কাবা শরীফ ।। কাবাঘর

কাবা শরীফ ।। কাবাঘর

কাবা বা কাবা শরীফ (Kaaba Sharif) বা কাবাঘর হল ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে গোটা মুসলিম উম্মাহ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমরা হজ পালনের উদ্দেশ্যে কাবাঘর আসেন। কাবাঘর সৌদি আরবের মক্কার মসজিদুল হারামে অবস্থিত।

পবিত্র কাবা কখন নির্মিত হয়েছিল এ নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। হাদিসের ভাষ্য (বুখারি শরিফে উল্লেখিত হাদিস : ৩২০৭) মতে, কাবার নিচের অংশ হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম জমিন। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির ২ হাজার বছর আগে সেখানে পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা নির্মাণ করা হয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির আগে ফেরেশতা ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন। ফেরেশতারা ইবাদতের জন্য একটি ইবাদতখানার আবেদন করলে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের জন্য সপ্তম আকাশে ‘বায়তুল মামুর’ (কাবা-ঘর মতোই একটি ঘর, যেখানে ফেরেস্তারা ইবাদত করেন) নির্মাণ করেন এবং বায়তুল মামুরের আকৃতি দিয়ে ফেরেশতাদের পৃথিবীতে পাঠান। তারপর আল্লাহর নির্দেশেই ফেরেস্তারা কাবাঘর নির্মাণ করেন। পবিত্র কোরানের সুরা আল-ইমরানের ৯৬ আয়াতে বলা আছে মক্কাতে অবস্থিত কাবা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের ইবাদতের জন্য বানানো হয়েছে। হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে আসার পর এই কাবাঘরেই আল্লাহর ইবাদত করতেন।

কাবাকে বহুবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বপ্রথম কাবাঘর ফেরেশতাগণ নির্মাণ করেন। আল্লাহ তায়ালার হুকুমে হজরত আদম (আ.) কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। তারপর হজরত শিষ (আ.) এর পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে মহাপ্লাবনে কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.)। তারপর যথাক্রমে আমালিকা সম্প্রদায়, জুরহাম সম্প্রদায়, কুসাই বিন কিলাব, মোযার সম্প্রদায়, মক্কার কুরাইশগণ এর পুনর্নির্মাণ করেন। তারপর ৬০৫ সালে হজরত মহম্মদ (সা.) কাবা পুননির্মাণ করেছেন। তিনি কাবা পুননির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর বর্তমান স্থানে স্থাপন করেছিলেন। এরপর হজরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.), হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ এবং সবশেষে ওসমানিয়া খলিফা তুরস্কের বাদশা চতুর্থ মুরাদ কাবা পুনর্নির্মাণ করেছেন।

মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে জেরুজালেমকে তাদের কিবলা হিসাবে বিবেচনা করত। নামাজের জন্য মুসলমানদের যেদিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়, তাকে কিবলা বলে। মদীনায় হিজরতের ষোল মাস পর কিবলা পরিবর্তিত হয়ে কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়। কাবায় তীর্থযাত্রা মুসলমানদের জন্য একটি ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয়। ৬২৮ সালে, হজরত মহম্মদ (সা.) ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মুসলিমদের একটি দল নিয়ে মক্কার দিকে গেলে কুরাইশরা বাধা দেন। নবীজী তখন তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন,যেটি হুদায়বিয়ার চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির পর থেকেই মুসলমানরা পরের বছর থেকে কাবায় তীর্থযাত্রা করার অনুমতি পায়। কিন্তু ৬৩০ সালে, কুরাইশদের বন্ধু, বনু বকর, হুদায়বিয়ার এই চুক্তি লঙ্ঘন করে। তখন হজরত মহম্মদ (সা.) ১০ হাজার মুজাহিদ সাহাবি নিয়ে, মক্কাভিমুখী রওনা হন এবং বিনা রক্তপাতেই বিজয়ীরূপে মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কা বিজয়ের পর নবীজি (সা.) কাবাঘরের চাবি বনি শায়বাহ গোত্রের ওসমান ইবনে তালহা (রা.)-এর কাছে হস্তান্তর করেন। বংশপরম্পরায় এখনও তারাই কাবাঘরের চাবির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বছরে দুবার এই ঘর খোলা হয়। একবার রমজান মাসে, আরেকবার ইদুজ্জোহার ১৫ দিন আগে পরিষ্কার করার জন্য।

কাবা কালো সিল্কের উপরে স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি করা কাপড়ের গিলাফে আবৃত থাকে। প্রায় ৭০০ কেজি প্রাকৃতিক রেশম দিয়ে তৈরি করা হয় কাবার পবিত্র গিলাফ। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে পরিচিত ; যা প্রতি বছর পরিবর্তন করা হয়। এই কাপড়ের মধ্যে সুতা দিয়ে কালেমা শাহাদাত লেখা হয়। মোট পাঁচ টুকরা গিলাফ বানানো হয়। চার টুকরা চারদিকে এবং পঞ্চম টুকরাটি কাবাঘরের দরজায় লাগানো হয়। গিলাফের এক-তৃতীয়াংশের ওপর দিকে ৯৫ সেন্টিমিটার প্রস্থের বন্ধনীতে সোনার প্রলেপ লাগানো রুপার সুতা দিয়ে কারুকার্যশোভিত আল্লাহর নাম এবং কোরানের বিভিন্ন আয়াত ক্যালিগ্রাফি করা হয়। এতে লেখা থাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, ‘আল্লাহ জাল্লা জালালুহু’, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম’, ‘ইয়া হান্নান, ইয়া মান্নান’ ইত্যাদি।

হজরত মহম্মদ (সা.) এবং তার অনুসারীদের মক্কা থেকে মদীনায় গমন করাকে হিজরত বলে। হিজরতের পূর্বে কে গিলাফ পরিয়েছিল তাতে মতবিরোধ থাকলেও এই ব্যাপারে সকলে একমত যে, হিজরতের ২২০ বছর আগে বাদশাহ তুব্বা আবি কারব আসাদ গিলাফের প্রথম প্রচলন করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর হজরত মহম্মদ (সা.) এবং হজরত আবু বকর (রা.) কাবা শরিফে গিলাফ পরিয়ে দেন। এরপর থেকে মুসলিম খলিফা এবং শাসকেরা এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়াও নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কাবা শরিফের গিলাফ পরানোর সৌভাগ্য অর্জন করেন আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের জননী নুতাইলা।

প্রতি বছর হজ অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে গোলাপের সুগন্ধি মিশ্রিত জমজমের পানি মেঝেতে ছড়িয়ে খেজুর পাতা দিয়ে কাবার অভ্যন্তর পরিষ্কার করা হয়। সৌদি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মক্কার গভর্নরের নেতৃত্বে হারামাইনের ইমাম ও মুয়াজজিনের অংশগ্রহণে এই পুরো কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। মাঝে মাঝে সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণও এই কাজে অংশগ্রহণ করেন।

কাবাকেন্দ্রিক ইসলামের ইবাদতের বিধানগুলির মধ্যে রয়েছে নামাজ, হজ, কোরবানি ও মৃত ব্যক্তির দাফন কাবার দিকে ফিরে আদায় করতে হয়। হাদিসের ভাষ্যমতে, কাবা চত্বরে নামাজ আদায় করলে এক রাকাতে ১ লাখ রাকাত নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়।

বর্তমানে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন সৌদি রাজপরিবার। কাবা শরীফের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন সৌদি সরকারপ্রধান (বাদশাহ)।

আপনার মতামত জানান