ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) হল একধরণের এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব। এদের কোষগুলি প্রো-ক্যারিওটিক পর্যায়ভুক্ত অর্থাৎ এগুলি আদি কোষ এবং এই ধরণের কোষের ভিতরে কোন কোষীয় বস্তুর (যেমন নিউক্লিয়াস, মাইটোকনড্রিয়া ইত্যাদির) কোন আবরণ থাকে না। অনুমান করা হয় জীব বিবর্তনের ইতিহাসে ব্যাকটেরিয়া একদম প্রথমের দিকে সৃষ্টি হয়েছিল।

ব্যাকটেরিয়া শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘ব্যাকটেরিয়াম’-এর বহুবচন যার অর্থ বেত (cane) কারণ প্রথম আবিষ্কৃত ব্যাকটেরিয়া রড এর মত আকারের ছিল। ১৬৭৬ সালে অ্যান্টনি ফন লিউয়েনহুক (Antonie van Leeuwenhoek ) নিজের তৈরি অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সর্বপ্রথম ব্যাকটেরিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। পরবর্তীকালে ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রিড এহরেনবার্গ (Christian Gottfried Ehrenberg) ১৮২৮ সালে ব্যাকটেরিয়াম শব্দটি ব্যবহার করেন।

ব্যাকটেরিয়া জল, স্থল, অন্তরীক্ষ প্রায় সর্বত্র আছে – এবং চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। ব্যাকটেরিয়ার বহু অনাবিষ্কৃত প্রজাতি আছে বলেও অনুমান করা হয়। প্রাথমিকভাবে ব্যাকটেরিয়াকে ক্ষতিকর মনে করা হলেও বর্তমানে দেখা গেছে জীবজগৎ ভীষণভাবে ব্যাকটেরিয়ার উপর নির্ভরশীল – যেমন, মাটিতে নাইট্রোজেন সংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়া রাইজোবিয়াম বা ভিটামিন বি-১২ সংশ্লেষকারী ব্যাকটেরিয়া যা প্রাণীকোষের জন্য ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ব্যাকটেরিয়ার আকার মোটামুটি ০.৫ – ৫ মাইক্রোমিটার হয়। তবে কিছু প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া খালি চোখেও দেখা যায়, যেমন ‘থিওমারগারিটা নামিবেইনসিস’ দৈর্ঘ্যে ০.৫ মিলিমিটার ও ‘এপুলোপিসিয়াম ফিশেলসোনি’ দৈর্ঘে ০.৭ মিলিমিটার হয়। খুব ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়াদের ‘মাইকোপ্লাজমা’ পর্যায়ে ফেলা হয় এবং এদের আকার ০.৩ মাইক্রোমিটার মত হয় যা বড় আকারের ভাইরাসের থেকে ছোট।

ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষপর্দার ভিতরে সাইটোপ্লাজম ও অন্যান্য কোষীয় অঙ্গাণু থাকে তবে কোষীয় অঙ্গাণুগুলির কোন পর্দা থাকে না। এদের সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে না এদের ডিএনএ(DNA) অসঙ্গঠিত অবস্থায় থাকে এবং তাকে নিউক্লিওয়েড বলে। কোষপর্দার বাইরে কোষপ্রাচীর থাকে। কোষপ্রাচীরের গঠন বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। কোষপ্রাচীরের গঠনের উপর ভিত্তি করে এদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- গ্রাম পজিটিভ এবং গ্রাম নেগেটিভ। গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরে অনেকগুলি স্তর থাকে এবং এগুলি পুরু হয় – এরা রঞ্জক পরীক্ষায় বেগুনি বর্ণ ধরে রাখে। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার কোষপ্রাচীরে কম স্তর থাকে এবং এগুলি পাতলা হয় – এরা রঞ্জক পরীক্ষায় বেগুনি বর্ণ ধরে রাখতে পারে না। প্রসঙ্গত, রঞ্জকের রঙ ধরে রাখার ক্ষমতার জন্যই পজিটিভ বা নেগেটিভ নামকরণ।

রঞ্জন পদ্ধতি ছাড়াও ব্যাকটেরিয়ার আকৃতির উপর ভিত্তি করেও ভাগ করা হয়, যেমনঃ

  • কক্কাস  – গোলাকার আকৃতির
  • ব্যাসিলাস – দন্ডাকার ব্যাকটেরিয়া
  • স্পাইরিলাম – সর্পিল আকৃতির ব্যাকটেরিয়া
  • ভিব্রিও – কমার মত।

ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব জীবজগতে অপরিসীম। প্রাথমিকভাবে ব্যাকটেরিয়াকে ক্ষতিকর মনে করা হলেও পরবর্তীকালে প্রচুর পরিমাণে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কথাও জানা গেছে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া হিসেবে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার কথা বলা যায় যেমন, কলেরা (Vibrio cholerae. ), টিটেনাস (Clostridium tetani), কুষ্ঠ (Micobacterium lepra), যক্ষা (Mycobacterium tubeculosis), টাইফয়েড (Salmonella) ইত্যাদি। ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। শুধু মানুষই নয়, বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদেও রোগ সৃষ্টির জন্য এদের প্রভাব আছে।

আবার অনেক উপকারী ব্যাকটেরিয়াও আছে, যাদের বিভিন্ন শিল্পেও ব্যবহার করা হয়। যেমন ল্যাকটোব্যাসিলাস, ল্যাকটোকক্কাস ইত্যাদি দই, চীজ ইত্যাদি দুগ্ধজাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জৈব পদ্ধতিতে গাছের বিভিন্ন রোগ প্রতিকারে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এও ব্যাকটেরিয়া ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

শুধুমাত্র ব্যাকটেরিয়া নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য বিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা ব্যাকটেরিওলজি আছে এবং বলা হয় ফার্দিনান্দ কন ( Ferdinand Cohn ) এই শাখার প্রতিষ্ঠাতা। পল এহরলিখ (Paul Ehrlich) ১৯১০ সালে প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেন। পরবর্তীকালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে অনেক ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

আপনার মতামত জানান