রাস উৎসব

রাস উৎসব

বৈষ্ণবদের আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ, রাধা তাঁর হ্লাদিনী শক্তি। তাঁদের দুজনকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো পৌরাণিক কাহিনী। আর সেইসব কাহিনীর মধ্যে বৈষ্ণবদের কাছে রাসের পৌরাণিক মাহাত্ম্য অনেক বেশি। বৈষ্ণব পদাবলীতে তো সর্বত্র কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলনের কথা, বৃন্দাবনকুঞ্জে অভিসারের কথা এমনকি সখী তথা গোপিনীদের সঙ্গে একত্রে রাসলীলার কথাও আছে। এই সেই রাসলীলা যাকে অনেকে রাসনৃত্যও বলে থাকেন। গোপিনী পরিবেষ্টিত হয়ে রাধা এবং কৃষ্ণের যুগলনৃত্য এবং যুগল মিলনই রাসলীলা নামে পরিচিত। গোপিনীদের নৃত্য আর কৃষ্ণের সুমধুর বাঁশির সুরে মাতোয়ারা এই বিশেষ দিনটি উদ্‌যাপনের জন্যেই প্রতি বছর হিন্দুদের মধ্যে পালিত হয় রাস উৎসব ।

মূলত কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর বিশেষ এই পূর্ণিমা তিথিতে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে তিথিটিকে ‘রাস পূর্ণিমা’ বলা হয়ে থাকে।

‘রস’ শব্দ থেকে ‘রাস’ শব্দের উৎপত্তি। ‘রস’ কথার অর্থ বোঝায় আনন্দ, দিব্যানুভূতি, প্রেমরস ইত্যাদি। বৈষ্ণব দর্শনে বলা হয় শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের আধার। অভিধান অনুসারে ‘রাস’ কথার মানে হল নারী-পুরুষের একত্রে হাত ধরাধরি করে একটা কিছুকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে নৃত্য। হিন্দু শাস্ত্রে বলা আছে যে, শারদ পূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণ যমুনার তীরে তাঁর সমস্ত গোপিনীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গোপিনীদের সঙ্গেই এই দিন কৃষ্ণ বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে নিজেদের কাজ ফেলে সংসারের সকল মোহ ত্যাগ করে গোপিনীরা বৃন্দাবনের সঙ্কেতকুঞ্জে এসে উপনীত হন এবং প্রত্যেক গোপিনী এই দিনে নিজেদের শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে তাঁদের নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে বললেও তাঁদের মনের অচল ভাব লক্ষ্য করে, গোপিনীদের দৃঢ় ভক্তি দেখে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য রাসলীলা করেন তিনি। শ্রীকৃষ্ণ হলেন ত্রি-জগতের পতি, তাঁকে কোনো একক বন্ধনে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। এই সময় গোপিনীরা প্রত্যেকেই কৃষ্ণকে ‘আমার’ ভেবে ভুল করেন আর তাঁদের মনোবাসনা পূরণ করার জন্য কৃষ্ণ নিজেকে গোপিনীদের অনুরূপ সংখ্যায় বিশ্লিষ্ট করে তাঁদের ইচ্ছা পূর্ণ করেন। পুরাণের এই কাহিনী আসলে রূপকের আড়ালে কৃষ্ণ-রূপ পরমাত্মার সঙ্গে গোপিনী রূপ জীবাত্মার মিলনের কথা বলে। শ্রীমদ্ভাগবতে এবং বিষ্ণুপুরাণে শারদ রাসের কথা যেমন আছে, তেমনি ‘হরিবংশ’ ও ভাসের ‘বালচরিত’ গ্রন্থেও তেমনি শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশ নৃত্য করার কথা জানা যায়। এই রাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাসনৃত্যের প্রসঙ্গ। পাঁচ রকম রাসনৃত্যের কথা বলা আছে শাস্ত্রে ও পুরাণে, যেমন – মহারাস, বসন্ত রাস, কুঞ্জ রাস, দিব্য রাস এবং নিত্য রাস। রাধা ও তাঁর সখী তথা গোপিনীদের নিয়ে এই নাচের শুরুতে পুর্বরাগ, মধ্যে মান-অভিমান এবং শেষে মিলনই হল মূল বিষয়বস্তু। রাসের আঙিনায় শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ যেতেন না। পুরাণের এক কাহিনীতে বলা আছে যে, মহাদেব এবং তাঁর স্ত্রী যোগমায়াও একবার এই রাস দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরাও জানতেন যে কৃষ্ণের রাস অন্য কোনো পুরুষ দেখতে পারেন না, তাই ছদ্মবেশে দুজনেই দুজনের অজ্ঞাতে রাস অঙ্গনে এসে হাজির হন। শ্রীকৃষ্ণ এই ঘটনা আগে থেকেই বুঝতে পারেন আর অন্যদিকে যোগমায়া তাঁর ছদ্মবেশী স্বামী মহাদেবকে চিনতে পেরে প্রচণ্ড তিরস্কার করে এই অঙ্গন ছেড়ে চলে যেতে বলেন তাঁকে। ক্ষুব্ধ মহাদেব রাসলীলার পুণ্যভূমি ত্যাগ করে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তার আগে কলিযুগে সকলকে সেই রাসলীলা দেখানোর কঠিন প্রতিজ্ঞা করে গেলেন। বৈষ্ণবরা মনে করেন কলিযুগে অদ্বৈতাচার্যের বেশেই সেই মহাদেব অবতীর্ণ হয়েছেন এই ধরাধামে। পুরাণের ব্যাখ্যায় এই রাসলীলার দার্শনিক এক তাৎপর্য্যের প্রসঙ্গও রয়েছে যেখানে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিন যোগের মিলনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গোপিনীদের সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে পরমাত্মার মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আসলে জ্ঞান যোগ, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির সুর আর গোপিনীদের সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৃত্যের নানাবিধ মুদ্রা তৈরি করেন গোপিনীরা, এগুলি কর্মযোগের দৃষ্টান্ত। সবশেষে সঙ্গীত, নৃত্য, সুর সবের সাহায্যে একত্রে পরমাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনের এই ধারাকে ভক্তিযোগের দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধিকার রাসলীলার উৎসব বঙ্গদেশে প্রথম চালু করেন অদ্বৈতাচার্য। শান্তিপুরে কৃষ্ণ আরাধনার এক বিশেষ অঙ্গ হিসেবে তিনি রাস উৎসবের প্রচলন করেছিলেন বলে জানা যায়। এও কথিত আছে, নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে একটি নারায়ণ শিলা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন অদ্বৈতাচার্য এবং পরবর্তীকালে বিশাখার আঁকা কৃষ্ণের একটি চিত্রপট শান্তিপুরে নিয়ে এসে অনুরূপভাবে মদনমোহন বিগ্রহ তৈরি করেন অদ্বৈতাচার্য। এর পর থেকেই বড়ো গোস্বামী বাড়িতে ধুমধাম করে রাস উৎসবের আয়োজন করা হতে থাকে। ১৮১২ সালে কোচবিহারে ভেটগুড়িতে প্রথম রাসমেলা সূচিত হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় যে, কোচবিহারের রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সময় বৈষ্ণব গুরু শঙ্করদেব এসেছিলেন মদনমোহন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের দর্শনে। জনশ্রুতি রয়েছে যে ১৮১২ সালেই রাসপূর্ণিমার দিন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ প্রবেশ করেন নতুন রাজধানীতে আর সেখানেই তিনি রাসমেলারও সূচনা করেন। বাংলায় রাস উৎসবের এই ইতিহাস উৎসবের তাৎপর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ, শান্তিপুর ইত্যাদি অঞ্চল বহু প্রাচীনকাল থেকেই রাসযাত্রার জন্য বিখ্যাত। এখানকার রাসযাত্রা তথা রাস উৎসবের জনপ্রিয়তার পিছনেই একটি ইতিহাস লুকিয়ে আছে। নবদ্বীপে কীভাবে রাস উৎসব শুরু হল তার ব্যাখ্যা হিসেবে অনেক শ্রীচৈতন্যের উদ্বোধনের কথা বলেন। তবে এই নবদ্বীপের রাস হল ‘শাক্ত রাস’। বিশালাকায় সব মাটির মূর্তি নির্মাণ করে শক্তির আরাধনা করাই নবদ্বীপে রাস উৎসব নামে পরিচিত। অদ্ভুতভাবে এখানকার রাসের সঙ্গে মিশে গেছে তান্ত্রিক আচার-পদ্ধতি। উল্টোদিকে শান্তিপুরের রাস উৎসব চালু করেছিলেন অদ্বৈতাচার্য। তাঁরই হাত ধরে অন্যতম শিষ্য শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে শান্তিপুরে কৃষ্ণের আরাধনা শুরু হয়। আজও রাস উৎসব এলেই রাধা ও কৃষ্ণের যুগল মূর্তি নিয়ে বৈষ্ণবরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহ নগর পরিক্রমা করতে বেরোয়। সোনার অলঙ্কারে সাজানো হয় দুটি মূর্তিই, সঙ্গে মখমলের কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে তাদের গা। আবার উত্তরবঙ্গ জুড়ে কোচবিহারের মদনমোহন জীউর মন্দিরকে কেন্দ্র করে রাস উৎসবের ঢল নামে। কোচবিহারের মদনমোহনের মন্দিরে আজও রাস উৎসবের সময় পুরোহিত আগে ঘুরিয়ে দেন রাসচক্র, তারপর সাধারণ দর্শনার্থী ও ভক্তরা এই রাসচক্র ঘুরিয়ে পুণ্য অর্জন করে থাকেন। বৈষ্ণবদের এই বিশেষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গের মতো বৃন্দাবন, মথুরাতেও বেশ জনপ্রিয়। বহু ভক্ত এই সময় শান্তিপুর, নবদ্বীপ কিংবা কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরে ভিড় করেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকার দর্শনের ইচ্ছায়।

One comment

আপনার মতামত জানান