বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস

১৭ এপ্রিল | বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস

প্রতিবছর প্রতিমাসের নির্দিষ্ট কিছু দিনে বিভিন্ন দেশে কিছু দিবস পালিত হয়। ওই নির্দিষ্ট দিনে অতীতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণ করা বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতেই এই সমস্ত দিবস পালিত হয়। বিশ্বের পালনীয় সেই সমস্ত দিবসগুলোর মধ্যে একটি হল বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস (World Hemophilia Day)।

প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল বিশ্ব হিমোফিলিয়া দিবস সারা বিশ্ব জুড়ে পালন করা হয়। এই দিবসটি পালন করার উদ্যোগ নেয় ওয়ার্ল্ড হিমোফিলিয়া ফাউন্ডেশন (World Hemophilia Foundation) আর এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক স্ন্যাবেল (Frank Schnabel) কে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর জন্মদিনকে এই দিনটি পালন করার জন্য বেছে নেওয়া হয়।

১৯৮৯ সাল থেকে এই দিনটি প্রতি বছর হিসেবে পালন করা হচ্ছে। মানব ইতিহাসে প্রাচীনতম দুরারোগ্য মারণব্যাধিগুলোর মধ্যে হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক রক্তক্ষরণজনিত রোগ। ১৯০৪ সালে প্রথম রক্তের প্লাজমা আবিষ্কৃত হয়। এরপর আবিষ্কৃত হতে থাকে নানা প্লাজমা প্রোটিন যেগুলোর অনুপস্থিতির কারণে মূলত হিমোফিলিয়া রোগ দেখা যায়। বংশগত কারণে এই রোগ হয়, তাই সম্পূর্ণভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করার তেমন কোন উপায় নেই। তবে বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সাহায্যে দ্রুত হিমোফিলিয়া রোগটিকে সনাক্ত করা সম্ভব।

হিমোফিলিয়া শব্দটি এসেছে দুটি গ্রিক শব্দ ‘হাইমা’ এবং ‘ফিলিয়া’ থেকে। হাইমা শব্দের অর্থ রক্ত এবং ফিলিয়া অর্থ আকর্ষণ। দেহের কোন অংশে রক্তপাত শুরু হলে সাধারণত সেখানে রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। মেডিকেলের ভাষায় এই প্রক্রিয়াকে রক্ততঞ্চন বা ক্লটিং(Clotting) বলে। যে পদার্থ রক্তক্ষরণে বাধা দেয় তাকে ক্লট বলে। হিমোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে ক্লট সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক নয়। তবে সামান্য কেটে গেলে রক্তক্ষরণ এক্ষেত্রে সমস্যা নয় বরং আক্রান্ত রোগীর দেহে আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। এটি মূলত দেখা যায় দেহের বিভিন্ন সন্ধিস্থলে। দেহের ভিতর রক্তক্ষরণ অনেক যন্ত্রণাদায়ক হয় এবং আক্রান্ত স্থানটি বেশ ফুলতে শুরু করে।

হিমোফিলিয়া একটি জিনগত রোগ অর্থাৎ বংশানুক্রমিক। পুরুষরা সাধারণত এ রোগের শিকার হন।সাধারণত হিমোফিলিয়া রোগটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো হিমোফিলিয়া-এ, হিমোফিলিয়া-বি, এবং হিমোফিলিয়া-সি। হিমোফিলিয়া-বি রোগটিকে ক্রিসমাস ডিজিজ(Christmas disease)ও বলে। হিমোফিলিয়া বি হিমোফিলিয়া এ- এর তুলনায় কম দেখা যায়। হিমোফিলিয়া সি অপেক্ষাকৃত বিরল। তবে নারী পুরুষ উভয়েই হিমোফিলিয়া সি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

কথিত আছে, গ্রেট বৃটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধরদের মাধ্যমে হিমোফিলিয়া রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিল। রানী এবং তাঁর কয়েকজন কন্যা সন্তান এই রোগের বাহক ছিল। তাঁদের যখন অন্য দেশের রাজপরিবারে বিয়ে হয়, তখন এই রোগ সেই সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণেই এই রোগকে রাজকীয় রোগ বলা হয়। ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রথম হিমোফিলিয়া রোগের আবির্ভাব ঘটে রানী ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স লিওপোল্ড এর মাধ্যমে। এর আগে এই রাজপরিবারে কারও এরকম রোগ দেখা যায়নি।১৮৫৩ সালে লিওপোল্ড জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাণী ভিক্টোরিয়ার অষ্টম সন্তান। রানী ভিক্টোরিয়ার দুই কন্যা সন্তানও হিমোফিলিয়া রোগের বাহক ছিলেন। এইভাবে রাজপরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে এই রোগ অন্যান্য রাজবংশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।

এই রোগের প্রধান চিকিৎসা হল রক্তক্ষরণ বন্ধের ব্যবস্থা করা। রক্ত থেকে তৈরি ‘ ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা’(fresh frozen plasma) নামক উপাদান কেবল এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে সক্ষম। কিন্তু এই প্লাজমা তৈরি করতে অনেক রক্তের প্রয়োজন হয় এবং এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দরিদ্র রোগীদের ক্ষেত্রে প্লাজমা তৈরি ও সংগ্রহ করা এক প্রকার দুঃসাধ্য।

প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিমোফিলিয়া নিয়ে আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয় এবং হিমোফিলিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত নানান আলোচনা হয়। পাশাপাশি, ওয়ার্ল্ড হিমোফিলিয়া ফাউন্ডেশন উদ্যোগে প্রত্যেক বছর একটি করে থিম বেছে নেওয়া হয় দিনটি পালনের জন্য। প্রত্যেক বছর এই দিনটি পালনের জন্য নির্দিষ্ট একটি থিম বা প্রতিপাদ্য নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ২০১৯ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘জনসংযোগ কর্মসূচি ও শনাক্তকরণ’ (Outreach and Identification)। ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ হিমোফিলিয়ার লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে – সকলের জন্য চিকিৎসা’ (Get involved to carry the motive of the World Federation of Haemophilia – Treatment for all)। ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ছিল – পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া: নতুন বিশ্বকে যত্নশীল করে তোলা (Adapting to change: sustaining care in a new world)। ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য ছিল -‘সবার অংশগ্রহণ : অংশীদারিত্ব। নীতি’ (Access for All: Partnership. Policy)। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য – সবার অংশগ্রহণ : সুরক্ষার বিশ্বব্যাপী মানদন্ড হিসেবে রক্তপাত প্রতিরোধ (Access for All: Prevention of bleeds as the global standard of care)। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য – ‘সকলের জন্য ন্যায়সঙ্গত অ্যাক্সেস: সমস্ত রক্তপাতের ব্যাধিকে স্বীকৃতি দেওয়া’ (Equitable access for all: recognizing all bleeding disorders)।

3 comments

আপনার মতামত জানান