রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু

রাজশেখর বসু বিংশ শতাব্দীর একজন  কিংবদন্তী বাঙালী। বাংলায় চলন্তিকা অভিধান রচনা, মহাভারতের সহজ সংক্ষিপ্ত অনুবাদ, হাস্যরসে বাংলা সাহিত্যকে একটি বিশিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। সাহিত্যজগতে তিনি তাঁর ছদ্মনামে অর্থাৎ ‘পরশুরাম’ নামে বেশি পরিচিত।

রাজশেখর বসুর জন্ম হয় ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ। ব্রিটিশ ভারতের অধীন বেঙ্গল প্রভিন্সের বর্ধমান জেলার বামুনপাড়া গ্রামে মামাবাড়িতে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম চন্দ্রশেখর বসু।চন্দ্রশেখর বসু ছিলেন দ্বারভাঙ্গা রাজ এস্টেটের ম্যানেজার। তাঁর বাড়ি ছিল নদীয়া জেলার বীরপুর(উলা) গ্রামে। রাজশেখর বসুর মায়ের নাম ছিল লক্ষীমণি দেবী। শ্যামাচরণ দে’র নাতনি মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল।

রাজশেখর বসু দ্বারভাঙ্গা রাজ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করেন।পাটনা কলেজ থেকে এফ. এ. পাশ করেন। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্স সহ বি. এ. পাশ করেন। ১৯০০ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এম. এ. পাশ করেন। ১৯০২ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে মাত্র কয়েকদিন ওকালতি করেন। ওকালতির চেয়ে বিজ্ঞান চর্চাতেই তাঁর আকর্ষণ ছিল তাই ১৯০৩ সালে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস কোম্পানীতে একজন রসায়নবিদ হিসেবে অল্প বেতনে নিযুক্ত হন । নিজের দক্ষতায় অল্পদিনেই তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর ডাঃ কার্তিক বসুর প্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯০৪ সালে তিনি ঐ কোম্পানীর পরিচালক হন।একদিকে গবেষণার কাজ, অন্যদিকে ব্যবসা পরিচালনা  দু’টি বিষয়েই তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। কেমিস্ট্রি ও ফিজিওলজির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে তিনি এক নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার দরুন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে এখান থেকে অবসর নিলেও উপদেষ্টা এবং পরিচালক পদে আজীবন এই কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। রাজশেখর বসু বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসাত্মক লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি সাহিত্যে সাধারণত ‘পরশুরাম’ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ১৯২২ সালে এই ছদ্মনামে তাঁর ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ ব্যঙ্গ রচনা প্রকাশ হয়। তীব্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সাহিত্য রসের মধ্যে দিয়ে পরিবেশনের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সমস্ত রকম সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান বই লেখেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা মোট একুশ। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল:
গল্প ও রম্য রচনা – গড্ডলিকা (১৯২৪), কজ্জলী (১৯২৭), হনুমানের স্বপ্ন (১৯৩৭), গল্পকল্প (১৯৫০); কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প(১৯৫৩), আনন্দীবাঈ (১৯৫৭)।
প্রবন্ধ – লঘুগুরু (১৯৩৯), ভারতের খনিজ (১৯৪৩), কুটিরশিল্প (১৯৪৩), বিচিন্তা (১৯৫৫)।
অনুবাদ সাহিত্য – মেঘদূত (১৯৪৩), বাল্মীকি রামায়ণ (১৯৪৬), মহাভারত (১৯৪৯), হিতোপদেশের গল্প (১৯৫০) ইত্যাদি।
রাজশেখর বসু সংকলিত চলন্তিকা বাংলা ভাষায় একটি জনপ্রিয় অভিধান। বাঙালির কাছে ‘চলন্তিকা’ অভিধান হিসেবে বহুল প্রচলিত এবং এ জন্যই তিনি সব থেকে বেশি পরিচিত।

আধুনিক ভাষা ব্যবহার করে এবং নানা জটিলতা বাদ দিয়ে রামায়ণ-কাহিনিকে তিনি আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। তিন বছর পরে হাত দেন আরও কঠিন মহাভারত অনুবাদের কাজে। বিপুলায়তন পুরাণ-কাব্যের সারমর্ম অক্ষত রেখে মহাভারতের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেন রাজশেখর বসু। রাজশেখর বসুকে বাংলা বানানের বিধি ঠিক করার জন্য অভিধান রচনা করার অনুরোধ করেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। একা এই কাজ সম্ভব হবে না বুঝে সহযোগী হিসেবে সঙ্গে নেন সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহাকে। যে সমস্ত শব্দের একাধিক বানান আছে সেগুলির তালিকা তৈরি করেন। বানান নির্বাচনের মতামত চেয়ে তালিকা পাঠান রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, যোগেশ বিদ্যানিধি, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে। ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘চলন্তিকা’, প্রথম মুদ্রণে শব্দের সংখ্যা ২৬০০০ ও পরে বাড়িয়ে ৩০০০০ ছিল। সব সময়ে ব্যবহারের উপযোগী এই অভিধান বাঙালির খুব কাজের বই হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্বীকৃতি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি বলেন “এতদিন পরে বাঙলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল”।’চলন্তিকা’র পরিশিষ্ট অংশে বিষয় অনুযায়ী রাজশেখর বসু প্রচুর পরিভাষা সাজান। যেমন বিজ্ঞান সংক্রান্ত পরিভাষার তালিকায় ঠাঁই পায় ‘পাটীগণিত’, ‘বীজগণিত’, ‘বলবিদ্যা’, ‘পদার্থবিদ্যা’ ইত্যাদি। তাঁর সেই ভূমিকা আরও বড় হয় ১৯৩৪ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা সমিতিতে। রাজশেখর বসু ছিলেন সভাপতি। সদস্য ছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, দুর্গামোহন ভট্টাচার্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, প্রমথনাথ বিশী প্রমুখ।

বিজ্ঞান ও সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য রাজশেখর বসু জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৪০), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫), সরোজিনী পুরস্কার (১৯৫৫), সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার (১৯৫৮) ও পদ্মভূষণ (১৯৫৬) উপাধি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৫৮ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট (ডিলিট) উপাধি দেয়।

সাহিত্য বা বিজ্ঞানের কাজ ছাড়াও তিনি নানা সমাজসেবা ও পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন। যেমন, তিনি লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবীদের রাসায়নিক পদার্থ, টাকা ও রসায়নবিদ্যা সংক্রান্ত তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতেন।

১৯৪২ সালে রাজশেখর বসুর একমাত্র মেয়ে এবং জামাই মারা যান, কিছুদিন পর মারা যান তাঁর স্ত্রীও। জীবনের শেষ আঠারো বছর শোকের ভেতর দিয়ে কাটে। লেখেন অমূল্য সব সাহিত্য। 
১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল ঘুমন্ত অবস্থায় মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে কলকাতায় নিজের বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়।

3 comments

আপনার মতামত জানান