সতীপীঠ শিবহরকরায় মন্দিরটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করাচীর সন্নিকটস্থ পার্কাই রেলওয়ে স্টেশনের কাছে অবস্থিত। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে মন্দিরটি সিন্ধু নদীর তীরে পাকিস্তানের সুক্কুর শহরে অবস্থিত। আরেকটি মত অনুযায়ী, মন্দিরটি মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের শারকারে অবস্থিত। যদিও পার্কাই রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী স্থানটির কথাই মন্দিরের অবস্থান বিষয়ে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বলে মনে হয়। এই স্থান করাভিপুর নামেও পরিচিত। পুরাণ অনুসারে এই শিবহরকরায় সতীপীঠে দেবীর তৃতীয় নয়ন পতিত হয়েছিল। এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী রূপে পূজিতা হন৷ এখানকার ভৈরব ক্রোধীশ নামে পরিচিত, যেটি কিনা শিবের এক ক্রোধান্বিত রূপ।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় শিবহরকরায় সতীপীঠে সতীর তৃতীয় নয়ন পতিত হয়েছিল।
পুরাণে উল্লিখিত শক্তিপীঠগুলির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে শিবহরকরায় । আরেকটি যে সতীপীঠ রয়েছে পাকিস্তানে সেটি হল হিংলাজ দেবীর মন্দির। আমাদের আলোচ্য শিবহরকরায় সতীপীঠে দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী রূপের বিগ্রহ অধিষ্ঠিত রয়েছে। মহিষ থেকে জন্মগ্রহণকারী অসুর দুষ্ট মহিষাসুরকে এই অবতারে দেবী বধ করেছিলেন বলেই এই অবতাররূপটি মহিষাসুরমর্দ্দিনী নামে পরিচিত। এই রূপটির আসল মর্মার্থ, দেবী আসলে মানুষের ভিতরকার রাক্ষসরূপী অহং, অজ্ঞতা, লোভ ইত্যাদি পশু প্রকৃতিকে পরাস্ত করে পথ দেখান৷ মহিষাসুরমর্দ্দিনীর বাহন সিংহ হল মানুষের বীরত্বের প্রতীক।
এই করাভিপুর মন্দিরের দ্বার সব ধর্মের মানুষের জন্যই উন্মুক্ত। ভারত বিভাগের পূর্বে এই মন্দিরে দর্শনার্থীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর। কিন্তু দেশভাগের পর সেই সংখ্যায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। হিন্দুরা এই দেবীকে করভীপুর দেবী হিসেবে পূজা করলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এই দেবীকে ‘ননী’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। এই স্থান মূলত সাপের বা অন্যান্য বিষে আক্রান্ত মানুষদের সারিয়ে তোলার জন্য পরিচিত।
এই শিবহরকরায় সতীপীঠে দেবীমূর্তিটি ধাতুনির্মিত। যদিও বিগ্রহটি খুব বড় আকৃতির নয়। দেবীর বৃহদাকৃতি ধাতব চোখ দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এই সতীপীঠের দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিনী এবং ভৈরব হলেন ‘ক্রোধীশ’। এটি মূলত মহাদেবের এক রাগান্বিত মূর্তি।
করাভিপুরের এই মন্দিরে ভীষণই জাঁকজমক সহকারে দুর্গাপুজাকে কেন্দ্র করে উৎসব পালিত হয়ে থাকে। মূলত নবরাত্রীর সময় নয়দিন ধরে খুবই ধুমধাম করে মহিষাসুরমর্দ্দিনী দেবীকে নতুন রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। মূলত এপ্রিল মাসে চারদিনের একটি তীর্থযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তখন দেশ-বিদেশের নানাপ্রান্ত থেকে অগণিত ভক্ত সেই তীর্থযাত্রায় সামিল হয়ে শিবহরকরায়-এর প্রাঙ্গনে হাজির হন দেবীর দর্শনলাভ করে পুণ্যসঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষায়।