শৈশব বলতেই কার্টুনের কথা মনে পড়ে। আর কার্টুনের জগতে যে ব্যাক্তি একপ্রকার বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন তিনি ওয়াল্ট ডিজনি (Walt Disney)। ওয়াল্ট ডিজনি কেবল একজন আমেরিকান অ্যানিমেশন শিল্পীই শুধু নন, লেখক, কার্টুন-চিত্রপরিচালক, প্রযোজক এবং দক্ষ এক কন্ঠঅভিনেতাও ছিলেন তিনি। টেলিভিশনের জন্যও জনপ্রিয় কিছু শো তিনি উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর ‘মিকি মাউস’ কার্টুন চরিত্রের খ্যাতি তো বিশ্বজোড়া। দীর্ঘ চলার পথে নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়েছে তাঁকে। অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের অগ্রদূত, ডিজনি প্রোডাকশন হাউসের জনক ওয়াল্ট ডিজনি জীবনব্যাপী কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজ প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।
১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর ইলিনয়ের শিকাগোতে হেরমোসা অঞ্চলের ১২৪৯ ট্রিপ অ্যাভেনিউতে জন্ম হয় ওয়াল্টার এলিয়াস ডিজনি বা ওয়াল্ট ডিজনির। বাবা এলিয়াস ডিজনি এবং মা ফ্লোরা ডিজনির পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন প্রথমে। মা ছিলেন স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষিকা। ১৯০৬ সালে, যখন ডিজনির বয়স মাত্র চারবছর, তাঁর পরিবার শিকাগো ত্যাগ করে চলে আসে মিসৌরির মার্সেলিন শহরে তাঁর কাকার ৪৫একর জমির এক খামারে। ডিজনির বাবা এলিয়াস সেখানে কৃষিকাজ শুরু করেন। ১৯২৫ সালের জুলাই মাসে ডিজনি বিবাহ করেন লিলিয়ান বাউন্ডসকে ।
মিসৌরিতে থাকতেই প্রতিবেশী এক অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারের ঘোড়ার ছবি আঁকার জন্য ডিজনিকে পুরস্কৃত করা হলে ছবি আঁকার প্রতি ডিজনির আগ্রহ তীব্র হয়। ‘অ্যাপিল টু রিজন’ সংবাদপত্রের গ্রাহক ছিলেন তাঁর বাবা। সেই সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত বিখ্যাত কার্টুনিস্ট রায়ান ওয়াকারের কার্টুন দেখে দেখে নকল করতেন ডিজনি। এইভাবেই ধীরে ধীরে কার্টুন আঁকার হাতেখড়ি তাঁর। বাবাকে ফার্মের কাজে যেমন সাহায্য করতেন তেমনি পাশাপাশি খামারের পশুপাখির ছবিও আঁকতেন। ১৯০৯ সালের শেষদিকে ডিজনি ও তাঁর ছোটবোন রুথ মার্সেলিনের পার্ক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯১১ সালে তাঁরা মিসৌরির ক্যানসাস শহরে চলে এসেছিলেন ডিজনিরা । সেখানে ডিজনি ভর্তি হয়েছিলেন বেনটন গ্রামার স্কুলে। বাবা এলিয়াস পত্রিকা বিক্রির কাজ শুরু করলে ডিজনি এবং তাঁর বড়ভাই রয় বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার কাজ করতে থাকেন। স্কুলে যাওয়ার আগে ভোরবেলা এবং স্কুল থেকে ফিরে সন্ধেবেলাতেও এই কাজ করতেন তিনি। ছয় বছরের বেশি সময় এই কাজ করেছিলেন ডিজনি৷ পাশাপাশি কানসাস সিটি আর্ট ইন্সটিটিউট থেকে কার্টুন আঁকার বিশেষ কোর্সও করেন তিনি।
১৯১৭ সালে এলিয়াস তাঁর পরিবার নিয়ে পুনরায় শিকাগোতে ফেরত আসেন এবং জেলি তৈরির ‘ও-জেল কোম্পানিতে’ (O-Zell Company) কাজ নেন। সেখানে ডিজনি ম্যাককিনলে হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং সেই বিদ্যালয়ের সংবাদপত্রে কার্টুন আঁকতে শুরু করেন। সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবলম্বনে কিছু দেশাত্মবোধক কার্টুন এঁকেছিলেন তিনি। এছাড়াও রাতে শিকাগো অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে চলত তাঁর ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ। আর্ট ক্লাসের খরচ জোগাড় করবার জন্য তিনি বাবার সঙ্গে জেলির ফ্যাক্টরিতে কাচের বয়াম ধোয়ামোছার কাজও করেছেন।
বড়ভাই রয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিলে ডিজনিও জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগদানে ইচ্ছুক হয়ে ওঠেন। সেটা ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি। ১৭ বছরও পূর্ণ না হওয়ায় তাঁর যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছা পূরণ হলো না। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কাজ শুরু করেন আমেরিকান রেড ক্রসে। তাঁকে তখন ফ্রান্সে পাঠানো হলেও নভেম্বরে ফেরত আসেন তিনি। তবে কার্টুন আঁকার চর্চা তখনও থেমে থাকেনি। অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে অবসরে কার্টুন আঁকতেন তিনি। তাঁর কিছু কার্টুন সেসময় সেনাবাহিনীর পত্রিকা ‘স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপসে্’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৯ সালের অক্টোবরে তিনি কানসাসে ফিরে আসেন এবং সেখানে পেসমেন-রুবিন বানিজ্যিক আর্ট স্টুডিওতে (Pesmen-Rubin Commercial Art Studio) শিক্ষানবিশ শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। সেসময় তিনি বিজ্ঞাপন, থিয়েটার অনুষ্ঠান কিমবা ক্যাটালগের জন্য অনেক বানিজ্যিক ছবি এঁকেছিলেন। সেখানে সহশিল্পী আব আইওয়ার্কসের (Ub Iwerks) সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ডিজনির।
দুই বন্ধু সেই সংস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্টুডিও খুললেন বটে কিন্তু তেমন পসার জমল না। একমাস পরে তাঁরা দুজনেই কানসাস সিটি ফিল্ম অ্যাড কোম্পানিতে কার্টুনিস্ট হিসেবে যোগদান করলেন। সেখানে কাটআউট অ্যানিমেশনের কাজ করে অ্যানিমেশনের প্রতি আগ্রহ বেড়ে ওঠে ডিজনির। অ্যানিমেশনের একটি বইয়ের সাহায্য নিয়ে কার্টুন এঁকে ক্যামেরার সাহায্যে বাড়িতেই পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে বুঝতে পারেন কাটআউট অ্যানিমেশনের থেকে সেল অ্যানিমেশন (Cel Animation) অনেক বেশি মনোরঞ্জক। এরপরেই ফ্রেড হারম্যানকে নিয়ে তৈরি করেন নিজের কোম্পানি এবং সৃষ্টি করেন ‘লাফ-ও-গ্রামস্’ (Laugh-O-Grams) নামে অ্যানিমেটেড কার্টুন সিরিজ। লাফ-ও-গ্রামস-এর সাফল্যের পর ১৯২১ সালের মে মাসে গড়ে তুললেন ‘লাফ-ও-গ্রাম স্টুডিও’ (Laugh-O-Gram Studio)। পিক্টোরিয়াল ফিল্মসের কাছে একটি ফেয়ারি টেল সিরিজ বিক্রি করতে সক্ষম হলেন তাঁরা। তারপর মার্গারেট নামের এক কার্টুন ডিস্ট্রিবিউটার লাফ-ও-গ্রাম নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করলে চুক্তিপত্রে সই করে ডিজনি কাজে লেগে পড়লেন। হলিউডে একটি ঘর ভাড়া করে কিছু অ্যানিমেশন শিল্পী এবং একটি বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে তৈরি করলেন লাইভ অ্যাকশন ফিল্ম ‘অ্যালিস ইন কার্টুনল্যান্ড’ (Alice in Cartoonland)। ডিজনি এবং তাঁর বড়ভাই রয় মিলে তৈরি করলেন ‘ডিজনি ব্রাদার্স স্টুডিও’। পরে এর নাম হয় ‘দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানি’। ১১৯২৭ সালে ‘ফেলিক্স দ্য ক্যাট’ নামক কার্টুন সিরিজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ডিজনি তৈরি করলেন অসওয়াল্ড দ্য লাকি র্যাবিট’ (Oswald the Lucky Rabbit) সিরিজ। যদিও ডিজনির বেশ কিছু কার্টুনের স্বত্ব নিজেদের নামে করে নিয়ে মার্গারেট এবং তাঁর স্বামী ডিজনির সঙ্গে জালিয়াতি করেছিলেন এর কিছু পরেই।
১৯২৮ সাল ডিজনির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। লাফ-ও-গ্রাম স্টুডিওতে একদিন একটি ইঁদুর দেখে সেই আদলেই এক কার্টুন তৈরির পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। আইওয়ার্কস তৈরি করেন এক কার্টুনের স্কেচ। সৃষ্টি হয় ‘মিকি মাউস’। দীর্ঘদিন সেই কার্টুন চরিত্রে গলা দিয়েছেন ডিজনি নিজে। যদিও প্রথমে ডিজনি ঠিক করেছিলেন কার্টুনটির নাম রাখবেন মর্টিমার মাউস। শেষে স্ত্রী লিলিয়ানের পরামর্শ মেনে নাম রাখলেন মিকি মাউস। এই কার্টুন চরিত্রের প্রথম সিনেমা ‘স্টিমবোট উইলি’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সেবছরই ‘সিলি সিম্ফনিস’ নামে এক সিরিজ আনলেন ডিজনি এবং সেই সিরিজের প্রথম সিনেমা ‘দ্য স্কেলিটন ড্যান্স’ । এরপর একে একে তৈরি করলেন ডোনাল্ড ডাক, গুফি, প্লুটোর মতো বিখ্যাত কিছু চরিত্র।
টেকনিকালার আসার পর প্রথম রঙিন অ্যানিমেশন তৈরি করেন ১৯৩২ সালে ‘ফ্লাওয়ারস অ্যান্ড ট্রিজ’ নামে। এটি অ্যাকাডেমি পুরস্কার জিতে নিয়েছিল। ১৯৩৩ সালে ডিজনি প্রযোজিত ‘দ্য থ্রী লিটল্ পিগস্’ প্রকাশিত হয় এবং সেটিও অ্যাকাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। তারপর ডিজনি স্টুডিও একেরপর এক চোখ ধাঁধানো চলচ্চিত্র উপহার দিতে থাকে। ‘গ্র্যাসহুপার অ্যান্ড দ্য অ্যান্টস’, ‘দ্য টরটয়েজ অ্যান্ড দ্য হেয়ার’ ইত্যাদি তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৭ সালে বানালেন পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেশন ফিল্ম ‘স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ফস’। এটি রূপকথার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা।
স্নো হোয়াইটের সাফল্যের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ডিজনি স্টুডিও ‘ফ্যান্টাসিয়া’, ‘ডাম্বো’ ইত্যাদি কয়েকটি সিনেমা প্রযোজনা করে উত্তরোত্তর সফলতা পেতে থাকে। ১৯৪১ সাল থেকে ডিজনি বেশ একটু সংকটের মধ্যে পড়েন। বেশ কিছু শিল্পী পদত্যাগ করে চলে যান। তখন ফেডারেল গভর্নমেন্টের হয়ে অ্যানিমেশন তৈরি করে ডিজনি স্টুডিওর অবস্থা ফেরে। অ্যানিমেশন এবং লাইভ অ্যাকশনের মিশ্রনে তৈরি হয় ‘দ্য রিল্যাক্ট্যান্ট ড্রাগন’, ‘সং অব দ্য সাউথ’ প্রভৃতি। বড়ভাই রয়ের পরামর্শে অ্যানিমেশন এবং লাইভ-অ্যাকশনের মিশ্রনে তৈরি সিনেমাগুলিকে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকেন। ১৯৪৮ সালে ‘ট্রু-লাইফ অ্যাডভেঞ্চারস’ নামে একটি সিরিজের অবতারণা করেন ডিজনি যার প্রথম সিনেমা ‘সিল আইল্যান্ড’, অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করে। ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ , ‘সিন্ডারেলা’, পিটার প্যান’ ইত্যাদি জনপ্রিয় কিছু ফিচার-লেংথ সিনেমাও তৈরি হয় ডিজনি স্টুডিওর প্রযোজনায়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রোগ্রামের সূচনা করে ডিজনি বিনোদনের অন্যতম সেরা এক মাধ্যম করে তোলেন টেলিভিশনকে।
ডিজনির জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হল ডিজনিল্যান্ড। এটি মূলত একটি থিম পার্ক। ডিজনির অনবদ্য কল্পনার এ এক বাস্তব রূপ। এই ডিজনিল্যান্ডের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে এক রূপকথার জগত। টেলিভিশনে ১৯৫৪ সালে তিনি এই থিম পার্কের প্রচারের জন্য ‘দ্য ম্যাজিকাল ওয়ার্ল্ড অব ডিজনি’ (The Magical World of Disney) নামে একটি সিরিজ শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে এই ডিজনিল্যান্ড উন্মুক্ত করা হয়। পরে আরও একটি ডিজনি পার্ক গঠনের কাজ শুরু হলেও কিন্তু তা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ডিজনির মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালে এই দ্বিতীয় ডিজনি পার্কটি উন্মুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে নানা পুরস্কারের মাধ্যমে ডিজনির কাজকে সম্মানিত করা হয়েছে। বহুবার অ্যাকাডেমি পুরস্কারে (Academy Awards) পেয়েছেন তিনি, তার মধ্যে কয়েকটি সম্মানসূচক (Academy Honorary Award)। পেয়েছেন দুটি ‘স্পেশাল অ্যাচিভমেন্টস্ অ্যাওয়ার্ডস’ , ‘সেসিল বি.ডেমিলে পুরষ্কার , ‘এমি পুরষ্কার’ । এছাড়াও পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’, ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’ , ‘অফিসার দে’একাডেমিয়া’ ইত্যাদি। থাইল্যান্ড তাঁকে দিয়েছে ‘অর্ডার অব দ্য ক্রাউন’ পুরস্কার । জার্মানির কাছে পেয়েছেন ‘অর্ডার অব মেরিট’ । ব্রাজিল তাঁকে ‘অর্ডার অব দ্য সাউদার্ন ক্রস’ সম্মানে ভূষিত করেছে। ১৯৬০ সালে পেয়েছেন ‘হলিউড ওয়াক অব ফেম’। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় -সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করেছে।
১৯৬৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর সেন্ট জোসেফ হাসপাতালে ফুসফুসের ক্যান্সারের কারনে এই বিশ্ববিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব ওয়াল্ট ডিজনির মৃত্যু হয়।
3 comments