হজ মুসলমানদের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় ইবাদত বা ধর্মীয় উপাসনা। অনেক সময় একে হজ্জ নামেও অভিহিত করা হয়। এটি ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ। হজ বলতে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় যাওয়াকে বোঝায়। যিনি হজ করতে মক্কায় আসেন, তাকে হাজী বলে। বলা হয় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানকেই তার জীবনে একবার হলেও হজ করা উচিত। তবে শারীরিক ও আর্থিক ভাবে সক্ষম হলে তবেই হজযাত্রা আবশ্যিক বলে বিবেচিত হয়।
হিজরি বছরের শেষ মাস হল জিলহজ। এই মাস মুসলিমদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসেরই ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধারিত করা রয়েছে। জিলহজের ১০ তারিখে পালিত হয় ইসলামের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ইদুজ্জোহা।
বিভিন্ন ইসলামিক বর্ণনায় উল্লেখ আছে হজরত ইব্রাহিম তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। বলা হয় তিনি আল্লাহর থেকেই তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানকে মক্কায় নির্বাসনে রেখে আসার নির্দেশ পেয়েছিলেন। তিনি চলে আসার পর একসময়ে তাদের সঙ্গে আনা খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে যায়। শিশু ইসমাঈল ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কান্নাকাটি শুরু করে। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি জলের খোঁজে সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেন। এই ঘটনাকে স্মরণ রেখেই হজের সময় মুসলিমদের জন্য সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হাঁটার নিয়ম রয়েছে। এভাবে দৌড়াদৌড়ি করার পর সপ্তমবারে হাজেরা দূর থেকে দেখেন যে, শিশু ইসমাঈলের পায়ের আঘাতে মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসছে জল। অন্য একটি বর্ণনা অনুযায়ী যখন হাজেরা এবং শিশু ইসমাঈল জলের জন্য ছটফট করছিল, তখন আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাঈল নামের ফেরেশতা (স্বর্গীয় দূত) মাটিতে গোড়ালির আঘাতে ফোয়ারার সৃষ্টি করলেন। হাজেরা ছুটে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলেন অসীম মমতায়। এবং দুজনে এই জল পান করে আল্লাহকে অনেক ধন্যবাদ জানালেন। হজে আসা মুসলমানদের জন্য মক্কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল জমজমের জলপান।
হঠাৎ কাছেই একটি শব্দ শুনে হাজেরা চমকে উঠলেন। জিব্রাঈল বললেন, “তোমরা ভয় পেয়ো না। এখানেই আল্লাহর ঘর। তোমার স্বামী ও সন্তান এই ঘর শীঘ্রই পুনর্নির্মাণ করবেন।” বলেই সেই শব্দ মিলিয়ে গেল। পরবর্তীকালে ইব্রাহিম তাঁর পুত্র ইসমাঈলের সাথে মিলিত হয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশেই হজরত ইব্রাহিম কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ করেন। বলা হয় পৃথিবীতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ইমারত হচ্ছে মক্কাতে অবস্থিত পবিত্র কাবা , যা ‘বায়তুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর ঘর’ নামে পরিচিত। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বায়তুল্লাহ প্রথমে ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। পরে হজরত আদম তা পুনর্নিমাণ করেন। তারপর বহুযুগ পরে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম ছেলের সাথে সেটি পুনর্নির্মাণ করেন। হজরত ইব্রাহিমই সর্বপ্রথম কাবাকে কেন্দ্র করে হজেরও প্রবর্তন করেন। তাঁর আহ্বানে লোকেরা মক্কায় হজের জন্য আসতে থাকে। তারপর থেকে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে লোকজন হজের জন্য সমবেত হতে থাকে।
বলা হয়, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা জয়ের আগের কয়েকশ বছর ধরে হজের নিয়মে যে পরিবর্তন হয়েছিল, তা হজরত ইব্রাহিমের প্রবর্তিত পথ নয়। মানুষ তাঁর দেখানো পথে না চলে পথ ভুলে গিয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা জয়ের পরে তিনি কাবার অনেক সংস্কার করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনে একবারই হজ করেছিলেন। তবে তাঁর যদিও এই নিয়ে বিতর্কও আছে। দশম হিজরি বছরে তিনি হজের জন্য যাত্রা করেন। তখন তাঁর সঙ্গে ছিল অসংখ্য মানুষ। ইসলামে এটি ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ হজযাত্রা। এটি ‘বিদায়ী হজ’ নামেই অধিক পরিচিত। এখানে মুসলিমদের জন্য তিনি যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাকে বিদায়ী হজের খুতবা বলা হয়। খুতবা হল মুসলিমদের উদ্দেশ্যে দেওয়া উপদেশমূলক বক্তৃতা। বলা হয়ে থাকে তখন থেকেই হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হয়ে ওঠে।
বলা হয় হজ যাত্রা মুসলমানদের অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় বিধি এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ যাত্রা করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু একটি শর্ত আছে। যদি সে শারীরিক এবং আর্থিকভাবে সক্ষম হয়। সামর্থ্যবানদের জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর হজ করার কথা বলা হয়। সম্ভব হলে প্রতিবছর হজে গেলে ভালো। হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও শারীরিকভাবে অক্ষম হলে অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করানো যায়। এমনকি জীবদ্দশায় হজে যেতে পারেনি, এমন ব্যক্তিরও বদলি হজের ব্যবস্থা করা যায়। সে মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি থেকে খরচ করা হয়। পরিচিত বা অপরিচিত যেকোন ব্যক্তিরই বদলি হজ করা যায়।
প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ হজের জন্য সৌদি আরবে আসেন। ১৯২০ সালে যে হাজীর সংখ্যাটা ছিল প্রায় ৫৯ হাজার তা বেড়ে ২০১২ সালে হয়েছে প্রায় ৩১ লাখ। তেল ও গ্যাসের পরে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ আয়ের উৎস এই হজযাত্রা থেকে আসে।
হজ নিয়ে তথ্যমূলক ভিডিও দেখুন এখানে
তথ্যসূত্র
- https://en.wikipedia.org/Hajj
- https://www.britannica.com
- https://www.bbc.co.uk
- https://www.humanappeal.org.uk
- https://www.prothomalo.com/
- https://www.bd-pratidin.com/
- https://www.jagonews24.com/
- https://www.at-tahreek.com/
- https://www.quraneralo.com/
- https://en.wikipedia.org/History_of_the_Hajj
- https://www.islamicfinder.org/
খুব ভালো লেখা। সঠিক তথ্য।ধন্যবাদ।