‘সারি’ শব্দটি সাধারণত একটি লাইনে বা সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ বা কিছু বস্তুকে বোঝায়। তবে গবেষকদের মতে, এই সারি শব্দটি আদি ও মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে এসেছে। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্যে সঙ্গীত অর্থে ‘সারি’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করা যায়। বাইচ খেলার সময় সারি সারি দাঁড় টেনে নৌকা বাওয়ার সময় এই গান গাওয়া হয় বলেই হয়তো এর নাম সারি গান। এখানে উল্লেখ্য মুঘল নৌবাহিনীতেও নৌকার প্রতিযোগিতা হত এবং সেখান থেকেই বাংলায় এই বাইচ খেলার সূত্রপাত হয়। তবে অর্থের বিস্তার ঘটে গিয়েছে। কেবল বাইচ খেলার গন্ডি ছাড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষদের শ্রম লাঘবের জন্য সমবেতভাবে গাওয়া গানও সারি গানের অন্তর্ভুক্ত। তবে নৌকার প্রতিযোগিতা বা বাইচ খেলার সময় এই গান আলাদা একটা প্রাণোচ্ছলতা এবং উদ্যম এনে দেয় বলেই হয়তো এই সারি গানকে বিশেষভাবে বাইচের গানই বলা হয়ে থাকে। তবে দলবদ্ধ কাজ, যথা ছাদ পেটানো, ধান ভাঙা, পাট কাটা ইত্যাদি কাজের সময়তেও এই গান গাওয়া হয় এবং কর্মভেদে কোন গান ছাদ পেটানোর গান নামে পরিচিত হয়, কোনটা আবার ধান ভাঙার গান বা পাট কাটার গান হিসেবেও পরিচিতি পায়। কিন্তু নৌচালনার সঙ্গেই এই গানের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সেই কারণে এই গানকে জলের গান বলেন কেউ কেউ। বাইচ খেলার সময় অনেকে মিলে সারিবদ্ধভাবে দীর্ঘ একটি নৌকায় বসে একসঙ্গে দাঁড় টেনে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যায় তীরের গতিতে। সেই নৌকা টানার সময় ‘বৈঠা ফেলার ঝোঁকের সঙ্গে গাওয়া’ গানই সারি গান।

আরও পড়ুন:  করোনা ভাইরাস

কাজের তালে তালে শরীরও দুলতে থাকে এবং সেই তালের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলে সারি গান।

প্রখ্যাত লোক-গবেষক পল্লব সেনগুপ্ত লিখেছেন, বিশেষত ‘শ্রাবণ সংক্রান্তিতে মনসা-ভাসানের সময়, বিজয়া দশমীর দিন, ঈদ-উল-ফিৎর এবং ঈদ-উজ-জোহার্ দিনগুলিতে হিন্দু-মুসলমান নির্ব্বিশেষে’ মূলত বাংলাদেশের মৈমনসিংহ, বরিশাল, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং সেই নৌকাদৌড় খেলাতেই দলবেঁধে নৌকা-চালনার সঙ্গে সঙ্গে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে।

সারি গানের বিষয় কিন্তু নানারকম হতে পারে। তাতে নিছক লৌকিক প্রেম-ভালবাসা, মিলন-বিরহের কথা যেমন থাকে তেমনই থাকে রাধা-কৃষ্ণের লীলার কথা, নিমাইসন্ন্যাসীর কথা ইত্যাদি। আবার সম্পূর্ণ কবিগানের ধাঁচের না হলেও পরস্পরের প্রতি বিদ্রুপাত্মক গান গাওয়ারও প্রচলন দেখা যায়। এমনকি নানারকম হাসির গান, দেবদেবীর বন্দনা গানও সারি গানের বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। পল্লব সেনগুপ্তই জানাচ্ছেন, ”সচরাচর সারি গানের তিনটি পর্যায় লক্ষিত হয় : নৌকা রওনা হবার আগে কোন দেবতা বা পীরের উদ্দেশে নিবেদিত বন্দনা গান, ছিপগুলি ঘাট-ছাড়ার পর নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থানে যাবার পথে (মৈমনসিংহের ভাষায়, আরঙ্গ) প্রেম অথবা বিদ্রুপাত্মক গান এবং ফেরার পথে কোন ধরণের গভীর ভাবমূলক গান করেন মাল্লারা।” সারিগানের মূল গায়ক বা বয়াতি গান গাইতে গাইতে ঘুরে-ফিরে একরকম নাচও করেন সেই ছিপনৌকোর উপর এবং তার বাকি সাঙ্গপাঙ্গ গানের ধুয়া ধরে। ঢোল, কাশী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এই সারি গান গাওয়া হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ্য যে, মাঝিমাল্লাদের আরেকরকম গান যেগুলি ভাটিয়ালি নামে পরিচিত, তার সঙ্গে সারি গানের তফাত আছে। ভাটিয়ালি গান মূলত ধীরলয়ের গান, তাতে আবার ‘লয়হীন সুরেলা’ দীর্ঘ টান লক্ষ করা যায়। কিন্তু সারিগানে যে ঝোঁক এবং তাল থাকে, ভাটিয়ালিতে তা অনুপস্থিত। প্রধানত দাদরা ও কাহারবা তালে সারিগান গাওয়া হয়। তাছাড়াও ভাটিয়ালি মূলত একক সঙ্গীত, একলা মাঝি দাঁড় বাওয়ার অবসরে ভাটির স্রোতে নৌকা ভাসিয়ে দিয়ে এই গান করেন, কিন্তু সারি গান হল বৃন্দগীত বা দলবদ্ধ গান। বিষয়ের দিক থেকেও ভাটিয়ালি ও সারিগানের কিছু পার্থক্য রয়েছে। ভাটিয়ালিতে সাধারণত বিরহ, হতাশা, বিচ্ছেদ-বেদনার গানেরই প্রাধান্য কিন্তু অপরদিকে সারি গানে উচ্ছ্বাস, আনন্দ, কর্মোদ্যমের প্রকাশ।

আরও পড়ুন:  মার্টিন রিস

সেই চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দিতে মনসামঙ্গলের পুঁথিতে সঙ্গীত অর্থে সারি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারও আগে বাংলার আদিমতম নিদর্শন চর্যাপদেও রয়েছে এই ‘সারি’ শব্দের উল্লেখ যেখানে এর অর্থ “বীণার ছড়”। পরবর্তীকালে ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে এক আলোড়ন এনে দেয়। সেই নিমাইয়ের কথাও পরবর্তীকালে ঢুকে পড়ে এই সারি গানে। মূলত নৌকা বাইচের সময় সারি সারি দাঁড় টেনে এই গান সমবেতভাবে গাওয়া হত। আজও বাইচ খেলা হলে এই সারি গান শুনতে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে কৃষক, শ্রমিকের মুখের শ্রমলাঘবের গানগুলিকেও এই সারিগানের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হল, যেমন ছাদ পেটানোর গান, ধান ভাঙার গান ইত্যাদি। অর্থাৎ একই শ্রেণির মানুষ একই ধরণের কাজ করতে করতে এই সারি গান করে থাকেন।

এই গান সাধারণত মাঝিমাল্লাদের বা কৃষক শ্রমিকের মুখের গান। সেইসব গান সংগ্রহ করে এনে অনেকেই প্রকাশ করেছেন। বিখ্যাত সারিগান রচয়িতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, সৈয়দ শাহনুর শাহ, সেখ ভানু, শিতালং শাহ, আরকুম শাহ প্রমুখ। শাহ আবদুল করিমও সারিগান লিখেছিলেন, যেমন, “কোন মেস্তরি নাও বানাইলো” ইত্যাদি। সারি গানের আদলকে মাথায় রেখেই গিরীন চক্রবর্তীর মতো গীতিকাররা “নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে”-র মতো জনপ্রিয় সারি গান রচনা করেছেন। আবার ব্রতচারী সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত কিছু সারিগান রচনা করেছিলেন। ‘মর্জিনা আবদুল্লা’ “কাঠ কাটি, কাঠ কাটি, কাঠ কাটি, কাঠ…” গানটি একটি জনপ্রিয় সারিগানের উদাহরণ। বর্তমানে বাউল আব্দুলের কন্ঠে রেকর্ড করা অনেকগুলি সারি গান শুনতে পাওয়া যায়।

তথ্যসূত্র


  1. ‘বাঙলার লোকসঙ্গীত’, সম্পাদক– অমর পাল, দুলাল চৌধুরী, পাঁচালি প্রকাশন, ১৯৪৮
  2. https://www.indianetzone.com/
  3. https://www.bongodorshon.com/
  4. https://irabotee.com/
  5. https://www.millioncontent.com/

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বাদল সরকারের জীবনী দেখুন

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন