কালাপাহাড়

কালাপাহাড়

 

“শুনিছ না- ঐ দিকে দিকে কাঁদে রক্ত পিশাচ প্রেতের দল
শবভূক যত নিশাচর করে জগৎ জুড়িয়া কি কোলাহল!
দূর মশালের তপ্ত নিশ্বাসে ঘামিয়া উঠিছে গগন শিলা!
ধরণীর বুক থরথরি কাঁপে-একি তাণ্ডব নৃত্য লীলা।
এতদিন পরে উঠিল কি আজ সুরাসুর জয়ী যুগাবতার?
মানুষের পাপ করিতে মোচন, দেবতারে হানি ভীম প্রহার, কালাপাহাড়!” -কালাপাহাড়, মোহিতলাল মজুমদার।।

কালাপাহাড় নামের সাথে যারা ইতিহাস নিয়ে চর্চা রাখেন তাঁরা তো বটেই, আরও অনেকেই পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান সব সাহিত্যিক মুখরোচক করে কালাপাহাড়কে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করে গেছেন। প্রলয় ও সংহারক মূর্তির বিজ্ঞাপন হিসেবে যে নামটি নির্দেশ করে গেছেন তাঁরা, তিনি কালাপাহাড়।
“কোথা চেংগিস, গজনী মামুদ, কোথায় কালাপাহাড় ; ভেংগে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।”- মানুষ, কাজী নজরুল ইসলাম।
কিন্তু কে ছিলেন এই কালাপাহাড়? কেনই বা তিনি এতটা হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন? কেনই বা তাঁর এত রাগ ছিল দেবালয়গুলোর ওপরে?
কালাপাহাড় সম্বন্ধে আমরা যা জানি বা শুনি, তার কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যা সেটা যাচাই করা মুশকিল। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন মত পোষণ করেন। বিভিন্ন কারণ দেখানো হয়। তাঁর কোনও তৈলচিত্র নেই। তিনি কেমন দেখতে ছিলেন সেটাও কারোর জানা নেই। তবুও, মোটামুটি ইতিহাস ঘেঁটে যা উঠে আসে সেগুলোই লেখার চেষ্টা করা হল এখানে ।
বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী মতান্তরে নওগাঁ জেলার বীরজোয়ান গ্রামে ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক কট্টর ব্রাহ্মন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজীব লোচন রায় ওরফে রাজু ভাদুড়ী যাকে আমরা কালাপাহাড় জানি। তার বাবা ছিলেন নয়নচাঁদ রায়, যিনি গৌড়ের ফৌজদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। রায় ছিল তাঁদের পারিবারিক উপাধী, পদবি ছিল ভাদুড়ী। অকালেই নয়নচাঁদ মারা গেলে রাজু মায়ের কাছে লালিতপালিত হতে থাকেন। তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাজীব লোচন ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তিনি নিয়মিত বিষ্ণু পূজা দিতেন। রাজীব লোচনের দিনাতিপাতের সমসাময়িক সময়ে দিল্লির মসনদে গদি আঁকড়ে ধরে আছেন নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন আর বাংলায় চলছে হোসেন শাহী বংশের গর্বিত স্বাধীন সুলতানি যুগ। শেরশাহ হুমায়ূনকে সিংহাসনচ্যুত করলে দিল্লি আপাতত মোঘল শাসনের বাইরে চলে যায় এবং শেরশাহের স্বদেশী সেনাপতি সুলায়মান খান কররানী বাংলা অধিকার করেন। সুলায়মান খান কররানী যখন গৌড়ের শাসক সেসময় তিনি গৌড়ের সেনানীতে যোগদান করেন এবং অতি অল্পকালের মধ্যে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে সুনজরে পড়েন।সুলায়মান খান কররানী ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন খুবই ধুরন্ধর প্রজাতির। নিজ স্বার্থ আদায়ে কোন কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন একজন ঝানু কূটনীতিক। যার প্রমাণ পাওয়া যায়, মোঘলদের সাথে তার সহনশীল নীতি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, মোঘলদের বিরুদ্ধে তিনি পেরে উঠবেন না। তাই মুঘল সম্রাটদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়মিত উপহার উপঢৌকনাদি পাঠিয়ে শান্ত রাখতেন। উত্তর প্রদেশের শাসক মুনিম খানের মাধ্যমে তিনি সম্রাট আকবরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন আবার তলে তলে “হযরত -ই-আলা” উপাধি ধারণ করে প্রমাণ করেছিলেন তিনি মূলত একজন স্বাধীন শাসক। সুলায়মানের শাণিত চক্ষুর আড়াল হতে পারেননি কালাপাহাড়। গৌড়ের সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ সৈন্য থেকে তুলে আনেন তাকে এবং অসম এক প্রস্তাব দিয়ে বসেন!
এবারে, অন্য ঐতিহাসিকদের মত। কালাপাহাড় প্রথম থেকেই সুলায়মান খান কররানীর বাহিনী তে ছিলেন বলে অন্য ঐতিহাসিকরা মনে করেন না। তাঁদের মতে-
তিনি ছিলেন কলিঙ্গ উৎকল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট গজপতি মুকুন্দ দেবের সেনাপতি। ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে, রাজীব লোচন রায়ের নেতৃত্বাধীন গজপতি মুকুন্দদেব ও ভুরশুট সাম্রাজ্যের রাজা রুদ্রনারায়ণ এর সেনাবাহিনী ত্রিবেণীর যুদ্ধে বাংলার সুলতান সুলেমান কাররানী কে পরাজিত করে। পরাজিত সুলেমান সন্ধি করতে বাধ্য হন।
তবে কালাপাহাড় যে আদতে হিন্দু বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
এবারে আসে তাঁর ধর্মান্তরিত হবার প্রসঙ্গ। এখানেই ঐতিহাসিকরা দুটি মতে বিভক্ত।
প্রথম মত- কররানী কে সন্ধী প্রস্তাবে রাজি করাতে গিয়ে রাজু ভাদুড়ী তাঁর সুন্দরী কন্যা দুলারী বিবির প্রেমে পড়ে যান। কারও মতে কররানী নিজেই তাঁর কন্যাকে টোপ রূপে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ রাজু ভাদুড়ীর যোগ্যতা নিয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল না। কররানী জানতেন যে রাজু ভাদুড়ী তাঁকে তাঁর সম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করতে পারেন। কারও মতে রাজু ভাদুড়ী নিজেই তাঁর প্রেমে পড়েন।

দ্বিতীয় মত- যারা মনে করেন যে রাজু ভাদুড়ী প্রথম থেকেই কররানীর বাহিনী তে ছিলেন, তাঁদের মতে, কররানী রাজু ভাদুড়ী কে তাঁর কন্যার সাথে শর্ত দিয়ে বিবাহ করিয়ে নিজের রাজ্য রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
কররানীর সুন্দরি কন্যাকে বিয়ে ও গৌড়ের সেনাপতি পদের লোভনীয় প্রস্তাব রাজীব লোচনের সম্মুখে পেশ করেন। স্পষ্ট ভাষায় বলে দেন রাজীবকে তাঁর দরকার তবে শর্ত আছে ২টি-
১। তাকে গৃহত্যাগী হতে হবে,
২। তাকে ধর্মান্তরিত হতে হবে।
এ প্রস্তাব শুনে আপাতদৃষ্টিতে হতভম্ভ হয়ে যান রাজীব। একদিকে গৌড়ের সেনাপতি আর কররানীর সুন্দরী কন্যাকে পত্নী হিসেবে পাওয়ার দু-দুইটি লোভনীয় প্রস্তাব আর অন্যদিকে নিজের জাতপাত আর ধর্ম বিসর্জন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

অনেক জল্পনাকল্পনা শেষে রাজীব লোচন রায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে কররানীর কন্যাকে বিবাহ করে গৌড়ের সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
তবে কররানী কন্যা দুলারি বিবির সাথে যে রাজু ভাদুড়ীর বিবাহ হয়েছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই।
তবে, কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, রাজু ভাদুড়ী, শর্ত সাপেক্ষে ইসলাম ধর্ম অনুসারে সুলায়মানের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন এবং সুলায়মানের প্রধান সেনাপতির পদ অলংকৃত করেন, যদিও আপন ধর্ম পরিত্যাগ করেননি। কিন্তু মুসলমান কন্যা বিবাহের সুবাদে বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। আর সেই কারণে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ নাম ধারণ করেন এবং প্রবল হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। আর তখন থেকেই কালাপাহাড় নামে পরিচিত হন।
১৫৬৩ থেকে ১৫৭২ এ দশ বছর কররানীর পাশে ছায়ার মত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যান কালাপাহাড়।
এরপরে আবার ইতিহাসের মোড়!! আবার দ্বিমত!!

কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, প্রকৃতপক্ষে কালাপাহাড় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেই মনকষ্টে ভোগেন। তাঁর স্ত্রী সুলায়মান কন্যাও পিতার এহেন দুরভিসন্ধিমূলক কাজ পছন্দ করেননি। শেষপর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন শুদ্ধি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরে যাবেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে শুদ্ধি অভিযানে অংশ নিতে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে গেলেন এককালের ধর্মপ্রাণ হিন্দু রাজীব লোচন রায়, আশা ছিল তার পুরোহিতরা তাকে আপন করে নেবেন। কিন্তু বিধি বাম! পুরোহিতদের আজ্ঞা- কোন যবন জগন্নাথ মন্দিরের ছায়া মাড়াতে পারবে না। অতীতে যবন কর্তৃক অনেক মন্দির ধ্বংস হয়েছে। লুন্ঠিত হয়েছে সম্পদ। সুতরাং আর কোন সুযোগ দেয়া হবেনা এদের। কালাপাহাড়কে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করা হল, পাহাড়সম অপমানের বোঝা কাঁধে করে ফিরলেন নিজ গৃহে। সেনাপতির পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন হিন্দু অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে। এরপরের অংশ সকলেরই জানা।
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডাদের, তাঁর হিন্দু ধর্মে ফিরে আসা আটকাতেও ছিল কররানীর হাত। এরূপ সিদ্ধান্তের জন্য তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের যথেষ্ঠ উৎকোচ দিয়েছিলেন।
কিছু ঐতিহাসিকদের মতে, কালাপাহাড়ের হিন্দু ধর্মে ফিরে আসার মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তৎকালীন উৎকলের রাজা গজপতি মুকুন্দদেব। তিনিই পুরীর মন্দিরের পাণ্ডাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তবে রাজু ভাদুড়ীর যে আর হিন্দু ধর্মে ফেরা হয় নি, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। এই ঘটনার পরেই তাঁর যে হিন্দু দেবালয় ও উচ্চ বর্ণের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়, তা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই।
এরপরে, আসাম থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন সুলায়মান খান কররানী। গৌড় থেকে রাজধানী তাণ্ডায় স্থানান্তর করেন। আসাম থেকে উড়িষ্যার প্রতিটি রণাঙ্গনে রাজীব লোচন রায় বা ‘মহম্মদ ফর্ম্মুলি’ অসাধারণ সমরকুশীলতার পরিচয় দিয়ে পুরো বাংলায় পরাক্রমশালী সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
স্বজাতির কাছে ভীষণভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ফলে প্রতিশোধের লেলিহান শিখা জ্বলছিল কালাপাহাড়ের মনে। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এ প্রতিশোধ স্পৃহার বলি হয়েছে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব মন্দির, গুঁড়িয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে শিল্প, সংস্কৃতির যাগযজ্ঞ। আসাম থেকে উড়িষ্যার খুব কম মন্দিরই রক্ষা পেয়েছে কালাপাহাড়ের গোগ্রাস থেকে। যে মন্দির থেকে তিনি হতোদ্যম হয়ে লজ্জার গ্লানি নিয়ে ফিরে এসেছিলেন সেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তিনি এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটান। ১৫৬৮ সালে উড়িষ্যা বিজয়ে জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকে গরুর চামড়ার ঢোল ও ঘন্টা বাজিয়ে মন্দিরের ভেতরে এক ধরণের অণুরনন সৃষ্টি করেন। এতে উপস্থিত জনতা ভয় পেয়ে যায় এবং প্রতিমা উপড়ে ফেলে পায়ের তলায় পিষ্ট করে কালাপাহাড় তার অপমানের প্রতিশোধ নেন। এছাড়া এ মন্দির থেকে অনেক ধনদৌলত তাঁর হস্তগত হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি কোনাকের সূর্যমন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, ময়ূরভঞ্জের মন্দির ও মেদিনীপুর মন্দির। সুভদ্রা ও জগন্নাথ মন্দিরের কাঠের প্রতিমা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠে কালাপাহাড়ের উপর। প্রতিমা ধ্বংসের চেয়ে ধনসম্পদ লুটপাটেই তিনি আগ্রহী ছিলেন বেশি।
ইতিহাস থেকে কালাপাহাড়ের ভয়ানক তান্ডবের যে তথ্য আমরা পাই, তা নীচে বর্ণিত করলাম। তবে এর কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে মন্দিরগুলো যে তাঁর প্রতিশোধের আগুনে পুড়েছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনও দ্বিমত নেই। একমাত্র সম্বলপুরের মন্দিরের পুরোহিতরা তাঁকে বুদ্ধি দিয়ে আটকাতে সমর্থ হয়েছিলেন।

১৫৬৪-৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবর বাদশাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেব গৌড় আক্রমণ করে গঙ্গার তীরে অবস্থিত সপ্তগ্রাম বন্দর অধিকার করে নেন। পরে আকবর যখন মেবারের শিশোদীয় রাজাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন, সেই অবসরে সুলায়মান খান কররানী উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। মুকুন্দদেব কোটসামা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে সুলায়মান কালাপাহাড়ের অধীনে ময়ূরভঞ্জের অরণ্যসংকুল পথে উড়িষ্যা আক্রমণ করতে সৈন্য পাঠান। এইসময় মুকুন্দদেব তাঁরই এক বিদ্রোহী সামন্তের হাতে নিহত হন; এর ফলে ওই বিদ্রোহী সামন্ত এবং রঘুভঞ্জ ছোটরায় উড়িষ্যার সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উভয়েই কালাপাহাড় কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন।
কোচরাজ নরনারায়ণ, সুলায়মান খান কররানীর রাজত্বকালে গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু কালাপাহাড় একাধারে রাজা নরনারায়ণের ভাই এবং সেনাপতি শুক্লধ্বজকে পরাজিত করে আসামের তেজপুর পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন। এইসময়ে কামাখ্যা ও হাজোর প্রাচীন মন্দিরগুলিতে কালাপাহাড় নির্বিচারে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়েছিলেন। মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে কালাপাহাড় আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেন এবং অনুমান করা হয় তিনি এই যুদ্ধে নিহত হন (এপ্রিল ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দ)।
১৫৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দে মুকুন্দ দেবের বিরুদ্ধে সুলাইমান কররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যুদ্ধে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালাপাহাড় উড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলী নদীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।

কালাপাহাড় উড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ুরভঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। কালাপাহাড়ের মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘন্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমাদের হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। কালাপাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে কালাপাহাড় সম্বলপুরের মা সম্বলেশ্বরীর মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। সম্বলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের ছাউনিতে পাঠানো হয়। তিনি সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা, বিক্রি করেন। পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালাপাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান। মন্দির ধ্বংসের ঘটনা উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কররাণীদের কোচবিহার আক্রমণকালে কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড় কররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কররাণীর আমল পর্যন্ত কররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কররাণীদের পতনের পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন।
কথিত আছে যে, কালাপাহাড়, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বর্গভীমা মন্দিরেও এসেছিলেন আক্রমণ করতে। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে মন্দিরের ক্ষতি সাধন না করেই ফিরে যান। জনশ্রুতি আছে যে, তিনি নাকি মন্দিরের মাতৃ মূর্তির নীচে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

সুলায়মান খান কররানী তার জীবদ্দশায় উত্তর প্রদেশের শাসক মুনিম খানের মাধ্যমে মুঘলদের সাথে আতিথ্য বজায় রেখে চলতেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ পুত্র দাঊদ খান উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেন। তিনি নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করে প্রকাশ্যে মুঘলদের বিরোধিতা শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে সম্রাট আকবর মুনিম খানকে তাণ্ডা দখলের জন্য প্রেরণ করেন। মুনিম খান বীরত্বের সাথে তাণ্ডা দখল করে দাঊদ খানকে বিতাড়িত করেন। দাঊদ পালিয়ে যান উড়িষ্যায়। দাঊদের সাথে ছায়ার মত লেগে ছিলেন কালাপাহাড়। এদিকে তাণ্ডায় প্লেগের আক্রমণে স্বয়ং মুনিম খান সহ মুঘল অনেক সৈন্য মারা যায়। আর এ সুযোগে আবার তাণ্ডা দখল করে নেন দাঊদ খান। সাথে ছিলেন চেনামুখ, কালাপাহাড়। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই দাঊদ খানকে পরাজিত করতে দিল্লী থেকে এক বিশাল বাহিনী প্রেরিত হয় রাজা টোডরমল ও খানজাহান হোসেন কুলির নেতৃত্বে। বীরবিক্রমে লড়াই করে কামানের একটি গোলার আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন বীর কালাপাহাড়। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান ই আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন।
মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে কালাপাহাড়ের মৃত্যুর পর তাকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিং-এর গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি কালাপাহাড়ের সহযোদ্ধাদের; তাই একদল উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রোশে ২০০৬ সালে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

তথ্যসূত্র


  1. The Cult of Jagannatha By Kanhu Charan Mishra।
  2. Journal Of Asiatic Society Bengal, Old series, Vol. LXIX. 1900, pt. I. p. 189
  3. "Gloom and Bloom: The Case of Jagannatha Temples in Midnapore District", K.S. Behera।
  4. আমার নাম কালাপাহাড়। বিশ্বনাথ ঘোষ। সাহিত্যশ্রী

2 comments

আপনার মতামত জানান