তন্দুর হত্যা মামলা

তন্দুর হত্যা মামলা

ভারতীয় বিচারালয়ের নানাবিধ মামলার ইতিহাস ঘাঁটলে কিছু নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা বেরিয়ে আসবে। সেই তালিকায় অবশ্যই থাকবে দিল্লির এক ভয়াবহ হত্যাকান্ড এবং তাকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলার কথা। নয়াদিল্লির প্রাক্তন যুব কংগ্রেস সভাপতি সুশীল শর্মা পরকীয়া সন্দেহে ক্রোধবশত নিজের স্ত্রী নয়না সাহানিকে হত্যা করেন। পরে নৃশংসভাবে সেই শরীর টুকরো টুকরো করেন এবং এক রেস্তোরাঁয় কর্মরত বন্ধুর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তন্দুরে সেই টুকরো ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এই কারণেই এই হত্যা তন্দুর হত্যা মামলা নামে খ্যাত। প্রথমে ট্রায়াল কোর্ট সুশীল কুমার ও তাঁর বন্ধু দুজনকেই মৃত্যুদন্ড দিলেও কেসটি হাইকোর্ট এবং সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছেছিল। শেষে অবশ্য মৃত্যুদন্ডের আদেশ রদ করে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি ঘোষণা করেছিল।

এই তন্দুর হত্যা মামলা র মূল অপরাধী ছিলেন সুশীল শর্মা এবং তাঁর বন্ধু বাগিয়া বারবিকিউ রেস্তোরাঁর কর্মচারী কেশব কুমার। ১৯৯২ সাল নাগাদ সুশীল শর্মা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক তিনি৷ নয়না সাহানিও ছিলেন সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। নয়না আবার দিল্লি যুব কংগ্রেস গার্লস উইংয়ের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নয়না সাহানি প্রায়শই যুব কংগ্রেসের অফিসে সুশীল শর্মার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সভাপতি থাকার সময়তে, ১৯৯২ সালেই সুশীল মন্দির মার্গে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন। সেই ফ্ল্যাটে নয়না সাহানির যাতায়াত শুরু হয়, এমনকি কখনও কখনও সেখানে রাত্রিযাপনও করতেন নয়না। শোনা যায়, তাঁরা নিজেদের মতো করে বিয়েও করেছিলেন কিন্তু এই বিবাহের খবরটি গোপন রেখেছিলেন সুশীল। উভয় পক্ষেরই এই বিবাহতে সম্মতি ছিল, এমনকি নয়নার বাবা-মা-ও রাজি ছিলেন এতে। এরপর থেকে সুশীলের স্ত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে সেই ফ্ল্যাটেই থাকতে শুরু করেন নয়না। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় সুশীল শর্মা তাদের বিয়েকে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন যা নয়না সাহানি মেনে নেননি। অপরদিকে সুশীল শর্মাও স্ত্রী-এর চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন, ফলত, নয়নার স্বাধীনতা সীমিত করে দেন তিনি। প্রতিবেশীদের থেকে জানতে পারা যায় যে, সুশীল নাকি নয়নাকে মারধর পর্যন্ত করতেন। এমনকি নিজের চাকরকে স্ত্রীয়ের পিছনে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য লাগিয়ে দিয়েছিলেন সুশীল শর্মা। জানা যায় যে, বৈবাহিক জীবন ভীষণই তিক্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণে নয়না কংগ্রেসেরই এক সহকর্মী মাতলুব করিমের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন।

বিবাহের তিনবছর পর ১৯৯৫ সালের ২ জুলাই সুশীল শর্মা মন্দির মার্গের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেখেন নয়না মদ্যপান করছেন এবং ফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন। হঠাৎ সুশীলকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে নয়না ফোন কেটে দেওয়ায় সন্দেহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে সুশীল শর্মার। তৎক্ষনাৎ তিনি ফোন তুলে নিয়ে শেষ নম্বরটি ডায়াল করে দেখেন অপরদিকে মাতলুব করিম ফোন ধরেছেন। এরপরই রাগে যেন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সুশীল। লাইসেন্স করা নিজের রিভলবারটি বের করে নয়নাকে পরপর তিনটি গুলি করেন। যদিও দুটি গুলি নয়নার মাথায় ও ঘাড়ে লাগে এবং একটি গুলি ফসকে গিয়ে লেগেছিল এয়ার কন্ডিশনারে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় নয়নার৷ মৃতদেহটিকে এরপর একটি কালো প্লাস্টিকে ঢেকে মারুতি গাড়ির ডিকিতে ভরে নিয়ে যান বাগিয়া বার-বি-কিউ নামের রেস্তোরাঁয়। বহু টুকরো করেন সেই মৃতদেহটির। রেস্তোরাঁর কর্মচারী, যিনি কিনা এই মামলার সহ-অভিযুক্ত, কেশব কুমারের সাহায্যে তারপর শরীরের টুকরোগুলিকে তন্দুরে ফেলে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

বারবিকিউতে লাশ ফেলায় প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া এবং আগুন হয়, ফলে তা রাস্তার পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অস্বাভাবিক আগুন এবং ধোঁয়া দেখে একজন পুলিশ কনস্টেবল রিপোর্ট করলে পুলিশ রেস্তোরাঁয় গিয়ে পৌঁছয়। সুশীল শর্মা সেই স্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছেন তখন। পুলিশ তখন তন্দুরের মধ্যে মানবদেহের অংশ খুঁজে পেলে, এবং ছিন্নভিন্ন, অন্ত্র বেরিয়ে পড়া এক মহিলার দেহাংশ বলে বুঝতে পারলে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে রক্তমাখা কালো প্লাস্টিক খুঁজে পায় পুলিশ, কেশবের জামাতেও পায় রক্তের দাগ। ফলে অপরাধে সাহায্য করার জন্য এবং অপরাধীকে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে কেশবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৯৯৫-এর ৪ জুলাই মন্দির মার্গের ফ্ল্যাট থেকে .৩২ রিভলবারের বুলেট, পাঁচটি ফায়ার কার্টিজ কেস এবং রক্তের দাগযুক্ত কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল।  অপরদিকে সুশীল শর্মা জয়পুর, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর বিভিন্ন শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১০ জুলাই তিনি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। শুরু হয় তন্দুর হত্যা মামলা ।

এলএইচএমসি দিল্লিতে নয়না সাহানির পোড়া মৃতদেহের প্রথম ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল অগ্নিসংযোগেই মৃত্যু হয়েছে। পরে দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর দ্বিতীয় আরেকটি পোস্টমর্টেমের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই দ্বিতীয় ময়নাতদন্তটি টিডি ডোগরার নেতৃত্বে তিনটি ভিন্ন হাসপাতালের তিনজন ডাক্তারের একটি দল পরিচালনা করেছিল৷ তারা নয়নার মাথায় এবং ঘাড়ের কাছে দুটি গুলি শনাক্ত করেছিলেন এবং তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল যে, আগ্নেয়াস্ত্রের কারণেই নয়নার মৃত্যু হয়। এই দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএর প্রমাণের ফলে তদন্তের গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল সম্পূর্ণ। দিল্লি পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে এবং ১৯৯৫ সালের ২৭ জুলাই দায়রা আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ২০০৩ সালের ৭ নভেম্বর সুশীল শর্মাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল এবং সহ-অভিযুক্ত কেশব কুমারের সাতবছর সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারপতি। এরপর সুশীল শর্মা ২০০৩ সালেরই ডিসেম্বরে দিল্লি হাইকোর্টে জেলা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন।

ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী একটি অপরাধমূলক কাজ একাধিক ব্যক্তি মিলে সম্পন্ন করলে, প্রত্যেকেই সেই কাজের জন্য এমনভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন যেন একজনই সেই অপরাধটি করেছে। আবার দন্ডবিধির ৩৭ ধারা অনুযায়ী, অন্যের অপরাধমূলক কর্মে সহায়তাকারীকেও অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে। কেশব কুমারের ক্ষেত্রে এই ধারাটি প্রযোজ্য ছিল। এছাড়াও অপরাধী সুশীলকে আড়াল করার জন্য এবং তন্দুরে শরীর পোড়ানোর বিষয়ে প্রাথমিকভাবে মিথ্যে কথা বলার অপরাধে ২০১ ধারার অধীনে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল৷ সুশীল কুমারকে রেস্তোরাঁ থেকে পালাতে সাহায্য করে তাঁকে আইনী শাস্তি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন বলে ২১২ ধারানুসারে কেশব কুমারের শাস্তি প্রাপ্য ছিল। আবার ১২০ বি ধারাতেও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি দন্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী যে কোনো হত্যাকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড এবং জরিমানাও দিতে হবে। সেই বিধি অনুসারে ট্রায়াল কোর্ট সুশীল কুমারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিল। ফলে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায়েও তাঁর মৃত্যুদন্ড বহাল ছিল। হাইকোর্টের বক্তব্য ছিল, আপীলকারীর কাজটি এতটাই জঘন্য যে তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিলে তা ন্যায়বিচারের প্রতি উপহাস করা হবে এবং সমাজের বিবেকে তা আঘাত দেবে। এরপর এই মামলা যখন সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল, ২০১৩ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুশীল শর্মার মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ রদ করে দিয়ে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করেছিল। ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি পি. সথাশিবম, বিচারপতি রঞ্জনা দেশাই এবং রঞ্জন গগৈয়ের এই তিন বিচারপতি বেঞ্চ সুশীল শর্মাকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং মৃত্যুদন্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের এহেন সিদ্ধান্ত বিষয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছিল অনেক। কিন্তু এমন একটি রায়ের পিছনে সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি যুক্তি দিয়েছিল। প্রথমত, আদালতের মতে, সুশীল নিজের স্ত্রীয়ের শরীর নিজেই টুকরো করেছেন কিনা তা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়, কারণ, কোনো ধারালো অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায় নি, ফলে দেহ কাটার প্রমাণ নেই কোনো। আদালত আরও বলেন, যে, সুশীল শর্মার কোনো অপরাধমূলক কাজকর্মের ইতিহাস নেই এবং যেহেতু ক্রমে ক্রমে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একটি ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই মাত্র এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তিনি, তাই তাঁর সংশোধনের সম্ভাবনাও আছে। সর্বোপরি এই ঘটনায় সমাজের বিরুদ্ধাচারণ নেই। তাই এমন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘটানো কোনো অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হতে পারে না বলেই মনে করেছিল সর্বোচ্চ আদালত।

২৩ বছর কারাবাসের পর ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর দিল্লি হাইকোর্ট সুশীল শর্মাকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। এতই চাঞ্চল্যকর ও বিস্ময়কর একটি ঘটনা এটি, যে, ম্যাক্সওয়েল পেরেইরা নামক তন্দুর হত্যা মামলা র সঙ্গে যুক্ত এক তদন্তকারী এই হত্যাকান্ডের ওপরে একটি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন।

আপনার মতামত জানান