সববাংলায়

তিন তালাক আইন

তালাক, তালাক তালাক – বহু কাল ধরে এই তিনটি শব্দই মুসলিম পুরুষদের কাছে বিবাহ-বিচ্ছেদ তথা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার উপায় ছিল। তিন বার তালাক উচ্চারণ করা, কিংবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে লিখে পাঠালে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ইসলাম নির্দিষ্ট আইনবিধি অনুসারে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারতেন। ভারতেও সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে এই তিন তালাক বিধি সুবিদিত ছিল। বহু দিন ধরেই ভারতে তিন তালাকের ব্যবহার ও যৌক্তিকতা নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধছিল। ২০১৭ সালে একটি বিল পাশের মধ্য দিয়ে তিন তালাক প্রথার উপর সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং একে অসাংবিধানিক বলে দাবি করে। তারপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই বিলের অনেক সংশোধনী এসেছে এবং ২০১৯ সালে লোকসভায় পাস হয় তিন তালাক আইন। আইনবলে তাৎক্ষণিক তালাকের মাধ্যমে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষিত হয়। এই আইন মুসলিম মহিলা আইন (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) নামেও পরিচিত। যদিও এই আইনকে ঘিরে আজও বিতর্ক ও মতানৈক্য কমেনি।

‘তালাক-ই-বিদ্দৎ’ বা তিন তালাক আসলে ইসলাম ধর্মের বিবাহ-বিচ্ছেদের রীতি যেখানে একজন মুসলিম পুরুষ মাত্র তিনবার তালাক উচ্চারণ করে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এর জন্য সেই ব্যক্তির কোনও প্রকার কারণ দর্শানোর বা জবাবদিহি করার প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি তালাক উচ্চারণের সময় মুসলিম মহিলা তথা সেই ব্যক্তির স্ত্রীর অকুস্থলে উপস্থিত থাকারও প্রয়োজন পড়ে না। শুধু উচ্চারণ করেই নয়, যে কোনও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে তিনবার তালাক লিখে পাঠালেও বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে অসুবিধে হবে না। তালাক দেওয়ার পরবর্তী কিছু সময় একটি প্রতীক্ষামূলক পর্ব হিসেবে গণ্য করা হয় যাকে ‘ইদ্দত’ বলা হয়। এই সময়পর্বে দেখা হয় তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী গর্ভবতী কিনা, তারপর তালাক অপরিবর্তনীয় বলে গণ্য হয়। ইসলামে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী তাঁর পূর্বতন স্বামীকে পুনর্বিবাহ করতে পারেন না, তবে যদি সেই নারী প্রথমে অন্য কোনও পুরুষকে বিবাহ করে থাকেন তবে পূর্বতন স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ সম্ভব। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘নিকাহ হালাল’। মনে করা হয় প্রায় ১৪০০ বছর আগে খলিফা ওমরের সময় থেকেই এই তালাক প্রথা চলে আসছে মুসলিম সমাজে। মূলত ‘তালাক-ই-বিদ্দৎ’ আসলে তাৎক্ষণিক তালাক। ১৯৩৫ সালে ‘ভারত সরকার আইন’ পাস হওয়ার পরে সর্বপ্রথম ভারতে ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরীয়ত)’ পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী ভারতে মুসলিম বিবাহ ও দাম্পত্য সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার কোনও দেশীয় আইনের আওতায় পড়ে না এবং তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুসলিম বিবাহ একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে স্বীকৃত যদি না কোনও ব্যক্তি বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪-এর অধীনে বিবাহের নিবন্ধন করে। ভারতে মুসলিম দম্পতিদের বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে এই বিধি নেই। বহু দিন ধরেই মুসলিম মহিলারা চাইছিলেন যাতে এই তিন তালাকের মত কুপ্রথা অবলুপ্ত হয়। কিন্তু ধর্মীয় ও পারিবারিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁরা কেউই সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। উত্তরাখণ্ডের মহিলা শায়রা বানোও এই কুপ্রথার শিকার হন। যৌতুক ও পণ প্রতিশ্রুতিমাফিক না দেওয়ায় তাঁর স্বামী শায়রার উপর যথেচ্ছ মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করেন এবং তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে চিঠি লিখে তিন তালাক দিয়ে ১৪ বছরের দাম্পত্য সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটান। এমনকি তাঁর দুই সন্তানের ভরণ-পোষণের ভার নিতেও অস্বীকার করেন তাঁর স্বামী। শায়রা বানো ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে এই তিন তালাক কুপ্রথা তথা তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেন। সেই বিতর্কিত মামলাটি ‘শায়রা বানো বনাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য’ নামে পরিচিত। মামলার রায় দেওয়ার জন্য পাঁচ জন ভিন্ন ধর্মের বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন বেঞ্চে – মুখ্য বিচারপতি জে এস খেহার (শিখ), কুরিয়ান জোসেফ (খ্রিস্টান), আর এফ নারিমান (পার্সি), ইউ ইউ ললিত (হিন্দু) এবং আবদুল নাসির (মুসলিম)। সেই মামলার ৩৯৭ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচজনের মধ্যে দুজন বিচারপতি তিন তালাক প্রথাকে সমর্থন করেন এবং বাকি তিনজন এই প্রথার বিরোধিতা করেন। ফলে ৩-২ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ২০১৭ সালেই তিন তালাক প্রথা পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ছয় মাসের মধ্যে এই বেঞ্চ কেন্দ্র সরকারকে মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে নির্দেশ দেয়।

আরও পড়ুন:  অ্যান্ড্রয়েডের বিভিন্ন সংস্করণ বা ভার্সানের নাম

সেই নির্দেশ মাফিক প্রথমে ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর লোকসভায় পাস হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) বিল, ২০১৭ যেখানে লিখিত ও মৌখিক যে কোনও প্রকার তালাককে অসাংবিধানিক ও অহেতুক বলে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীকালে এই বিলের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম মহিলা (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) অধ্যাদেশ, ২০১৮ জারি করে যেখানে মূলত তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয় –

  • তাৎক্ষণিক তিন তালাক শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এর জন্য সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা স্বীকৃত হয়।
  • অধ্যাদেশে বলা হয় শুধুমাত্র তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী বা তাঁর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়রাই প্রথমে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন।
  • এটি জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ কেউই অভিযুক্তকে জামিন দিতে পারেন না।

এই অধ্যাদেশই ক্রমে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টে আইন হিসেবে পাস হয়। তিন তালাক আইন তথা মুসলিম মহিলা (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) আইন, ২০১৯-এর প্রথম অধ্যায়ে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে এই আইনটি জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র বলবৎ হবে। এই আইনের তিনটি অধ্যায় রয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিন তালাক প্রথাকে অসাংবিধানিক ও অহেতুক বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তৃতীয় অধ্যায়ে বিবাহিত মুসলিম মহিলাদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে কিছু ধারা লিপিবদ্ধ রয়েছে। একাধারে তিন তালাক আইন তথা মুসলিম মহিলা (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) আইনের মুখ্য বিষয়গুলি হল –

  • তিন তালাক উচ্চারণ করে, কিংবা লিখে অথবা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে জানিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কোনও মুসলিম স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদের রীতি অসাংবিধানিক এবং অযৌক্তিক।
  • এই আইনের ৩ নং ধারা অনুসারে যে কোনও মুসলিম ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ যার কারণে উদিষ্ট ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ডও হতে পারে। এমনকি তাঁর জরিমানাও ধার্য হতে পারে।
  • তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে তাঁর স্বামী বিচ্ছেদের পরবর্তী দিন থেকেই তাঁর ও তাঁর সন্তানদের ভরণ-পোষণের জন্য একপ্রকার ভাতা দিতে বাধ্য থাকবে। এই ভাতার পরিমাণ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নির্ধারিত হবে।
  • নাবালক সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব পাবেন তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলা।
  • কোনও তালাকপ্রাপ্ত বিবাহিত মুসলিম মহিলা নিজে অথবা তাঁর রক্তের সম্পর্কের কোনও আত্মীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের কাছে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলে তবেই তাঁর স্বামী এই আইনের অধীনে দণ্ডযোগ্য অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।
  • সাধারণভাবে তালাক দেওয়া একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হয় এই আইনে। কিন্তু তালাকের সাপেক্ষে স্ত্রীর সম্মতি থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট লিখিত আবেদনের ভিত্তিতে স্বামীকে জামিন দিতে পারবেন।
আরও পড়ুন:  দুলাল চন্দ্র ভড়ের তালমিছরি

২০১৭ সালে লোকসভায় মুসলিম মহিলা বিল পাস হওয়া থেকে ২০১৯ সালে আইন প্রণয়ন সমস্ত ধাপেই তিন তালাক আইন বিতর্ক ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে আইন প্রণয়নের পরেও সমান অধিকার আদৌ পাওয়া গেল না এই দাবিতে বোদ্ধামহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। অনেকেরই দাবি এক্ষেত্রে গরিষ্ঠ অংশের অধিকার রয়েছে পুরুষদের হাতেই। কিন্তু স্ত্রীর যদি মনে হয় যে তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকা অসম্ভব সেক্ষেত্রে বিচ্ছেদের আইনটি ঠিক কী প্রকার হবে তা নিয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশ এই আইনে বলা নেই। তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিধিবদ্ধভাবে তালাক এখনও অটুট। ইসলামী শরীয়ত অনুসারে তিন রকম তালাক প্রচলিত রয়েছে – তালাক-ই-আহসান, তালাক-ই-হাসান এবং তালাক-ই-বিদ্দৎ। এর মধ্যে কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক তিন তালাক তথা তালাক-ই-বিদ্দৎই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন