সববাংলায়

অ্যালফ্রেড হিচকক

ব্রিটিশ-আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক অ্যালফ্রেড হিচকক (Alfred Hitchcock) রহস্য-রোমাঞ্চ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত। প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ করার পরে ১৯৩৯ সালে তিনি ব্রিটেনে আসেন চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য। ছয় দশকের কর্মজীবনে পঞ্চাশটিরও বেশি ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি। নির্বাক ছবির সময় থেকে শুরু করে সবাক ছবি এবং রঙিন ছবির সময়কালেও চিত্র পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন হিচকক। চলচ্চিত্র জগতে সর্বকালের একজন অপ্রতিরোধ্য পরিচালক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি, তাঁর খ্যাতি ছিল রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার ছবির ক্ষেত্রে। তাঁকে ‘সাসপেন্সের ওস্তাদ’ বলা হয়। তাঁর ছবিতে প্রায়ই দেখা যায় চরিত্রের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং তাঁদের নিজস্ব অস্তিত্বের পুনর্নির্মাণ। অনেকক্ষেত্রে হিচককের ছবিতে চরিত্রদের অনুসরণ করতে দেখা যায় ক্যামেরাকে, পরবর্তীকালে ক্যামেরার এই চলমানতা তাঁর একটি বিশেষ কৌশলে পরিণত হয়। ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ-জার্মান নির্বাক ছবি ‘দ্য প্লেজার গার্ডেন’-এর মধ্য দিয়েই পরিচালনার জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে হিচককের। তাঁর পরিচালিত কিছু বিখ্যাত ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেশ’ (১৯৩৮), ‘রেবেকা’ (১৯৪০), ‘শ্যাডো অফ এ ডাউট’ (১৯৪৩), ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) এবং ‘সাইকো’ (১৯৬০)।

১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট লন্ডনের লেটোনস্টোন শহরে এক আইরিশ ক্যাথলিক পরিবারে অ্যালফ্রেড হিচককের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম উইলিয়াম হিচকক এবং মায়ের নাম ছিল এমা জেন হিচকক। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন অ্যালফ্রেড হিচকক। পরবর্তীকালে ১৯২৬ সালে সহকারী পরিচালক আলমা রেভিলকে  বিবাহ করেন তিনি। ১৯২৮ সালে তাঁদের এক কন্যা সন্তান জন্মায় প্যাট্রিসিয়া নামে।

লন্ডনে একটি ক্যাথলিক আবাসিক স্কুলে পাঠানো হয়েছিল হিচকককে। তাঁর শৈশব কেটেছে নিতান্ত একাকিত্বের মধ্যে। ১৪ বছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর জেসুইটদের দ্বারা পরিচালিত ইগনেটিয়াস কলেজ ছেড়ে অ্যালফ্রেড হিচকক ভর্তি হন ‘স্কুল ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড নেভিগেশন’-এ।

আরও পড়ুন:  সুধীর চক্রবর্তী

সেই প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হওয়ার পরে একটি তার প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে একজন ড্রাফটসম্যান এবং একজন বিজ্ঞাপন বিন্যাসকারক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন অ্যালফ্রেড হিচকক। ক্রমে ফটোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় লন্ডনের ফ্লেজিং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে শুরু করেন হিচকক। ১৯২০ সালে ইসলিংটন স্টুডিওতে এরপরে তিনি পূর্ণ সময়ের জন্য কাজে যোগ দেন। সেই সময় তাঁর কাজ ছিল নির্বাক ছবির জন্য পোস্টার ও টাইটেল কার্ড লিখে দেওয়া। ১৯২৫ সালে গেইনসবরো পিকচার্সের জনৈক মাইকেল ব্যালকনের বদান্যতায় ‘দ্য প্লেজার গার্ডেন’ নামে তাঁর প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেন অ্যালফ্রেড হিচকক। তাঁর তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘দ্য লসার : এ স্টোরি অফ দ্য লন্ডন ফ্রগ’ মুক্তি পায় ১৯২৭ সালে। জার্মানিতে অভিব্যক্তিবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল তাঁর এই কাজটি। মনে করা হয় হিচককের ধারার এটিই প্রথম ছবি। ১৯২৯ সালে তাঁর দশম চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাকমেইল’ এর কাজ শুরু করেন হিচকক। ১৯৩৩ সালে হিচকক গাউমন্ট-ব্রিটিশ পিকচার্স কর্পোরেশনের জন্য কাজ করেন এবং এই সংস্থার হয়ে তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি ছিল ‘দ্য ম্যান হু নো টু মাচ’। ১৯৩৪ সালে এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরের বছরই ১৯২৫ সালে মুক্তি পায় অ্যালফেড হিচকক পরিচালিত ‘দ্য থার্টি নাইন স্টেপস’ ছবিটি। এই ছবিটিকে হিচককের প্রাথমিক পর্বের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে মনোনীত করা হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁর সবথেকে বড় সাফল্য ছিল ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেশ’ ছবিটি যেখানে প্রথম তিনি অ্যামনেশিয়ার মত বিশেষ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে হলিউড ছবি পরিচালনার জন্য আহ্বান পান অ্যালফ্রেড হিচকক। ১৯৪০-এর দশক থেকেই হলিউড ছবির দুনিয়ায় কাজ করতে শুরু করেন তিনি। তাঁর পরিচালিত প্রথম আমেরিকান ছবি ছিল ‘রেবেকা’ (Rebecca), যদিও এই ছবির কাহিনী নির্মিত হয়েছিল ইংরেজ লেখক ডেম ডাফনে ডু মরিয়ারের উপন্যাস অবলম্বনে এবং এই ছবির প্রেক্ষাপটও ছিল ব্রিটেন-কেন্দ্রিক। এই ছবিটি ১৯৪০ সালের সেরা ছবি হিসেবে অ্যাকাডেমি পুরস্কার জিতেছে। এই সময়পর্বের গোড়ার দিকে হিচককের কাজের মধ্যে সবথেকে বেশি বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। এই সময়েই তাঁর পরিচালিত বিখ্যাত রোমান্টিক কমেডি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ (১৯৪১) থেকে শুরু করে ‘দ্য ডার্ক অ্যান্ড ডিস্টার্বিং শ্যাডো অফ এ ডাউট’ (১৯৪৩) নামের একটি সম্পূর্ণ রহস্য-রোমাঞ্চ ধারার ছবিও রয়েছে। গ্রেগরি পেক এবং ইনগ্রিড বার্গম্যানের সঙ্গে অ্যালফ্রেড হিচকক যৌথভাবে পরিচালনা করেন ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবিটি। এই ছবিতেই প্রথম ‘সাইকো অ্যানালিসিস’ তথা মনঃসমীক্ষণের তাত্ত্বিক নীতির একটি রূপরেখা দেখা যায়। তাঁর পূর্বতন ছবি ‘দ্য লেডি ভ্যানিশেশ’-এর মত এখানেও অ্যামনেশিয়া এবং ট্রমাটিক শক-এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন হিচকক এবং এই ছবিতেই একটি স্বপ্নদৃশ্য রচনা করেছিলেন স্বয়ং সালভাদোর দালি। ১৯৪৬ সালে পুনরায় বার্গম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে ‘নটোরিয়াস’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেন অ্যালফ্রেড হিচকক। এই ছবির মধ্য দিয়েই বিখ্যাত অভিনেতা ক্যারি গ্রান্টের সঙ্গে তাঁর আলাপ ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়। যুদ্ধোত্তর পটভূমিতে নাৎসি, ইউরেনিয়াম এবং উত্তর আমেরিকাকে কেন্দ্র করে এই ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। অনেক সমালোচকের মতে এই ছবিটি অ্যালফ্রেড হিচককের অন্যতম সেরা কাজ। ১৯৪৮ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম রঙিন ছবি ‘রোপ’ মুক্তি পায়। দীর্ঘ দশ মিনিটব্যাপী ‘মার্শালিং সাসপেন্স’ রীতি ব্যবহার করেছেন হিচকক এই ছবিতে। ১৯৫১ সালে ‘স্ট্রেঞ্জারস অন এ ট্রেন’ ছবি থেকেই হিচকক তাঁর পূর্বতন ব্রিটিশ ও আমেরিকান ছবির ভালো ভালো কিছু বৈশিষ্ট্যকে নিজের ছবিতে প্রয়োগ করতে শুরু করেন। ফ্রেডারিক নটের নাটক অবলম্বনে নির্মিত হিচকক পরিচালিত ‘ডায়াল এম ফর মার্ডার’ ছবিতে প্রথম ত্রিমাত্রিক সিনেমাটোগ্রাফি ব্যবহার করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এই সময়পর্বে পরপর আরও দুটি ছবি মুক্তি পায় ‘রিয়ার উইন্ডো’ এবং ‘টু ক্যাচ এ থিফ’। এই তিনটি ছবিতেই মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন গ্রেস ক্যালি। ১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় বিশ্বজনীন স্তরে পরিচিত ও জনপ্রিয় ছবি ‘ভার্টিগো’ যা হিচককের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালনার দৃষ্টান্ত। বিখ্যাত অভিনেতা জিমি স্টুয়ার্ট, কিম নোভাক এবং বারবারা বেল এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। এই সময়পর্বে আরও তিনটি ছবি পরিচালনা করেন অ্যালফ্রেড হিচকক যার মধ্যে রয়েছে ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’ (১৯৫৯), ‘সাইকো’ (১৯৬০) এবং ‘দ্য বার্ডস’ (১৯৬৩)। শেষের দুটি ছবির অপ্রচলিত আবহ নির্মাণের জন্য চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন:  আদিত্য বিক্রম বিড়লা

তাঁর ছবিতে বেশিরভাগ সময়েই হিচকক নিজেই একটি অতিথি চরিত্রে উপস্থিত থাকেন। সংক্ষিপ্ত একটি মুহূর্তের জন্য কখনও বাসে উঠতে, কখনও একটি বাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পেরোতে, কখনও একটি বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে কিংবা একটি ছবিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল অ্যালফ্রেড হিচককের একটি প্রধানতম অভিনব শৈলী। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও তাঁর ছবিগুলিতে বিশেষ কৃতিত্বের অবকাশ ছিল। ‘লাইফবোট’ নামের একটি ছবিতে সমগ্র অ্যাকশন দৃশ্যটিই হিচকক শ্যুট করেছিলেন একটি নৌকার উপর। আবার রোপ ছবিটি মনে করা হয় সম্পূর্ণ একক শটে তোলা। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভার্টিগো’ ছবিতে একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন তিনি যাকে চিত্র সমালোচকেরা ‘হিচকক জুম’ নামে অভিহিত করেন। অভিনেতাদের সঙ্গে গবাদি পশুর মত ব্যবহার করা উচিত এমন মন্তব্যের কারণে অ্যালফ্রেড হিচকক বহুবার সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনই চিত্রনাট্যকার কিংবা অভিনেতাদের প্রাধান্যকে স্বীকার করেননি।

ছবি পরিচালনা থামানোর পর টিভি ধারাবাহিকের মাধ্যমেই নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত হতে শুরু করেন অ্যালফ্রেড হিচকক। ১৯৮০ সালের ৩ জানুয়ারি রানি এলিজাবেথ অ্যালফ্রেড হিচককে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন নাইট কমান্ডার হিসেবে সম্মানিত করেন। একজন প্রযোজক হিসেবে তিনি ১৯৪১ সালে ‘সাসপিসিয়ন’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ ছবি হওয়ার সুবাদে অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে সম্মানসূচক অস্কার পুরস্কার অর্জন করেন অ্যালফ্রেড হিচকক। ‘রেবেকা’, ‘লাইফবোট’, ‘স্পেলবাউন্ড’, ‘রিয়ার উইন্ডো’ এবং ‘সাইকো’ এই পাঁচটি ছবির জন্য তিনি সেরা পরিচালকের অভিধায় ভূষিত হয়েছেন।

১৯৮০ সালের ২৯ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্ণিয়ার বেল এয়ারে অ্যালফ্রেড হিচককের মৃত্যু হয়।   

error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন।

Discover more from সববাংলায়

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

চৈতন্যদেবের অসামান্য জীবনী দেখুন

চৈতন্য জীবনী

ভিডিওটি দেখতে ছবিতে ক্লিক করুন