ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোম

ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোম

মানুষের দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যার পরিবর্তন ঘটলে কিংবা ক্রোমোজোমের গঠনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে মানুষের শরীরে নানা অস্বাভাবিকতা দেখা যায় যেমন – টার্নার সিন্ড্রোম, ক্লাইনফেল্টার সিন্ড্রোম । এরকমই একটি অস্বাভাবিকতার নাম ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোম (Triple X syndrome)। ১৯৫৯ সালে বিজ্ঞানী ডক্টর প্যাট্রিসিয়া জ্যাকবস (Dr. Patricia Jacobs) ও তাঁর সহকর্মীরা প্রথম এই রোগের বিষয়ে ধারণা দিয়েছিলেন।

মানুষের দেহকোষে স্বাভাবিক অবস্থায় ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। তার মধ্যে ৪৪টি হল অটোজোম বা দেহ ক্রোমোজোম এবং ২টি হল অ্যালোজোম বা সেক্স ক্রোমোজোম। সেক্স ক্রোমোজোম দুটির নাম হল X ক্রোমোজোম এবং Y ক্রোমোজোম। মহিলাদের শরীরে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে এবং পুরুষদের শরীরে থাকে একটি X ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম। এখন যদি কোন জিনগত ত্রুটি বা মিউটেশনের জন্য কোনো মহিলার শরীরে দুটির বদলে তিনটি X ক্রোমোজোম তৈরি হয় অর্থাৎ তার শরীরে  ৪৬টির বদলে ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে, তবে সেই মহিলার শরীরে নানারকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এই অস্বাভাবিকতাগুলিকেই একত্রে বলে ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোম ‘। প্রতি ১০০০টি শিশুকন্যার মধ্যে একজনের এই রোগ দেখা যায়।

মানুষের ক্ষেত্রে কোন জাইগোট যদি 47,XXX ক্রোমোজোম সমন্বয়যুক্ত হয়, তবে সেই জাইগোট থেকে ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোম যুক্ত শিশু জন্মগ্রহণ করতে পারে। এই ঘটনার কার্যকৌশল হিসেবে সম্ভাব্য দুটি ঘটনার কথা বলা যায়:

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

1. স্ত্রীদেহে গ্যামেট গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলাকালীন, মিয়োসিস বিভাজনের দ্বারা কোষের দুটি X ক্রোমোজোম আলাদা হয়ে দুটি অপত্য কোষে সমানভাবে ভাগ হয়ে যায়। ফলে প্রতিটি গ্যামেটে একটি করে X ক্রোমোজোম থাকে। এখন কোষ বিভাজনের সময় যদি নন-ডিসজাংশন (non-disjunction) বা ক্রোমোজোমের অসম বণ্টন হয়, তবে একটি গ্যামেটে দুটি X ক্রোমোজোম চলে আসে এবং অপরটিতে কোন ক্রোমোজোম থাকে না। এরপর দুটি X ক্রোমোজোমযুক্ত গ্যামেটটি যদি স্বাভাবিক X ক্রোমোজোমযুক্ত পুং-গ্যামেট দ্বারা নিষিক্ত হয়, তবে XXX ক্রোমোজোমবিশিষ্ট জাইগোট সৃষ্টি হয়। এই জাইগোট ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোমযুক্ত কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়।

2. দ্বিতীয় সম্ভাবনায় জাইগোট সৃষ্টির পরবর্তী অবস্থায় স্বাভাবিক XX ক্রোমোজোমযুক্ত জাইগোট ক্লিভেজ বিভাজনকালে অসম ক্রোমোজোম বণ্টনের ফলে একটি XXX ক্রোমোজোমযুক্ত ব্লাস্টোমিয়ার তৈরি করতে পারে। এক্ষেত্রে অপর ব্লাস্টোমিয়ারটি শুধু X ক্রোমোজোমপ্রাপ্ত হয় এবং এই কোষটি বাঁচতে পারে না। ফলে XXX যুক্ত ব্লাস্টোমিয়ারটি বৃদ্ধি পায় এবং ট্রিপল এক্স সিন্ড্রোমবিশিষ্ট কন্যা তৈরি করে।

এই রোগের লক্ষণগুলি হল:

i. মানসিক লক্ষণ :-

• চেষ্টীয় স্নায়ুর বিকাশের হার কম হওয়ার ফলে বসা, হামা দেওয়া, দাঁড়ানো ইত্যাদি দেরিতে শেখা।

• কোন কিছু শিখতে সমস্যা, যেমন পড়তে সমস্যা বা ডিসলেক্সিয়া, অঙ্ক বুঝতে সমস্যা ইত্যাদি।

• ব্যবহারের সমস্যা যেমন, অ্যাটেনশন ডিফেক্ট/হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (attention-deficit/hyperactivity disorder ,ADHD), অটিজম প্রভৃতি।

• উদ্বেগ এবং অবসাদের মত মানসিক সমস্যা।

ii. শারীরিক লক্ষণ :-

• চোখের উপর ত্বকের উল্লম্ব ভাঁজ, যা চোখের ভিতরের কোণগুলিকে ঢেকে রাখে। এই ধরনের ভাঁজকে বলে ‘এপিক্যান্থাল ভাঁজ’ (epicanthal folds)।

• দুটি চোখের মধ্যে অস্বাভাবিক বেশি ব্যবধান।

• অস্বাভাবিক বাঁকা ও গোলাপি আঙুল।

• স্তনের অদ্ভুত গঠন।

• পেশির দুর্বলতা।

• কিডনির সমস্যা।

• ডিম্বাশয়ের গঠনে সমস্যা এবং সময়ের আগে মাসিক ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাওয়া বা প্রিম্যাচিউর মেনোপজ (premature menopause)।

এই রোগ নির্ণয় করার জন্য চিকিৎসকরা যে সব পরীক্ষা করেন সেগুলি হল:

a. জন্মের আগে :-   শিশুর জন্মের আগে তার দেহকোষে অবস্থিত অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমটিকে শনাক্ত করতে ক্যারিওটাইপ টেস্ট (karyotype test) অথবা নন-ইনভেন্সিভ প্যারেন্টাল টেস্ট (noninvasive prenatal test, NIPT) করা হয়। ভ্রূণ সংলগ্ন অঞ্চলের তরল, প্লাসেন্টার কোষ বা মায়ের রক্ত সংগ্রহ করে এই পরীক্ষা করা হয়।  

b. জন্মের পরে :-  শিশুর জন্মের পর এই রোগ শনাক্ত করার জন্য ক্যারিওটাইপ টেস্ট অথবা মাইক্রোঅ্যারে টেস্ট (microarray test) করা হয়। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত X ক্রোমোজোমের খোঁজ পেতে শিশুর রক্তের নমুনার সঙ্গে স্বাভাবিক রক্তের নমুনার তুলনা করা হয়।

এই রোগের প্রধান কারণ হল দেহকোষে একটি অতিরিক্ত X ক্রোমোজোম, যা কোনভাবেই বদলানো সম্বব নয়। তাই এই রোগের চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক। শৈশবকালে অথবা বয়ঃসন্ধিকালের কোন সময় এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এই রোগের চিকিৎসার উপায়গুলি হল

>সময়ের আগে মাসিক ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে গেলে ইস্ট্রোজেন হরমোন প্রয়োগ করে তা আবার চালু করা হয়।

>ডিম্বাশয়ের ত্রুটির জন্য গর্ভবতী হতে সমস্যা হলে কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণ।

>মানসিক সমস্যা এবং স্নায়ুর সমস্যার জন্য স্পিচ থেরাপি, কাউন্সেলিং প্রভৃতি প্রয়োগ করা যায়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগে কোন লক্ষণ দেখা যায় না, ফলে হয়ত সারাজীবনই রোগটি অজানা থেকে যায়। তবে ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে  রোগটি ধরা পড়লে উপযুক্ত চিকিৎসা করানো যায় এবং তার ফলে সমস্যাগুলি নিয়ন্ত্রণে থাকে।

তথ্যসূত্র


  1. ‘উচ্চতর জীববিদ্যা', দ্বাদশ শ্রেণী, সাঁতরা প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ, বংশগতি ও বিভেদ, পৃষ্ঠা ২৫৩-২৫৪
  2. https://www.sciencedirect.com/.
  3. https://www.mayoclinic.org/
  4. https://medlineplus.gov/
  5. https://www.encyclopedia.com/
  6. https://my.clevelandclinic.org/

আপনার মতামত জানান