নিঃশব্দ ঘাতক বলা হয় স্ট্রোককে। এক আঘাতেই যে কোনো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে সেরিব্রাল স্ট্রোক। হার্ট অ্যাটাকের মতো এটিও একটি প্রাণঘাতী বিপর্যয়। চিকিৎসার সময়টুকুও অনেকক্ষেত্রে পাওয়া যায় না স্ট্রোক হলে। ফলে রোগীকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ের ব্যস্ততাপূর্ণ দুরন্ত গতির জীবনে হাজার রকমের মানসিক চাপ এবং আরো নানা কারণে প্রায়শই স্ট্রোকের ফলে মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু এর স্পষ্ট কারণ বা প্রতিকারের আপদকালীন উপায় সম্পর্কে আমরা অনেকেই ওয়াকিবহাল না হওয়ায় রোগীর জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। এর আগে আমরা লিখেছি হার্ট অ্যাটাক হলে বুঝবেন কীভাবে আসুন আজ জেনে নিই স্ট্রোক হলে বুঝবেন কীভাবে। এমন কী কী লক্ষ্মণ আছে যা দেখে আগাম সতর্কতা নেওয়া যেতে পারে বা স্ট্রোক হওয়ার পরে রোগীর আপদকালীন চিকিৎসা কীরূপ হওয়া উচিত তা সবই জেনে নেব আজ।
অনেকেই হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোককে একত্রে গুলিয়ে ফেলেন। দুটি কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন বিষয়। হার্ট অ্যাটাক হৃদপেশীতে রক্ত না পৌঁছানোর সমস্যা আর স্ট্রোক হল মস্তিষ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই একে ডাক্তারি পরিভাষায় ‘সেরিব্রাল স্ট্রোক’ বলা হয়। মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে কোনো ধমনীতে ব্লকেজ থাকলে বা কোনো রক্তবাহী নালী ফেটে অতিরক্ত রক্তক্ষরণ হলে সাধারণভাবে স্ট্রোক হয়ে থাকে। তাছাড়া কোনো কারণে কিছু সময়ের জন্য মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীগুলিতে রক্ত প্রবাহিত না হলেও স্ট্রোক দেখা দিতে পারে। স্ট্রোকের কারণের ভিত্তিতে একে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে – ইস্কিমিক স্ট্রোক (Ischemic Stroke), হেমারেজিক স্ট্রোক (Haemaragic Sroke) এবং টিআইএ অর্থাৎ ট্র্যান্সিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক (Transient Ischemic Attack)। মূলত উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ ইত্যাদি রোগের কারণে মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে কিংবা রক্তবাহী নালীর মধ্যে কোলেস্টেরল, ফ্যাট ইত্যাদি জমে গেলে সেই সঞ্চিত ফ্যাটের ডেলা ধমনীর মধ্যে আটকে গিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় আর অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের কোষগুলি কাজ করা বন্ধ করে দিতে থাকে। এটিই স্ট্রোকের একেবারে প্রাথমিক ঘটনা। ইস্কিমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রক্ত-প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে যায় আর হেমারেজিক স্ট্রোকে দেখা যায় মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তনালী ফেটে অধিক রক্তক্ষরণ ঘটে যায়। স্ট্রোকের ক্ষেত্রে কোনো বয়সের সীমারেখা নেই।
সাধারণভাবে দেখা গেছে হঠাৎ করে যদি কোনো ব্যক্তির প্রচন্ড মাথাব্যথা, খিঁচুনি বা কথা জড়িয়ে যাওয়া, মুখ একদিকে বেঁকে যাওয়া কিংবা শরীরের এক দিক সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষ্মণ দেখা দিলে নিশ্চিতভাবেই তা স্ট্রোককে ইঙ্গিত দেয়। মুখের কোনো অংশ অবশ হয়ে যেতে পারে, কথা বা আচরণে অসংলগ্নতা দেখা দিতে পারে কিংবা গণনার স্বাভাবিক ক্ষমতা যদি হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায় সেক্ষেত্রেও তা স্ট্রোকের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্মণ। চোখে অন্ধকার দেখা, কয়েক মিনিট কথা আটকে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এগুলি ‘টিআইএ’-র লক্ষ্মণ। একে মিনি স্ট্রোক বা মাইল্ড স্ট্রোক বলা হয়। চোখে দেখার ক্ষেত্রে ঝাপসা দেখা বা কোনো জিনিস দুটো করে দেখা (Double Vision), মুখ থেকে যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে লালা বেরোতে থাকে কিংবা কোনো ব্যক্তি যদি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান সেক্ষেত্রে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্রোকের চিকিৎসা করা উচিত। এই সব লক্ষণগুলিকে চিনতে পারলেই স্ট্রোকের ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এর মধ্যেই চিকিৎসা করে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব। কী এই গোল্ডেন আওয়ার? চিকিৎসকেরা বলেন, স্ট্রোক ঘটে যাওয়ার পর সাড়ে চার ঘন্টা সময়ই হল গোল্ডেন আওয়ার। এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রোগীর চিকিৎসা করতে পারলে অনায়াসে রোগীকে প্রাণঘাতী স্ট্রোকের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলা যায়। স্ট্রোক সময় দেয় না, তাই স্ট্রোক ঘটেছে এমন কারো ক্ষেত্রে কোনোরকম দেরি না করে খুব দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। যত দ্রুত তা করা যাবে, তত রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা বাড়বে। নিউরো-ইন্টারভেনশন পদ্ধতিতে চিকিৎসকেরা মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর রুদ্ধ পথ উন্মুক্ত করে দেন।
স্ট্রোক হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার আগে খুব যত্নের সঙ্গে রোগীকে একদিকে কাত করে শুইয়ে দিতে হবে। রোগীকে এই সময় কিছু না খাওয়ানোই ভালো। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক আছে কিনা তা নজরে রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে যদি রোগীর মুখের এক দিক বেঁকে যায়, সেক্ষেত্রে তার কানে সময় নিয়ে ম্যাসাজ করে যেতে হবে যতক্ষণ না কান লাল হচ্ছে। তাছাড়া সূঁচ পুড়িয়ে ও তা জীবাণুমুক্ত করে হাতের দশ আঙুলের যেকোনো আঙুলের ডগার উপর ফুটিয়ে কিছু পরিমাণ রক্ত বের করে দিলে অনেক সময় রোগী কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে অভিজ্ঞতা না থাকলে বা আত্মবিশ্বাস না থাকলে অদক্ষ হাতে এই কাজ না করাই উচিত। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সবার প্রথমে এমআরআই (MRI) ও সিটি স্ক্যান (CT Scan) করাতে হবে যাতে মস্তিষ্কের কোষগুলির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। সবশেষে, সময় বাঁচানোটাই স্ট্রোক থেকে রোগীকে বাঁচানোর প্রধান চাবিকাঠি। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত রোগীর সুস্থতার সম্ভাবনা বাড়বে।