স্বর্ণকুমারী দেবী (Swarnakumari Devi) ছিলেন প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঙালী লেখিকাদের মধ্যে একজন।তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালী মহিলা ঔপন্যাসিক। এছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার এবং সমাজসেবী। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দশম সন্তান এবং রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ দিদি। দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদা দেবীর মেয়েদের মধ্যে তিনিই কনিষ্ঠা। বাংলার অনাথ শিশু এবং বিধবাদের কাছে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে ১৮৫৫ সালের ২৮ আগস্ট স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম হয়। তাঁর বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য মনীষী ছিলেন।
তাঁর দিদি সৌদামিনী দেবী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম ছাত্রীদের একজন। তাঁর অন্যান্য দিদিরাও পরবর্তীকালে সেই স্কুলেই শিক্ষালাভ করেন; যদিও স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এর ব্যতিক্রম। রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও গৃহশিক্ষকের কাছে বাড়িতেই শিক্ষালাভ করেন। দেবেন্দ্রনাথও প্রথাগত পদ্ধতিতে শিক্ষালাভের পক্ষপাতী ছিলেন না। ফলে তিনি সুযোগ্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্বর্ণকুমারীর অন্যতম গুণ ছিল তিনি শৈশবেই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে ও বন্ধুত্ব পাতাতে পারতেন।
ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি মনোভাব স্বর্ণকুমারী দেবীকেও প্রভাবিত করেছিল। দাদা জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চর্চা তাঁকে এই বিষয়গুলির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।
‘জ্যোতিরীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে জ্যোতিরীন্দ্রনাথ স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্যানুরাগের কথা উল্লেখও করেছেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যেভাবে তৎকালীন সমাজে মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ ভাঙতে শুরু করেছিলেন, সেই ঘটনাই সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী।
১৮৭৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বান’ প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালী মহিলা ঔপন্যাসিক। এর আগে ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হানা ক্যাথরিন মুলেন্স রচিত উপন্যাস ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। ‘দীপনির্বান’ উপন্যাসটি ছিল জাতীয়তাবোধে সম্পৃক্ত। এরপর তিনি ‘মেবার রাজ’ (১৮৭৭), ‘ছিন্ন মুকুল’ (১৮৮৯), ‘বিদ্রোহ’ (১৮৯০), ‘কাহাকে?’ (১৯৯৮), ‘মিলনরাতি’ (১৯২৫) -এর মত বহু সংখ্যক উপন্যাস, ‘গাথা’, ‘গীতিগুচ্ছ’ -এর মত কবিতাগ্রন্থ, ‘কনে বদল’, ‘রাজকন্যা’ -এর মত নাটক, বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা, ‘পৃথিবী’ -এর মত প্রবন্ধ এবং অজস্র গান রচনা করেন। ১৮৭৯ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা ভাষায় অপেরা ‘বসন্ত উৎসব’ রচনা করেন। তিনি বৈজ্ঞানিক শব্দসমূহের বাংলা ভাষান্তরে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তাঁর ‘মেবার রাজ’ উপন্যাসটি খুবই সমাদৃত হয়েছিল।
১৮৭৭ সালে জ্যোতিরীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ঠাকুরবাড়ি থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। প্রথমে প্রায় সাত বছর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পত্রিকাটির সম্পাদনা করার পর স্বর্ণকুমারী পত্রিকা সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। তিনি প্রায় এগারো বছর এই পত্রিকাটির সম্পাদিকা ছিলেন এবং নিরলসভাবে এটির নিজস্বতার প্রকাশ ঘটাতে উদ্যোগী হন। এরপর পত্রিকাটি বারো বছর তাঁর মেয়েরা এবং একবছর রবীন্দ্রনাথও সম্পাদনা করেন। এরপর প্রায় নয় বছর পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ ছিল এবং তারপর স্বর্ণকুমারী পুনরায় দুই বছর সম্পাদনার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবৎ প্রকাশিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও স্বর্ণকুমারীর উপস্থিতি দেখা যায়। তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সম্পাদক। সেই সূত্রেই ১৮৮৯-১৮৯০ সালে স্বর্ণকুমারী দেবী জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন। ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ১৮৯৬ সালে তিনি ‘সখি সমিতি’ আরম্ভ করেন। এই নামটি দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিলো অসহায় বিধবা এবং অনাথ শিশুদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তিনি বিধবাদের শিক্ষা এবং কাজের পরিসর সৃষ্টির ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হন। এই সমিতি অর্থের জোগানের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর বেথুন কলেজে একটি মেলার আয়োজন করত। ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর এবং বীরভূমের হস্তশিল্প, বেনারস, মোরাদাবাদ, আগ্রা, কাশ্মীর, বোম্বাই সহ দেশের বিভিন্ন স্থানের হস্তশিল্পে ভরে উঠত এই মেলা। স্বর্ণকুমারী এই মেলার মাধ্যমে চেয়েছিলেন স্বদেশের শিল্পের উন্নতি। তৎকালীন সময়ে এই মেলা মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এই মেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য প্রথম অভিনীত হয়।
১৯০৬ সাল পর্যন্ত স্বর্ণকুমারী দেবীর উদ্যোগেই এই সমিতি চলেছিল। পরবর্তীকালে তাঁরই অনুপ্রেরণায় বিধবাদের সাহায্যার্থে হোম গড়ে ওঠে।
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ সম্মানে ভূষিত করে।
স্বর্ণকুমারী দেবীর ১৮৬৮ সালে নদীয়া জেলার জমিদার বংশোদ্ভুত জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে বিবাহ হয়। জানকীনাথকে ‘রাজা’ উপাধিতেও ভূষিত করা হয়েছিল এবং তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তাঁদের তিনজন সন্তান ছিলেন যথাক্রমে হিরণ্ময়ী দেবী, জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল এবং সরলা দেবী চৌধুরানী।
১৯৩২ সালের ৩ জুলাই কলকাতায় ছিয়াত্তর বছর বয়সে স্বর্ণকুমারী দেবীর মৃত্যু হয়। পরাধীন ভারতে নারী স্বাধীনতার বিকাশে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
তথ্যসূত্র
- https://en.m.wikipedia.org/
- /https://www.shethepeople.tv/
- http://onushilon.org/
- http://www.streeshakti.com/
