আদিত্য বিক্রম বিড়লা

আদিত্য বিক্রম বিড়লা

ভারতের শিল্প-বাণিজ্যের এক অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ ছিলেন আদিত্য বিক্রম বিড়লা (Aditya Vikram Birla)। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই তিনি সমগ্র বিশ্বে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতকে বিশ্বের দরবারে ব্যবসায়িক পরিচিতি দিয়েছিলেন প্রথম এই ভারতীয়। একজন বিখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ভারতীয় শিল্পপতি হিসেবেই তিনি জনমানসে পরিচিত। ভারতের বস্ত্রবয়ন শিল্প, পেট্রোকেমিক্যালস এবং টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থাকে তিনিই প্রথম সুদূর থাইল্যাণ্ড, মিশর, ফিলিপাইন্‌স-এর বুকে প্রসারিত করেন। আদিত্য বিড়লা গ্রুপ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন যার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি স্বয়ং। ‘ভারতের প্রথম বৈশ্বিক শিল্পপতি’ ছিলেন আদিত্য বিক্রম বিড়লা।

১৯৪৩ সালের ১৪ নভেম্বর কলকাতায় সম্ভ্রান্ত এবং অভিজাত এক ব্যবসায়ী পরিবারে আদিত্য বিক্রম বিড়লার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম বসন্ত কুমার বিড়লা এবং মায়ের নাম সরলা বিড়লা। তাঁর ঠাকুরদাদা ছিলেন ঘনশ্যাম দাস বিড়লা মহাত্মা গান্ধীর সহযোগী ছিলেন এবং অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠিত হন, প্রসিদ্ধ অ্যামবাসাডর গাড়ির প্রথম নির্মাতাও তিনি। আদিত্য কুমার বিড়লার বাবা বসন্ত কুমার বিড়লাও ছিলেন এক বিখ্যাত শিল্পপতি।

আদিত্য বিক্রম বিড়লা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (Massachusetts Institute of Technology) থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রিলাভ করেন। এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, কলকাতায় থাকাকালীন বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শ্রী দুর্গাপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে তাঁর সংস্কৃত-শিক্ষাও সম্পূর্ণ হয়েছিল।


সববাংলায় সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আজই যোগাযোগ করুন
contact@sobbanglay.com


 

আদিত্য বিক্রম বিড়লার কর্মজীবন শুরু হয় ম্যাসাচুসেট্‌স থেকে ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফেরার পর। ঠাকুরদাদা ঘনশ্যাম দাস তাঁকে অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে মনোনিবেশ করতে বলেন। কিন্তু তিনি তাঁর আদেশ উপেক্ষা করে নিজের প্রচেষ্টা ও দক্ষতায় বস্ত্রবয়ন শিল্প তথা টেক্সটাইল শিল্পে খুব অল্প সময়েই প্রতিষ্ঠিত হন। কলকাতায় তিনিই প্রথম ‘ইস্টার্ন স্পিনিং মিলস’ (Eastern Spinning Mills) প্রকল্প শুরু করেন যার মধ্য দিয়ে দ্রুতই তিনি সাফল্য অর্জন করেন। প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া রেয়ন এবং বস্ত্রবয়ন বাণিজ্যকে তিনি আবার আগের স্বাভাবিক গতিপথে ফিরিয়ে আনেন। এই ব্যবসাগুলিও প্রভূত লাভের মুখ দেখে। ১৯৬৯ সালে আদিত্য বিক্রম বিড়লা প্রথম ইন্দোনেশিয়ায় টেক্সটাইল প্লান্ট চালু করেন ভারতের যৌথ-প্রকল্পের মাধ্যমে। এই সূত্রেই তিনি আদিত্য বিড়লা গ্রুপের প্রথম বিদেশি কোম্পানি তৈরি করেন, যার নাম ‘ইন্দো-থাই সিনথেটিক্স কোম্পানি লিমিটেড’ (Indo-Thai Synthetics Company Ltd.)। এই প্লান্ট তারপর তিনি ফিলিপাইন্সেও স্থাপন করেন। ১৯৭৩-এ কাটা সুতো তৈরির জন্য তিনি ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি করেন পি. টি. এলিগ্যান্ট টেক্সটাইল (P. T. Elegant Textile)। ঠিক তার পরের বছর, ১৯৭৪-এ থাইল্যাণ্ডে ‘ভিস্কোস রেয়ন স্টেপল ফাইবার’-এর (Viscose Rayon Staple Fibre) ব্যবসা চালু করেন আদিত্য বিড়লা গ্রুপের মাধ্যমেই। ধীরে ধীরে ১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়াতে ভোজ্য তেলের পরিশোধন শিল্পকেন্দ্র এবং মিশরে কার্বন ব্ল্যাক (Carbon Black) উৎপাদন শিল্পকেন্দ্র স্থাপন করেন আদিত্য বিক্রম বিড়লা। মালয়েশিয়ায় তাঁর তৈরি তৈল শোধনাগারটি বিশ্বের বৃহত্তম পাম তেল শোধনাগারের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে। ১৯৮২ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল পি. টি. ইন্দো ভারত রেয়ন কোম্পানি যারা কিনা ইন্দোনেশিয়ায় ভিস্কোস স্টেপ্‌ল ফাইবারের প্রথম উৎপাদনকারী ছিল। এভাবে মাত্র বারো-তেরো বছরের মধ্যে আদিত্য বিক্রম বিড়লা র গ্রুপ টেক্সটাইল, কেমিক্যালস্‌, ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী, রাসায়নিক সার এবং পাম তেলের সবথেকে বৃহৎ উৎপাদক হয়ে ওঠে। আদিত্য বিক্রম বিড়লার ভারতীয় উৎপাদক সংস্থাগুলির মধ্যে ‘হিন্দালকো’ (Hindalco) এবং ‘গ্রাসিম’ (Grasim) অত্যন্ত বিখ্যাত। ‘হিন্দালকো’ সমগ্র বিশ্বের মধ্যে স্বল্প-মূল্যের অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতকারক হিসেবে খ্যাত আর ভিস্কোস স্টেপ্‌ল ফাইবারের সর্ববৃহৎ প্রস্তুতকারক হিসেবে পরিচিত ‘গ্রাসিম’। ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি তখনো ভারতবাসীর কাছে ততটা পরিচিত হয়নি, তার আগেই শিল্প-বাণিজ্যের বিশ্বায়ন এনে দিয়েছিলেন আদিত্য বিক্রম বিড়লা। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ড. নরসিংহ রাও এবং পূর্বতন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং যে সময় অর্থনৈতিক মুক্তবাজারের পরিকল্পনা করেছিলেন, আদিত্য বিক্রম বিড়লা সেই পরিকল্পনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিশ্বের উন্নততম পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন। ভারতের বাইরে থাইল্যাণ্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স, মিশর প্রভৃতি দেশে তিনি মোট ১৯টি কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন।

আদিত্য বিক্রম বিড়লার অভিধানে বিশ্বায়নের অর্থ শুধুমাত্র ভৌগোলিক বিস্তৃতি ছিল না, তিনি বিশ্বাস করতেন শুধু ভারতবর্ষকেন্দ্রিক হয়েও বিশ্ব-বাণিজ্যের অংশীদার হওয়া যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যকে ভারতের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তাঁর দক্ষতায় ও প্রচেষ্টায় আদিত্য বিড়লা গ্রুপ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ইনসুলেটর উৎপাদক এবং ষষ্ঠ বৃহত্তম কার্বন ব্ল্যাক উৎপাদকে পরিণত হয়। এছাড়াও তাঁর গ্রুপ ভারতের টেক্সটাইল শিল্পে একমাত্র লিনেন উৎপাদক এবং সিমেন্ট তৈরিতেও তাঁর এই গ্রুপের খ্যাতি সুবিদিত। ১৯৮৩ সালে আদিত্য বিক্রম বিড়লার ঠাকুরদাদা ঘনশ্যাম দাস বিড়লার মৃত্যুর পরে হঠাৎ করেই ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পূর্ণ দায়ভার তাঁর উপর বর্তায়, বিড়লা গ্রুপের সমস্ত কোম্পানিগুলির একমাত্র পরিচালক হয়ে ওঠেন আদিত্য বিক্রম বিড়লা যখন তাঁর বয়স ৪০ বছর। আজও ভারতের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব রেখে চলেছে আদিত্য বিক্রম বিড়লার এই গ্রুপ।

ভারতের অর্থনীতি এবং আপামর সমাজে এককভাবে বিপুল অবদানের জন্য আদিত্য বিড়লা ভারতে এবং সমগ্র বিশ্বে বহু সম্মান ও পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে ম্যাড্রাস ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে তিনি ‘দ্য বিজনেস লিডারশিপ এওয়ার্ড’ (The Business Leadership Awrad) লাভ করেন। বম্বে ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (Bombay Management Association) ১৯৯২ সালে তাঁকে ‘ম্যানেজমেন্ট ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ (Management Man of the Year) সম্মানে ভূষিত করে। রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট কনফারেন্স (Rotery International District Conference) আদিত্য বিক্রম বিড়লাকে ‘ভোকেশনাল এক্সিলেন্স এওয়ার্ড’ (Vocational Excellence Award) দেয় ১৯৯৫ সালে। তাছাড়াও ভারতের সবথেকে বড়ো সম্মান তিনি পেয়েছিলেন বিজনেস ইন্ডিয়ার (Business India) তরফ থেকে ১৯৯০-তে; ‘বিজনেসম্যান অফ দ্য ইয়ার এওয়ার্ড’ (Businessman of the Year Award)। এছাড়াও নানা সময় বহু সম্মান-সংবর্ধনা পেয়েছেন যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –

এফ আই ই ফাউণ্ডেশনের (FIE Foundation) পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভূষণ পুরস্কার, ১৯৯২ অল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন অফ ইণ্ডাস্ট্রি’র (All India Association of Industries) তরফে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার (Lifetime Achievement Award), ১৯৯৬ মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্য লায়ন্‌স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ফাউণ্ডেশন (Lions Club International Foundation) তাঁকে মেলভিন জোন্‌স ফেলো পুরস্কারে (Melvin Jones Fellow Award) ভূষিত করে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-উৎপাদন ছাড়াও আদিত্য বিক্রম বিড়লা চিত্রশিল্প, সঙ্গীত এবং ব্যাডমিন্টন খেলায় আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯৩ সালে পারফর্মিং আর্টসকে (Performing Arts) উৎসাহ দিতে এবং তার উন্নতির জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সঙ্গীত কলা কেন্দ্র’। থিয়েটার এবং পারফর্মিং আর্টসে প্রতিবছর শ্রেষ্ঠত্বের খাতিরে ‘কলাশিখর’ (Kalasikhar) এবং ‘কলাকিরণ’ (Kalakiran) পুরস্কার চালু করেন তিনি। তাঁর স্মৃতিতে আদিত্য বিড়লা গ্রুপ একটি বৃত্তি (Scholarship) চালু করে। প্রতি বছর সাতটি ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, ভারতীয় টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, বিড়লা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স-এর বহু পণ্ডিত এই বৃত্তি পান। ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ভারত সরকার আদিত্য বিক্রম বিড়লার নামে একটি বিশেষ স্মারক প্রকাশ করে তাঁর স্মৃতিতে এবং আদিত্য বিক্রম বিড়লাকে ‘ভারতের প্রথম বৈশ্বিক শিল্পপতি’ ( India’s First Global Industrialist) হিসেবে মরণোত্তর সম্মান জানায়। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাঁকে ভারতের সেরা এবং উজ্জ্বল নাগরিক’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। আদিত্য বিড়লা গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা এই মানুষটির মৃত্যুকালে সম্পত্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫০ মিলিয়ন পাউন্ড। পুনেতে তাঁর নামেই স্থাপিত হয়েছে আদিত্য বিড়লা মেমোরিয়াল হাসপাতাল। তাঁর অনুপস্থিতিতে পুত্র কুমারমঙ্গলম বিড়লা এবং স্ত্রী রাজশ্রী বিড়লা আদিত্য বিড়লা গ্রুপের দায়ভার সামলান। কুমার মঙ্গলম বিড়লাই বর্তমানে এই গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাঁর কন্যার নাম বাসবদত্তা বিড়লা।

 ১৯৯৫ সালের ১ অক্টোবর বাল্টিমোরের জন হপকিন্স হাসপাতালে বিরল প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫১ বছর বয়সে আদিত্য বিক্রম বিড়লার মৃত্যু হয়।

আপনার মতামত জানান