বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

১৪ নভেম্বর ।। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস

প্রতি বছর প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশেই কিছু দিবস পালিত হয়। ঐ নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে পালনীয় সেই সব দিবসগুলির মধ্যে একটি হল বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস (World Diabetes Day)।

প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর তারিখে সারা বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। মূলত ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগের সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে জনসচেতনতা প্রচারের উদ্দেশ্যে এই বিশেষ দিনটি পালন করা হয়। ডায়াবেটিস একটি নিঃশব্দ প্রাণঘাতী রোগ যার কারণে দৃষ্টিশক্তি চলে যেতে পারে, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তাই এই রোগের লক্ষণ দেখে আগে থেকে রোগ নির্ণয় করা এবং তার চিকিৎসা করার প্রয়োজনীয়তাকে মাথায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এই দিনটি পালন করে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। পরিবারে ডায়াবেটিস আক্রান্ত সদস্যদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং আর্থিক চাপ সৃষ্টি না করে কীভাবে ডায়াবেটিসের চিকিৎসার মধ্য দিয়ে সুস্থ থাকা যায় সেই সব বিষয়ে আলোকপাত করতেই এই দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব জুড়ে।

১৯৯১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিনটি পালন করা শুরু করে। বিশ্ব জুড়ে প্রবলভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকায় এই দুই সংস্থা মানুষকে সচেতন করে তুলতে প্রথম এই বিশেষ দিনটি পালন করা শুরু করে। ডায়াবেটিসের ফলে স্বাস্থ্যের যে সংকট দেখা দেয়, তা দূর করার জন্য মানুষকে সচেতন করে তোলা দরকার। ১৯৮০ সালে বিশ্বে যেখানে দেখা গেছে ১০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল, সেখানে ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় পুরো বিশ্বজুড়ে ৪২ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই ক্রমবর্ধমান রোগাক্রান্তের পরিসংখ্যান বিশ্বের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের চিন্তিত করে তুলেছিল। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে গড়ে প্রতি বছর ৭ শতাংশ করে বাড়ছিল এই রোগে আক্রান্তের হার। মেদবাহুল্য বা অত্যধিক ওজন এই ডায়াবেটিসের আরেকটি ঝুঁকির কারণ বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য-কর্মীদের সমীক্ষায় দেখা গেছে নিম্ন উপার্জনক্ষম ও নিম্ন-মধ্য উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের মধ্যেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশি। সঠিক ডায়েট তথা খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক সচলতা বজায় রাখা, তামাক সেবন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই প্রসঙ্গেই বলে রাখা দরকার, ডায়াবেটিস মূলত হয় অগ্ন্যাশয় থেকে সঠিক পরিমাণে ইনসুলিন হরমোন ক্ষরণ না হলে বা যে পরিমাণ ইনসুলিন ক্ষরিত হয় তা দেহে ব্যবহৃত না হলে। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়তে থাকে যাকে ‘হাইপারগ্লাইসেমিয়া’ (Hyperglycemia) বলা হয়। এই ডায়াবেটিস দুই প্রকার –

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

ক) টাইপ-১ ডায়াবেটিসকে বলা হয় ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস যেখানে ইনসুলিনের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যায়।

খ) টাইপ-২ ডায়াবেটিস ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিস নয়। অত্যধিক দেহের ওজন বা শারীরিক সচলতা না থাকার কারণে শরীরে উৎপাদিত ইনসুলিন ঠিকভাবে কাজে লাগে না বলে এই ডায়াবেটিস দেখা দেয়।

চিকিৎসার পরিভাষায় ডায়াবেটিস মেলিটাস এবং ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস এই দুই প্রকার ডায়াবেটিসের বিচার করা হয়। ডায়াবেটিস মেলিটাস বলতে ‘মধুমেহ’ রোগকে বোঝায় যাকে চলতি কথায় ‘ব্লাড সুগার’ বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস এডিএইচ (ADH) নামক হরমোনের প্রভাবে হয় যার ফলে বারেবারে মূত্রত্যাগের ইচ্ছা হয়। দুই ধরনের ডায়াবেটিসেরই ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক এবং তা প্রাণহানিকরও হতে পারে। ডায়াবেটিসের ফলে চোখের ক্ষতি হতে পারে, কিডনির কর্মক্ষমতা নষ্ট হতে পারে, হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। যথাযথ নিরীক্ষণ, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং উপযুক্ত ঔষধ সেবনের মধ্য দিয়ে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

ফলে এই রোগের থেকে মানুষকে সুস্থ রাখতে ১৪ নভেম্বর দিনটিকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উল্লেখ করে সারা বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয়। এই দিনেই ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্যার ফ্রেডারিক বেণ্টিঙ্ক যিনি চার্লস বেস্টের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আবিষ্কার করেন কৃত্রিম ইনসুলিন। ২০০৭ সালে রাষ্ট্রসংঘ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রসংঘ দিবসের মর্যাদা দেয়। ১৬০টিরও বেশি দেশে প্রায় দশ কোটি মানুষের কাছে এখন এই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের বার্তা পৌঁছে গেছে বলে দাবি করেছে রাষ্ট্রসংঘ। এই দিনকে কেন্দ্র করে যে সচেতনতা প্রচার হয় তা একটি নীল রঙের বৃত্ত দিয়ে প্রতীকায়িত করা হয়। ডায়াবেটিস সচেতনতার এটাই একটি বিশ্বজনীন প্রতীক। এই প্রতীকের মধ্য দিয়ে বোঝানো হয় যে বিশ্বে ডায়াবেটিস সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক ঐক্য যা ডায়াবেটিসকে একটি মহামারী থেকে রোধ করতে পারে।

ইনসুলিন আবিষ্কারের ১০০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বহু মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় ইনসুলিন ব্যবহার করতে কিংবা ইনসুলিনের সুবিধা উপভোগ করতে পারেন না। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত পরিচর্যা এবং চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে এবং জটিলতা দূর করার জন্য যথাসম্ভব পরীক্ষা করাতে হবে মাঝে মাঝেই। এই সুবিধা বা পরিষেবা অধিকাংশ মানুষ এখনো পায় না, আর তাই ডায়াবেটিসের প্রতিকারে সহায়ক পরিষেবার বিস্তার ঘটাতে বিভিন্ন জায়গায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে সচেতনতা ক্যাম্প করা হয়। দেশে দেশে বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদরা মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের খারাপ প্রভাব, লক্ষণ ও প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতনতা প্রচার করে থাকেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে নানাবিধ সেমিনার, সভা আয়োজন করা হয় এই দিনে। ডায়াবেটিস সংক্রান্ত পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদি বিতরণ করা হয় এই দিনে, স্বাস্থ্য-দপ্তর থেকে নানাবিধ শোভযাত্রাও অনেক সময় আয়োজন করতে দেখা যায়।

২০১৩ সাল থেকে বিশেষ একটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস পালিত হয়। ২০১৩ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করো : ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ এবং প্রতিরোধ’ (Protect our Future: Diabetes Education and Prevention)। এরপরে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৫ সালের প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়া’ (Healthy Eating)। ২০১৬ সালে ‘ডায়াবেটিসের নিশানা চোখ’ (Eyes on Diabetes) এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হয়েছিল এই দিনটি। এর পরের বছর ২০১৭ সালে প্রতিপাদ্য স্থির হয় ‘নারী এবং ডায়াবেটিস – স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গঠনে আমাদের অধিকার’ (Women and Diabetes – our right to a healthy future)। ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্যটি হল – ‘পরিবার ও ডায়াবেটিস – ডায়াবেটিস নিয়ে উদ্বেগ প্রত্যেক পরিবারে’ (The Family and Diabetes – diabetes concerns every family) এবং ২০২০ সালের প্রতিপাদ্যটি ছিল ‘নার্স ও ডায়াবেটিস’ (The Nurse and Diabetes)। সম্প্রতি ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য হিসেবে স্থির হয়েছে ‘ডায়াবেটিস প্রতিকারের পরিষেবা গ্রহণ’ (Access to Diabetes Care)।

আপনার মতামত জানান