মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (Maulana Abul Kalam Azad) স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী যিনি একাধারে বহুমুখীএকজন রাজনীতিবিদ,ইসলাম বিষয়ক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তাঁর জন্মদিনটি ভারতে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বিশেষত হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির ক্ষেত্রে। মৌলানা আজাদই হলেন ভারতের উচ্চ শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি প্রতিষ্ঠান আই আই টি (IIT) ও  ইউ জি সি (UGC) এর প্রতিষ্ঠাতা। গান্ধীজি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে পাণ্ডিত্যে পিথাগোরাস, এরিস্টটল ও প্লেটোর সমতুল্য বলে মনে করতেন।

১১ নভেম্বর  ১৮৮৮ সালে মক্কায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্ম হয়। তাঁর  প্রকৃত নাম আবুল কালাম গুলাম মুহিউদ্দিন আহমেদ বিন খাইরুদ্দিন আল হুসেইনি আজাদ। তবে সাধারণ ভাবে তিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। ‘মৌলানা’ শব্দের অর্থ হল- (আমাদের শিক্ষক)। তিনি সচেতন ভাবেই তাঁর নামের শেষে ‘আজাদ’ শব্দটি যুক্ত করেন যার অর্থ- ‘স্বাধীন’। তাঁর বাবা মুহাম্মদ খাইরুদ্দিন একজন বাঙালি মুসলমান পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম শেখ আলিয়া।  মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জুলেখা বেগমের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। 

মৌলানা আজাদ ১৮৯০ সাল থেকে তাঁর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। বাড়িতেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। শুরুতে পরিবারের সাহায্যে এবং পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেষ্টায় তিনি শিক্ষিত হয়েছিলেন। আজাদ আরবির পাশাপাশি বাংলা, হিন্দি, পার্সি ও ইংরেজি ভাষাতে দক্ষতা অর্জন করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় তিনি দর্শন এবং ইতিহাস বিষয়ে বিপুল জ্ঞান অর্জন করেন। বয়স বারো পেরোনোর আগেই মৌলানা আজাদ একটি গ্রন্থাগার ও বিতর্কসভা চালাতেন। বারো বছর বয়সে মুসলিম দার্শনিক ‘গাজালি’র জীবন কাহিনী লেখার চেষ্টা করেন। চোদ্দ বছর বয়সে তৎকালীন বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘মাখজান’-এ লেখা পাঠাতে শুরু করেন। বয়স পনেরো যখন, তখন তাঁর দ্বিগুন বয়সী মানুষদের পড়াতে শুরু করেন তিনি।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

মৌলানা আজাদ নিজের কর্ম জীবন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে। সাংবাদিক জীবনের শুরুতে তিনি ‘ভাকিল’ নামে একটি সংবাদ পত্রের মধ্যে দিয়ে নিজের কর্মজীবনের সূত্রপাত করেন। ১৯১২ সালে তিনি ‘আল-হিলাল’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু করেন যেখানে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ব্রিটিশ সরকারের শোষণমূলক নীতির সমালোচনা করেন যার ফলে ১৯১৪ সালে এই সংবাদপত্রটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। ১৯১৩ সালে আজাদ মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রগতিশীল অংশকে নিয়ে অন্জুমান-ই-উলেমা-ই -বাঙ্গাল নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে, এই সংগঠনটি জামিয়াত-উলেমা -ই -হিন্দে পরিণত হয়।

গান্ধীজি ১৯১৮ সাল নাগাদ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য খিলাফত আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেন। অসহযোগ ও খিলাফতকে কেন্দ্র করে যে তীব্র জনজোয়ার তৈরী হয়, কংগ্রেস নেতাদের পাশাপাশি আলি ভ্রাতৃদ্বয়ের সাথে উল্লেখযোগ্য নেতা হিসেবে উঠে আসেন মৌলানা আজাদ। এই সময়েই তিনি কংগ্রেসের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হন ও কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি এই সময়ে তিনি সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটির সভাপতি হিসেবেও নিযুক্ত হন। এই সময়ে থেকে তিনি জওহরলাল নেহেরু, সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ সহ কংগ্রেস নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে গান্ধীজির প্রভাব প্রকট হতে শুরু করে। পুরানো বেশভূষা, জীবনচর্যা থেকে দূরে সরে গিয়ে তিনি খাদির বস্ত্র পরিধান করতে থাকেন। এই সময়েই মুখতার আব্বাস আনসারি এবং আজমল খানের সাথে মিলিতভাবে দিল্লীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীকালে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়।

মৌলানা আজাদ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ইসলামের উদার দিকটিকে গ্রহণ করে তার সংকীর্ণ দিকটিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। মুসলিম লীগের সংকীর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেখে তিনি মুসলিম লীগের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন চিরকাল। ১৯০৫ সালের বঙ্গ ভঙ্গের তীব্র বিরোধী ছিলেন মৌলানা আজাদ। পরবর্তীকালে সুন্নি বিপ্লববাদীদের সাথে পরিচয় হওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক চিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ে অরবিন্দ ঘোষ, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর মত বিপ্লবীদের সাথে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তিনি মহারাষ্ট্র, বাংলা ও বিহারের বিপ্লবীদের সাথে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলতেন। আজাদ নেহেরু রিপোর্টকে সমর্থন করেছিলেন এবং ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার অবসান চেয়েছিলেন।

১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহের আজাদ বহু মিছিল সংগঠিত করেছিলেন। অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের সাথে সাথে তিনিও এই সময়ে গ্রেফতার হন। ১৯৩৫ এবং ১৯৩৭ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় তিনি নিজে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে চাননি বরং এই সময়ে তিনি ভোটের জন্য প্রচারকার্যে অংশ নেওয়া, অনুদান সংগ্রহ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে অন্যান্য সদস্যদের জয়ী করানোর ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ১৯৩৯ সালে আজাদ রামগড়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর সভাপতি থাকাকালীন সময়েই গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন। তিনি জিন্নার  দ্বিজাতি তত্ত্বের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস, মুসলিম লীগের ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রচার চালায়। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগ ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে হিসেবে ঘোষণা করে। এর ফলে গোটা দেশ জুড়ে দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই সময়ে তিনি বাংলা ও বিহারের এক বিস্তৃত অঞ্চলে জুড়ে বিভেদ মিটিয়ে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি গড়ে তোলার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান।১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হওয়ার পরেও বাংলা, বিহার এবং পঞ্জাবের কিছু অংশ জুড়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি বহাল থাকে। পাশাপাশি সদ্যগঠিত পাকিস্তান থেকে আসা বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘুর চাপ ভারতের অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তোলে। এই সময়ে আজাদ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার  রক্ষার দায়িত্ব পান। তিনি নিয়মিতভাবে বর্ডার এলাকাগুলিতে গিয়ে উভয় সম্প্রদায়কে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ করতেন। মৌলানা আজাদ বাংলা, বিহার ও পঞ্জাবের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। সংবিধান গড়ে তোলার সময়ে তিনি এ দেশের সমস্ত ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা যাতে রক্ষা হয় সেই দাবী তুলে ধরেন। ক্রমেই তিনি ভারতবর্ষের জাতীয় নীতি নির্ধারনে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং সহায়ক হয়ে ওঠেন। দিল্লি এবং পঞ্জাবের নিরাপত্তার প্রশ্নে তাঁর সাথে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের তীব্র বিতর্ক তৈরি হয় যেখানে প্যাটেল মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কোন রকম নিরাপত্তা তৈরী করার তীব্র বিরোধী ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে মৌলানা আজাদ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কোন দেশের সংখ্যালঘুর জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত কতটা জরুরি সে বিষয়ে নেহরুকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মৌলানা আজাদ নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক নীতির দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। পাশাপাশি,তিনি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের সাথে সাথে  শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যেও প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সেই কাজ সফল করতে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫২ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে তিনিই ছিলেন সভাপতি। মৌলানা আজাদই হলেন ভারতের উচ্চ শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি প্রতিষ্ঠান আই আই টি (IIT) ও  ইউ জি সি (UGC) এর প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হল -‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ (India Wins Freedom)।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ১৯৫৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে মৃত্যু হয়। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ১৯৯২ সালে মরণোত্তর ভারতরত্ন পুরস্কার পান। তাঁর নামে কলকাতায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলেজ এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর বাড়িতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ স্টাডিজ গড়ে উঠেছে।

2 comments

আপনার মতামত জানান