হার্ট অ্যাটাক হলে বুঝবেন কীভাবে

হার্ট অ্যাটাক হলে বুঝবেন কীভাবে

বয়স চল্লিশের কোঠায় পৌঁছালেই হাজারো একটা রোগ এসে ঘিরে ধরে আমাদের অনেককে। চলে আসে খাওয়া-দাওয়ার কঠোর নিয়ন্ত্রণ। মেদ বাড়ে, রেড মিট খাওয়া কমাতে হয়। ধূমপান, মদ্যপানের আসক্তি ত্যাগ করার পরামর্শ তো প্রায় বেশিরিভাগ মানুষই ডাক্তাদের কাছ থেকে পেয়ে থাকেন। কিন্তু কেন এতটা সতর্ক হতে হয় আমাদের? আসলে আমাদের শরীরেই এক নিঃশব্দ ঘাতক বাস করে যে একবার জেগে উঠলেই মৃত্যু নিশ্চিত। হার্ট অ্যাটাক। হঠাৎ করে হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করে দেয়, মাথায় রক্ত পৌঁছায় না আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু অনেকসময়ই বোঝা যায় না যে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা। ফলে সমস্যা আরো বাড়ে। যেটুকু সময় পাওয়া যেতো সুস্থ হওয়ার বা উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করার তাও পাওয়া যায় না। অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নেমে আসে। তাহলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে কারো হার্ট অ্যাটাক হলে কীভাবে বুঝবেন? চলুন আজকেই জেনে নেওয়া যাক এই অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নটির উত্তর।

আমাদের শরীরে যা কিছুই ঘটুক না কেন তার একটা প্রকৃত কারণ থাকে এবং শরীর নিজস্ব নিয়মে সেই ঘটনার আগাম সংকেত দিতে থাকে যেগুলিকে আমরা ডাক্তারি ভাষায় লক্ষণ (Symptom) বলে থাকি। এই লক্ষণগুলি চিনতেই অনেকসময় আমরা ভুল করি। তার ফলেই জটিলতা বাড়ে। যত দিন যাচ্ছে প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে, আমাদের জীবনযাপন অত্যন্ত ব্যস্ত এবং দুশ্চিন্তাযুক্ত হয়ে উঠছে, ততই দেখা যাচ্ছে হার্ট অ্যাটাকের সমস্যা বেড়েই চলেছে। তাই আগে প্রাথমিকভাবে জেনে নেওয়া দরকার হার্ট অ্যাটাক আসলে কী? ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন (Miocardial Infraction)। হার্ট বা আমাদের হৃদযন্ত্রের কাজ হল পাম্পের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত সরবরাহ করা। রক্তসংবহনতন্ত্রের প্রধান কেন্দ্র হল এই হৃদপিণ্ড। এর মধ্যে রয়েছে শিরা, রয়েছে অনেক ধমনীও। কার্যগত দিক থেকে বলা যায়, এই রক্তবাহী ধমনীগুলির মধ্যে যদি কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি হয় তাহলে হৃদপিণ্ডে রক্ত পৌঁছাতে পারে না আর তখনই হৃদপিণ্ড কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এই অবস্থাকেই বলা হয় হার্ট অ্যাটাক। মূলত রক্ত সংবহনের অভাবের কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়।

বিভিন্ন কারণে এই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল জমে গেলে তা রক্তবাহ ধমনীর প্রাচীরে একটা দেয়াল তৈরি করে দেয় যার ফলে অনেক কম রক্ত সেই ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, এর ফলে হৃদপিণ্ডে রক্ত কম পৌঁছায়, মস্তিষ্কেও অক্সিজেন কম প্রবাহিত হয়। একে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে ‘এথেরোস্ক্লেরোসিস’ (Aetherosclerosis)। এই সমস্যা যদি স্থায়ী হয়ে যায় তবে একে চিকিৎসকেরা করোনারি হার্ট ডিজিজ (Coronary Heart Disease) বলে থাকেন। এমনকি করোনারি ধমনী ফেটে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তপ্রবাহের কারণেও হার্ট অ্যাটাক দেখা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইডের উপস্থিতি, বেশি মাত্রায় দুশ্চিন্তা, ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস, ডায়াবেটিস, অধিক মেদ ইত্যাদি কারণগুলি হার্ট অ্যাটাকের জন্য বেশিমাত্রায় দায়ী। এ তো গেল হার্ট অ্যাটাকের একেবারে প্রাথমিক কিছু তথ্য। কিন্তু আসল বিষয় হল কোন কোন লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন হার্ট অ্যাটাকের ব্যাপারে বা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা সেটাই বা তৎক্ষণাৎ বুঝবেন কীভাবে? প্রথমত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল হঠাৎ অতিরিক্ত পরিমাণে ঘামতে শুরু হওয়া। হৃদপিণ্ডে কোনো ব্লক বা বাধা সৃষ্টি হলে হৃদপিণ্ড তখন সচল থাকার জন্য বেশিমাত্রায় কাজ করে আর তাই অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলেই ঘাম দেখা দেয়। বেশিরভাগ সময় হার্ট অ্যাটাক হলে বুকের বাঁদিকে অসম্ভব ব্যথা হয়, একটা ভারী চাপ অনুভূত হয়। একটা ঝাঁকুনি লাগে বুকের মধ্যে। এই চাপ অনুভূত হওয়াটাই হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ। খুব মারাত্মক রকমের চাপ হলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। নাহলে হার্টের সমস্যা থাকলে মাঝে মাঝেই এই চাপ ঘুরে ফিরে অনুভূত হয়। শ্বাসপ্রশ্বাসও এই সময় খুব কমে আসে, ছোটো ছোটো শ্বাস-প্রশ্বাস চলতে থাকে আর সমস্যাজনক শ্বাস-প্রশ্বাস দেখা যায়। শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, ঘন ঘন শ্বাস পড়ে, হৃদ্‌স্পন্দনের গতি বেড়ে যায় বা কমেও যেতে পারে। অনেকসময় শুধু বুকে ব্যাথার বদলে পেটের উপরের অংশে, কাঁধে বা পিঠে বা বাঁ হাতে ব্যাথা দেখা দিতে পারে। তবে পুরুষ বা মহিলার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকেরা লক্ষ করে দেখেছেন, পুরুষদের ক্ষেত্রে বাঁ হাত বা বাঁ দিকের চোয়ালে ব্যথা হতে পারে, কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ব্যথা কাঁধ, ঘাড়, তলপেট বা হাতে ব্যথা হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পন্থা অবলম্বন করলে চিকিৎসা করার সময় অনেকটাই বেড়ে যায় এবং তাতে মৃত্যুর ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। রোগের লক্ষণ বুঝে চিকিৎসা করান যেমন প্রয়োজনীয়। হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে সমগ্র পৃথিবীতে প্রচলিত পদ্ধতিটি হল সিপিআর (CPR) অর্থাৎ কার্ডিয়োপালমোনারি রিসাসিটেশন (Cardiopulmonary Resuscitation)। তাছাড়া যদি প্রাথমিভাবে অ্যাসপিরিন খাওয়ানো যায় তাহলে রোগী অনেকটা সামলে উঠতে পারেন। এক্ষেত্রে দেখে নিতে হবে রোগীর তাতে অ্যালার্জি আছে কিনা। অনেকসময়ই তা জানা সম্ভব হয় না, তাই সিপিআরই শ্রেষ্ঠ উপায়। হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে ডাক্তারের কাছে বা অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার আগে রোগীকে প্রথমে বিশ্রাম অবস্থায় শান্তভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসাতে হবে। এক্ষেত্রে রোগীর ঘাড়, মাথা ও কাঁধ হেলান দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসতে হবে যাতে রোগীর রক্তচাপ কমে স্বাভাবিক হতে পারে। সিপিআর করতে গেলে প্রথমে রোগী রিল্যাক্সড হলে তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে। যেহেতু হার্ট অ্যাটাকের ৩০ থেকে ৪০ সেকেণ্ডের মধ্যে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন না পৌঁছানোয় রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন এবং খুব দেরি করলে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ হতে পারে। তাই প্রথমে রোগীর থুতনি উপরের দিকে তুলে তার শ্বাসনালির পথ খুলে দিতে হবে, নাক-মুখ ও গলার ভিতর পরিস্কার আছে কিনা দেখে নিতে হবে যাতে রোগী ভালোমতো শ্বাস নিতে পারেন। তারপর অন্য একজন কাউকে রোগীর পাশে বসে` বুকের উপর একটা হাতের তালু মাঝ বরাবর রাখতে হবে এবং তার উপর আরেকটি হাত রেখে সেই হাতের আঙুল দিয়ে নিচের হাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। এভাবে হাত দিয়ে রোগীর বুকে সোজাভাবে এমন চাপ দিতে হবে যাতে প্রতি মিনিটে ১০০-১২০ টি চাপ পড়ে। দেখে নিতে হবে চাপ এমনভাবে দিতে হবে যাতে বুকের পাঁজর মোটামুটিভাবে দুই-আড়াই ইঞ্চি নামে। এইরকম তিরিশটি চাপ দেওয়ার পরে রোগীর মুখে মুখ রেখে জোরে ফুঁ দেওয়া যেতে পারে। রোগীর জ্ঞান ফিরলে তাকে একপাশে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে যাকে ‘রিকভারি পজিশন’ (Recovery Position) বলা হয়। এই পদ্ধতি কেবলমাত্র হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলে তবেই করতে হবে। অন্যথায় রোগীর পোশাক-আশাক ঢিলেঢালা করে দিতে হবে, শ্বাস নিতে পারেন যাতে রোগী তা দেখতে হবে। এই বিষয়গুলি মাথায় রাখলে হার্ট অ্যাটাকের মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যেতে পারে।

One comment

আপনার মতামত জানান