জরথুস্ট্র

জরাথুস্ট্র

পারস্য দেশ বা বর্তমানে ইরান দেশের একজন বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন জরাথুস্ট্র (Zarathustra)। তিনি ছিলেন সুবিখ্যাত ‘জরাথুস্ট্রবাদ’-এর প্রবর্তক। তাঁর বাণীগুলি প্রাচীন ইন্দো-ইরানীয় ধর্মের অনেক ঐতিহ্যের বিপরীত কথা বলেছিল এবং একটি ধর্মীয় আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল যা পরবর্তীকালে প্রাচীন পারস্যের এক প্রভাবশালী ধর্ম হয়ে ওঠে।

জরাথুস্ট্র এর জীবনকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। কিছু পণ্ডিত ভাষাগত এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রমাণ ব্যবহার করে বলেন, জরাথুস্ট্রের জন্ম হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের কোনও এক সময়ে। অন্যান্য পণ্ডিতরা তাঁকে খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতকে সাইরাস দ্য গ্রেট (Cyrus the Great) এবং দারইউস (Darius)-এর সমসাময়িক বলে মনে করেন। এগুলি ছাড়াও জরাথুস্ট্রের জীবনকাল নিয়ে আরও নানারকম মত ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রচলিত আছে। জানা যায়, জরাথুস্ট্রের বাবার নাম ছিল পৌরুসাস্পা স্পিটামা এবং মায়ের নাম ছিল দুগ্দো‌ভা। ঐতিহ্য অনুসারে, জরাথুস্ট্রের দুই বড় ও দুই ছোট ভাই ছিল। অনেক পরে পল্লব সাহিত্যে এঁদের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সারা জীবনে জরাথুস্ট্র তিনবার বিয়ে করেছিলেন। তাঁর প্রথম দুই স্ত্রীর থেকে তিনটি পুত্রসন্তান ও তিনটি কন্যাসন্তান জন্ম নেয়, কিন্তু তাঁর তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন নিঃসন্তান।

খুব ছোটবেলা থেকেই, সম্ভবত সাত বছর বয়স থেকেই জরাথুস্ট্র যাজক হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। আনুমানিক পনেরো বছর বয়সে তিনি একজন যাজকের পদে অধিষ্ঠিত হন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক গাথাগুলির মতে, কুড়ি বছর বয়সে বাবা-মাকে ছেড়ে আসার আগে তিনি অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে নীতিজ্ঞান লাভ করেন এবং নানা জায়গা ভ্রমণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও সংগ্রহ করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

৩০ বছর বয়সে তাঁর একটি অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। নদীর তীরে তিনি একটি উজ্জ্বল বস্তুকে দেখেছিলেন যা নিজের পরিচয় দিয়েছিল ‘ভোহু মানাহ’ (Bohu manan) বা ভালো মানুষ বলে। এই দৈবী সত্ত্বা তাঁকে ‘আহুর মাজদা’ (Ahura Maida, সর্বশক্তিমান, প্রজ্ঞাময় প্রভু) এবং অন্যান্য পাঁচটি দীপ্তিময় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। শীঘ্রই জরাথুস্ট্র দুটি আদিম আত্মার অস্তিত্বের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন। এর প্রথমটি ছিল ‘আহুর মাজদা’ এবং দ্বিতীয়টি ছিল ‘আংরা মাইনু’ (Angra Mainyu, ধ্বংসাত্মক শক্তি) যা ‘আশা’ বা ‘আদেশ’ এবং ‘দ্রুজ’ বা ‘প্রতারণা’র বিপরীত বা বিরোধী ধারণা পোষণ করে। এইভাবে তিনি মানুষের জীবনে আশা খোঁজার জন্য শিক্ষা দিতে নিজের জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এরপরেও সেই দৈব সত্ত্বার মুখোমুখি হয়েছেন এবং জনশ্রুতি অনুসারে, তিনি সাতটি প্রধান পবিত্র আত্মার (Amesha Spenta) মধ্যে একজনের দর্শন পেয়েছিলেন। অবশেষে, ৪২ বছর বয়সে তিনি রাণী হুতাওসা (Hutaosa) এবং বিশতাস্পা (Vishtaspa) নামে এক শাসকের অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। লৌকিক সাহিত্য ‘শাহনামেহ’ অনুযায়ী, এরা ছিলেন ব্যাকট্রিয়ার অধিবাসী। এই দুজনই ছিলেন জরাথুস্ট্রবাদের প্রথম অনুগামী। রাজা বিশতাস্পার জরাথুস্ট্রবাদকে অনুসরণ করার ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখতে জরাথুস্ট্র নিজের হাতে একটি সাইপ্রেস গাছ পুঁতেছিলেন। শোনা যায়, স্বর্গ থেকে জরথুস্ট্রের আনা একটি গাছের ডাল থেকে এই গাছটির জন্ম হয়। বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ইরানের কাশ্মের-এ এই গাছটিকে এখনও দেখা যায়। এটি একটি বিশাল এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত সাইপ্রেস গাছ। কিংবদন্তি অনুসারে, এরপরেও জরাথুস্ট্র অনেকদিন বেঁচেছিলেন এবং নিজের বিশ্বস্ত অনুগামীদের নিয়ে একটি ধর্ম সম্প্রদায় তৈরি করতে পেরেছিলেন।

জরাথুস্ট্রের বিভিন্ন উপদেশাবলী সংরক্ষিত আছে ‘জেন্দ-আবেস্তা’ নামের গ্রন্থতে যা হল জরাথুস্ট্রবাদীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। জরাথুস্ট্র মানুষের জীবনকে আশা এবং প্রতারণার মধ্যে এক মানসিক লড়াই হিসেবে দেখতেন। ‘আশা’র মূল ধারণা খুবই সংক্ষিপ্ত এবং সঠিকভাবে তা অনুবাদ করা যায় না। যদিও এর মধ্যেই জরাথুস্ট্রের মতবাদের ভিত্তি সুপ্ত আছে। জরাথুস্ট্রের মতে, আহুর মাজদা (সর্বশক্তিমান ঈশ্বর) এবং তাঁর সৃষ্টি, অস্তিত্ব ও স্বাধীন ইচ্ছা হল আশার প্রতীক। মানবজাতির প্রধান উদ্দেশ্য, ঈশ্বরের অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টির মতো, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং আশার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করা। মানবজাতির জন্য এটি জীবনে সক্রিয় নৈতিক অংশগ্রহণ, আচার ও নিয়ম সঠিকভাবে মেনে চলা এবং গঠনমূলক বা ভাল চিন্তা, শব্দ এবং কাজের অনুশীলনের মাধ্যমে ঘটে। জরাথুস্ট্রের দর্শনের উপাদানগুলি ইহুদি ধর্ম এবং প্লেটোনিজমের উপর তাদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পশ্চিমে প্রবেশ করেছে এবং দর্শনের বিকাশের প্রাথমিক ঘটনাগুলির মধ্যে এক অন্যতম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। শাস্ত্রীয় গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে, দার্শনিক হেরাক্লিটাসকে প্রায়ই জরাথুস্ট্রের চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অক্সফোর্ডের ‘ডিকশনারি অফ ফিলোজফি’ বিশ্বের সমস্ত দার্শনিকদের সময়কালের মধ্যে জরাথুস্ট্রকে প্রথম স্থান প্রদান করেছে। জরাথুস্ট্র ‘মাজদায়াস্না’ (Majdayasna) নামে যে ধর্মীয় নৈতিকতার প্রচলন করেছিলেন এই ব্যবস্থার কারণে আজও জরাথুস্ট্রের প্রভাব জনজীবনে রয়ে গেছে। ‘জেন্দ-আবেস্তা’য় এই ‘মাজদায়াস্না’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ইংরেজি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞানের পূজা করা’। বিশ্বকোষ ‘ন্যাচারাল হিস্ট্রি (প্লিনি)’ দাবি করে যে জরাথুস্ট্রের অনুগামীরা পরবর্তীকালে গ্রিকদেরও তাঁদের শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন।

তাঁর উপদেশগুলিতে জরাথুস্ট্র ব্যক্তির জীবনে কোনও সিদ্ধান্ত সঠিক বা ভুল, তা নির্বাচন করার স্বাধীনতা নিজের কাজের জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকার উপর বেশি জোর দিয়েছেন। শুভ এবং অশুভ শক্তির মধ্যে পার্থক্য করতে পারা এবং নিজের ইচ্ছামতো যে কোনও একটিকে বেছে নেওয়া সম্পূর্ণভাবেই মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, তা কোনওভাবেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা আহুর মাজদার নির্দেশ নয়। জরাথুস্ট্রের মতে, ভাল চিন্তাভাবনা করে, ভাল কথা বলে এবং ভাল কাজ যেমন, গরিব-দুঃখীকে দান করা, ঈশ্বরের কথা আলোচনা করা, ব্রত পালন বা পূজা-অর্চনা করা ইত্যাদি করে মানুষ নিজেদের জীবনে এবং পৃথিবীতে ‘আশা’কে জাগাতে পারে। এইভাবেই স্বর্গের তথা ঈশ্বরের আরও কাছাকাছি যাওয়া যায়। মানুষ ভগবানের দাস বা চাকর নয়, কিন্তু নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ভাল কাজ করে সে ঈশ্বরের সঙ্গী হতে পারে এবং নিজেকে ‘আশাবন’ বা ‘আশার প্রভু’-র (যে আশাকে নিয়ন্ত্রণ করে) পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। জরাথুস্ট্রের কিছু মূর্তিতে যদিও তাঁকে প্রাচীন ইরানের ঐতিহ্যবাহী কাজ করতে ও সেইমত পোশাক পরতে দেখা গেছে, কিন্তু বেশিরভাগ মূর্তিতেই তাঁকে সাদা পোশাকে দেখা যায় যা বর্তমান যুগেও জরাথুস্ট্রবাদী পুরোহিতরা পরে থাকেন। তাঁর হাতে একটি গাছের ডাল অথবা দণ্ড থাকে যেটিকে ‘বেয়ারসম্যান’ (baresman) বলা হয়। মনে করা হয়, এটি হল পুরোহিতদের প্রতীক বা চিহ্ন। তাঁর অন্য হাতটিতে থাকে একটি বই। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এই বইটিই হল জরাথুস্ট্রবাদীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘জেন্দ-আবেস্তা’। অন্য কিছু মূর্তিতে, তাঁর হাতে একটি বজ্র বা গদা থাকে যেটি একটি ধাতব লাঠির মত দেখতে এবং এর মাথায় একটি ষাঁড়ের মুণ্ড বসানো থাকে। প্রাচীনকালের পুরোহিতরা এই ধরনের লাঠি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় ব্যবহার করতেন। এছাড়াও কিছু মূর্তিতে তাঁর হাত উপরের দিকে তোলা থাকে। জরাথুস্ট্রের অনুগামীরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে আগুন এবং পবিত্র জলকে পূজা করেন। তাঁদের উপাসনালয়ের মধ্যে একটি কুণ্ডের ভিতর সবসময় আগুন জ্বলতে থাকে। এই আগুনকে খুবই পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই উপাসনালয়ের নাম ‘অগ্নিমন্দির’। এছাড়াও একে ‘আতশগাহ’ (Atashgah) বা ‘দার-ই মের’ (Dar-e Mene)-ও বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মোট ১৬৭টি অগ্নিমন্দির আছে। এর মধ্যে মুম্বইতে অবস্থিত ৪৫টি, বাকি ভারতে অবস্থিত ১০৫টি এবং অন্যান্য দেশে আছে ১৭টি। এর মধ্যে মাত্র ৯টি মন্দির (ইরানে অবস্থিত ১টি এবং ভারতে অবস্থিত বাকি ৮টি) প্রধান মন্দির বা ‘আতাশ বেহরাম’ (atash behrams) নামে পরিচিত। বাকিগুলিকে বলা হয় ‘আগিয়ারিস’ (agiarys)।

আনুমানিক ৭৭ বছর বয়সে জরাথুস্ট্রের মৃত্যু হয়। ‘শাহনামেহ’-এর মতো পল্লব সাহিত্যগুলির মত অনুযায়ী, তুরীয়দের সঙ্গে জরাথুস্ট্রের একটি অস্পষ্ট আদর্শগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই সংঘাতের কারণেই জরাথুস্ট্রকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আরও শোনা যায়, একজন ‘কারাপান’ বা প্রাচীন সনাতন ধর্মের এক পুরোহিতই নাকি তাঁকে হত্যা করেন।

আপনার মতামত জানান