পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বায়ুমণ্ডলের প্রায় ২১% অক্সিজেন গ্যাস আছে। মানুষসহ সমস্ত জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অক্সিজেন অপরিহার্য। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমান বেড়ে গেলে সত্যি কি আমাদের উপকার হবে, নাকি অন্য কোনো সমস্যা প্রকট হতে পারে। এই নিবন্ধে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে কী হতে পারে সেই বিষয়ে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হল।
প্রথমেই জেনে রাখা দরকার বর্তমান সময়ে যে অক্সিজেনের পরিমাণ দেখা যায় তা কিন্তু পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে একই অবস্থায় নেই। সৃষ্টির শুরুতে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ছিল না। পরবর্তীকালে জীব সৃষ্টির পর সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়া কমার মাধ্যমে আজকের প্রায় ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টির বহু আগে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বাধিক ৩৫% অবধি ছিল। অবশ্য ১৫০ মিলিয়ন বছর অক্সিজেনের পরিমাণ ২১% এর আশেপাশেই থেকে এসেছে, ফলে মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু সাধারণভাবে এই পরিমাণ অক্সিজেনের সাথেই অভিযোজিত হয়ে গেছে। এই কারণে বাতাসে খুব বেশি অক্সিজেনের হেরফের ঘটলে আমাদের জন্য বিপদজনক হতে পারে। OSHA (Occupational Safety and Heath Administration, US) -র মতে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ ১৯.৫% এর কম বা ২৩.৫% এর বেশি দুইই ক্ষতিকর হতে পারে।
এখানে আমরা জেনে নেব বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে কী হতে পারে –
১) আরশোলা, মাকড়শা জাতীয় পোকা-মাকড় ট্রাকিয়া নামক সরু পাইপের মতো শ্বাসনালী দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে। বিজ্ঞানীদের মতে এই শ্বাসনালীতে বেশি অক্সিজেন গেলে পোকামাকড়ের আকার বড়ো হতে থাকবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৩০-৩৫% অক্সিজেন ছিল, তখন এক একটা মাকড়শা পাখীর মতো বড় ছিল আর পঙ্গপালগুলো দেখতে ছিল বাজপাখির মতো। কাজেই এখনও যদি বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে যায় আমরা হয়তো বিশাল বড়ো আকারের পোকামাকড় দেখতে পাবো।
২) শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশেই নয়, অক্সিজেনের মাত্রা আমাদের শরীরে বেড়ে গেলে নানা রকম দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত হয়ে দেহের শক্তি ও কর্মক্ষমতা একদিকে যেমন বাড়িয়ে দেবে তেমনই বিপাকের হার ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গিয়ে শরীরকে নিঃশেষিত করে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেবে। শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অক্সিজেন “অক্সিজেন বিষাক্তকরণ” ঘটাতে পারে। তার ফলে ফুসফুসের সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া এমনকি কোষ বিভাজনেও ব্যাঘাত ঘটবে। অতিরিক্ত অক্সিজেন শরীরে মুক্ত মূলকের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে, এরা অন্যান্য ইলেকট্রনের সাথে মিলে অপ্রয়োজনীয় যৌগ গঠন করবে যার ফলে আমাদের ডিএনএ -র গঠনগত পরিবর্তন ঘটতে পারে।
৩) আমরা দেখেছি নিভে যাওয়া আগুন জ্বালাতে সমস্যা হলে অনেক সময় বাতাস দিতে হয়। আসলে আগুন জ্বলার জন্য অক্সিজেন দরকার। বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা খুব বেশি হয়ে গেলে সহজেই যেকোনো জায়গায় আগুন লেগে যেতে পারে এবং আগুন নেভানো বেশ কঠিন হবে। বিশেষ করে বনাঞ্চল ও জঙ্গলে প্রায়ই আগুন লাগবে এবং দিনের পর দিন সে আগুন জ্বলতে থাকবে।
৪) অক্সিজেনের রূপভেদ হলো ওজোন গ্যাস। স্বাভাবিক ভাবেই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন বাড়লে ওজোনের পরিমানও বাড়বে। এর ফলে বায়ুমণ্ডলের গড় ঘনত্ব বেড়ে যাবে। সূর্যের তাপ ও আলো বেশি বিচ্ছুরিত হয়ে আকাশ নিষ্প্রভ হয়ে উঠবে এবং বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা অনেকটা কমবে। বায়ুর ঘনত্ব বাড়ার কারণে প্লেন,প্যারাসুট,পাখিরা অনেক উঁচুতে ও দীর্ঘক্ষণ উড়তে পারবে।
৫) পার্বত্য অঞ্চলে ও উঁচু জায়গায় অক্সিজেনের পরিমান বেড়ে যাওয়ায় তা বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। পশুপাখি ও উদ্ভিদ এমনি কি মানুষের বসবাস বেড়ে গিয়ে ওই অঞ্চলের ভুমিরূপের পরিবর্তন ঘটবে। এছাড়া প্রকৃতির বিভিন্ন মৌল ও উপাদান অক্সিজেনের প্রভাবে জারিত হতে থাকবে ফলে বায়ুমণ্ডলের তুলনায় অশ্মমন্ডল (lithosphere) ভারী হয়ে যাবে। এমনকি সমুদ্রের জলও জারিত হয়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড উৎপন্ন করতে পারে। ফলে পৃথিবীর গঠনে আমূল পরিবর্তন দেখা যাবে।
৬) কলকারখানা ও অটোমোবাইল শিল্পের ক্ষেত্রে যন্ত্রাংশের মধ্যে নাইট্রোজেন ঢুকে গিয়ে গরম করে দেয়, সেক্ষত্রে জ্বালানি বেশি খরচ হয়। বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান বেড়ে গেলে সেই অসুবিধা কম হবে । কিন্তু দহন বেশি হওয়ার জন্য বিভিন্ন দূষিত পদার্থ পরিবেশে নির্গত হবে।
এক কথায় সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে অক্সিজেনের কোনো বিকল্প যেমন নেই তেমনই বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন খুব বেশি হয়ে গেলে এই সভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই যাঁরা মনে করেন বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন বেড়ে গেলে আমাদের উপকার হবে তা আসলে ভ্রান্ত ধারণা।
তবে একথাটাও ঠিক অদূর ভবিষ্যতে এরকম হওয়ার সম্ভবনা কম তবে “কী হত যদি…” এই ভাবনায় বিজ্ঞানমনস্ক মন অনেককেই নাড়া দেয় আর এই নিবন্ধগুলির মাধ্যমে সেই প্রশ্নগুলিরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরকমই একটি প্রশ্ন হল বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে কী হতে পারে যার উত্তর এখানে দেওয়া হল।