মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতে পারে

মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতে পারে 

পৃথিবীকে মানুষ নিজেদের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে নিত্যদিন। পৃথিবীর স্থল, জল, আকাশ—সর্বত্র মানুষ অবাধে বিচরণ করে চলেছে। প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক উপাদানকে নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ কাজে লাগাতে পেরেছে বিজ্ঞানের নানা কৌশলে। কিন্তু যদি হঠাৎ কোনো দুর্বিপাকে, অথবা ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা বা মহামারীর ফলে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় মানুষ, তবে জনমানবহীন সেই পৃথিবীর চেহারা কেমন হয়ে উঠবে ভেবে দেখেছেন কী? বিজ্ঞানীরা কিন্তু সেই নিয়েও চিন্তা করেছেন। বিজ্ঞানী অ্যালান ওয়েইসম্যান ঠিক এমন ধরনের চিন্তা থেকেই ২০০৭ সালে একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘দ্য ওয়ার্ল্ড উইদআউট আস’। বেশ কয়েক বছর তিনি তদন্তে ব্যয় করেছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য। আসুন আমরা জানার চেষ্টা করি মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতে পারে?

এখানে আমরা সেই বৈজ্ঞানিক অনুমানগুলি নিয়েই আলোচনা করব যে, পৃথিবী থেকে মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কোন ধরনের পরিবর্তন আসবে। তবে একথা অনস্বীকার্য এগুলি সবই অনুমানমাত্র, বাস্তবে হয়ত তার থেকে হেরফের হতে পারে।

পৃথিবী থেকে মানুষের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানীরা উড়িয়ে দেননি। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ভাইরোলজিস্ট ফ্র্যাঙ্ক ফেনার দাবি করেছিলেন যে, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরবর্তী শতাব্দীতে মানুষ সম্ভবত বিলুপ্ত হয়ে যাবে।  তাছাড়া ইতিহাস উল্টে দেখা যায় মাঝেমাঝেই মানবসভ্যতার ওপর এমন একেকটি বিপর্যয় এসে পড়েছে, যা মানুষের অস্তিত্বকে সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গেই চতুর্দশ শতকের ভয়ঙ্কর ব্ল্যাক ডেথের কথা মনে পড়বে, যার ফলে ইউরোপের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল৷ এছাড়াও মনে পড়বে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কথা, যা বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭৫ মিলিয়ন লোককে প্রভাবিত করেছিল৷ এই বিপর্যয়ের তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন অবশ্যই কোভিড-১৯।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

যেভাবেই হোক, সত্যিই মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতে পারে তা নিম্নে আলোচিত হল।

প্রথমত, যদি ভূগর্ভের জল সরিয়ে রাখবার জন্য পাম্পিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণকারী মানুষের অভাব ঘটে তবে পাতাল রেলের মতো ভূ-গর্ভস্থ পরিষেবাগুলি, টানেলগুলি ৩৬ ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণরূপে জলে ভরে যাবে, ফলে সমস্ত পরিষেবা বিকল হয়ে পড়বে। ওয়েইসম্যান তাঁর গবেষণার সময় এটি জেনেছিলেন যে ভূগর্ভস্থ জায়গাগুলি প্লাবিত হতে ৩৬ ঘন্টা লাগবে।

দ্বিতীয়ত, মানুষের তত্ত্বাবধানের অভাবে তৈল ও গ্যাস শোধনাগারগুলিতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের ফলে ব্যাপক দাবানল লেগে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা তৈরি হবে। পারমানবিক প্ল্যান্টগুলিকে ত্রুটিমুক্ত করার মানুষের অভাবে সেগুলিও বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরগুলিকে ঠান্ডা করার জন্য যে শীতল জল তা বাষ্পীভূত হয়ে একসময় সেই রিঅ্যাক্টরগুলোতে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটবে।

প্রাকৃতিক কার্বনচক্র মানুষের বিলুপ্তির কয়েক হাজার বছর পরে বায়ুমন্ডলীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।

মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরে সারা বিশ্ব অন্ধকার হয়ে যাবে, সব আলো নিভে যাবে, কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, কেউ তা পর্যবেক্ষণ করবে না, পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানিও সরবরাহ হবে না। ফলত, কোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আর কাজ করবে না।

মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক এবং রাবার যা প্রাকৃতিকভাবে বিনষ্ট হয় না, সেগুলি শেষপর্যন্ত মহাসাগরে ভেসে যাবে, পলিস্তরে গিয়ে জমা হবে এবং কয়েক লক্ষ বছর পর সেগুলি শিলাস্তরে একীভূত হয়ে ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডের অংশ হয়ে উঠবে।

পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার প্রভাব সমানভাবে পড়বে প্রাণীজগতেও। প্রথমত, গৃহপালিত পশু যথা বিড়াল, কুকুর, গরু, মুরগি ইত্যাদি জীব খাদ্যের অভাবে প্রাণ হারাবে। তাছাড়া বিভিন্ন বন্য জন্তু যথা নেকড়ে, বনবিড়াল, শৃগালদের সঙ্গে তখন লড়তে হবে কুকুর, বিড়ালদের এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা হিংস্র সেইসব শ্বাপদের খাদ্যে পরিণত হয়ে একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মানবসৃষ্ট আবর্জনাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে বেঁচে থাকা তেলাপোকা জাতীয় কীটেরা বিলুপ্ত হয়ে পড়বে। ইঁদুরের মতো ছোট দুর্বল জীবেরা ঈগল, বাজপাখিদের শিকারে পরিণত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। পৃথিবী শান্ত হয়ে গেলে বন্যপ্রাণ বেরিয়ে আসবে শহরে, গ্রামে সর্বত্র।

ইস্পাতের তৈরি ভবন, স্থাপত্য, সেতুগুলি সবই মরচে ধরে একসময় ভেঙে পড়বে। আইফেল টাওয়ার, লন্ডন ব্রিজের মতো ইস্পাতের তৈরি স্থাপত্যগুলির সেভাবেই বিনাশ ঘটবে। কাঠের তৈরি ঘরগুলি যত্নের অভাবে এবং উইপোকার দৌরাত্মে নষ্ট হয়ে ভেঙে পড়বে। কংক্রিটের তৈরি বড় বড় বাড়িগুলিরও একই দশা হবে। চরম আবহাওয়ায় উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে বাড়িগুলি নষ্ট হয়ে যাবে। শীতল এলাকায় পাইপে, বাড়ির ছাদে জল জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবে, তা ক্রমে ফাটল তৈরি করবে। বেসমেন্টে জল পূর্ণ হয়ে যাবে। একবার শীতের সময় জল জমে তারপর পুনরায় সেই জল গলে গিয়ে বাড়ির অবস্থা শোচনীয় করে তুলবে এবং অবশেষে তা গুঁড়িয়ে যাবে। এমনকি মানুষের অভাবে প্রকৃতি অবাধে বিস্তার লাভের সুযোগ পাবে। লতাপাতায় ছেয়ে যাবে, গাছের শিকড় ছড়িয়ে যাবে বাড়ির ফাটলে। একমাত্র প্রকৃতির নিজস্ব তৈরি প্রস্তর কাঠামোগুলিই দীর্ঘদিন অটুট থেকে যাবে।

রাস্তাঘাট, ফুটপাতের অবস্থাও হবে সেরকমই। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ জলে ধাতব কাঠামো ক্ষয়ীভূত হয়ে শহরের রাস্তাঘাট ধসে পড়ে জলমগ্ন হয়ে যাবে। বাতাস এবং পাখিদের বহন করে আনা উদ্ভিদের বীজ রাস্তায়, ফুটপাতে পড়ে থেকে তা থেকে শিকড় ছড়িয়ে ফাটল ধরিয়ে দেবে, গাছপালার বিস্তার হবে মানুষের চলার পথের ওপরে।

আসলে মানুষের হস্তক্ষেপ, আনাগোনা যখন বন্ধ হয়ে যাবে তখন প্রকৃতি অবাধে নিজেকে বিস্তার করতে থাকবে। ওয়েইসম্যান অনুমান করেছেন যে, ৫০০ বছরের মধ্যে তৃণভূমি, ঝোপঝাড়, ঘন গাছের জঙ্গলে ভরে যাবে কংক্রিটের শহর। শুকনো জৈব উপাদান, ডালপালা জমা হবে, ফলে বজ্রপাতে আগুন ধরে গেলেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাবে বিরাট অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে। কাঠের বাড়িগুলির ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটবে। এছাড়াও লাস ভেগাস, দুবাইয়ের মতো মরুভূমি সংলগ্ন অনেক শহর পুনরায় চলে যাবে মরুভূমির গ্রাসে।

মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে প্রকৃতি যেন খোলস ছেড়ে নিজ মহিমায় পুনরায় দেখা দেবে। মানুষ না থাকলে দূষণ হবে না, নীল আকাশ মাথার উপরে বিরাজ করবে। শহরের সীমার বাইরে পৃথিবীর অর্ধেক বাসযোগ্য জমি জুড়ে যে বিশাল কৃষিজমি আছে সেদিকে তাকালে দেখা যাবে, কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ হওয়ায় অনেক প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ, পোকামাকড়ের অবাধ বিচরণ। আজকে বাস্তুতন্ত্রের ওপর রাসায়ানিকের যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে তা আর থাকবে না। ফলত, অনেক বন্যপ্রাণ স্বচ্ছন্দে এগিয়ে এসে নিজেদের বাসস্থান করে নেবে। এই রূপান্তর বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্যের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। বিলুপ্ত এবং অবলুপ্তপ্রায় বৃহৎ প্রাণীগুলি পুনরায় বিচরণ করবে পৃথিবীর বুকে। সমুদ্রে মাছের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। একসময় পৃথিবী সিংহ, হাতি, বাঘ, গন্ডার প্রভৃতি প্রাণীতে সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু মানুষের আবির্ভাবের পর তাদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। তবে একদল গবেষক বলেছেন, মানুষ এই গ্রহ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সেই বিলুপ্ত প্রাণগুলির, সেই বৃহৎ দেহের প্রাণীগুলির পুনরুজ্জীবনে আরও তিন থেকে সাত মিলিয়ন বছর বা তারও বেশি সময় লাগবে।

ওয়েইসম্যান মানবহীন পৃথিবীতে যে জলবায়ুর বিপুল পরিবর্তন ঘটবে সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন।

এই সমস্ত বৈজ্ঞানিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে মানবহীন পৃথিবীর যে-চিত্র পাওয়া গেল তা অবলুপ্ত মায়া সভ্যতার মতো প্রাচীন সভ্যতাগুলির কথা মনে করিয়ে দেয়। মানুষ অবলুপ্ত হয়ে গেলে কী হতে পারে – তার অনুমানগুলি থেকে মানুষের জন্য বর্তমান পৃথিবীতে ঘটে চলা অন্ধকার দিকগুলিও আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে যায়।

আপনার মতামত জানান