আজকের এই মুঠোফোন সর্বস্ব সময়ে আমরা প্রায়শই ‘2G 3G 4G 5G’-এই শব্দগুলি শুনে থাকি। এই যেমন আমরা বলি যে 2G 3G এখন আর কাজের নয় ওদের চেয়ে 4G বেশি কাজের। পাশাপাশি এও শুনছি ইন্টারনেট স্পীডের ক্ষেত্রে 5G এগুলির থেকে অনেক অনেক বেশি ভাল। এখানে আমরা আলোচনা করব 2G 3G 4G 5G – প্রযুক্তিগুলি কাজ করে কীভাবে ও তাদের পার্থক্য কী। আর যাঁরা মোবাইলের মাধ্যমে আমরা বার্তা কীভাবে আদান প্রদান করি সে বিষয়ে জানতে চান তাঁরা এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
প্রথমেই জানা দরকার এখানে যে ‘G’ শব্দটি ব্যবহার করছি, সেই ‘G’ মানে কি? ‘G’ শব্দটির পুরো নাম হল ‘GENERATION’ অর্থাৎ ‘বংশপরম্পরা’। আচ্ছা, কিসের জেনারেশন বা বংশপরষ্পরা? এই জেনারেশন হল সেলুলার নেটওয়ার্ক বা মোবাইল নেটওয়ার্কের জেনারেশন। আমরা যখন ‘2G 3G 4G 5G’-এই কথাগুলি বলি তখন আমরা ভাবি যে প্রযুক্তিগত 2G -র থেকে 3G উন্নত, আবার 3G -র থেকে 4G উন্নত, আবার 4G -র থেকে 5G উন্নত। অর্থাৎ, যত সামনের জেনারেশনের দিকে যাওয়া হবে তত প্রযুক্তির দিক থেকে উন্নত হবে। আবার, ইন্টারনেটের স্পীড বা দ্রুতি হোম স্ক্রিনে অবস্থিত সিগন্যাল বারের ডানদিকে থাকা সিগন্যাল স্ট্রেংথ (signal strength) বা সংকেত শক্তি-র উপর নির্ভর করে। এই সংকেত শক্তি 2G, 3G, 4G, 5G ইত্যাদি হিসেবে দেখা যায়। প্রতিটা জেনারেশনের ক্ষেত্রে স্পিড এবং প্রযুক্তি বদলে যায়, দেখা যায় যে স্পিড বদলানোর সাথে সাথে প্রযুক্তিও বদলায়। যেমন, 1G দেয় 2.4 kbps, 2G দেয় 64 Kbps, 3G দেয় 144 kbps থেকে 2 mbps আবার 4G দেয় 100 Mbps – 1 Gbps। এখানে ‘Kbps’ হল ‘কিলোবিটস প্রতি সেকেন্ড’, ‘Mbps’ হল ‘মেগাবিটস প্রতি সেকেন্ড’ আর ‘Gbps’ হল ‘গিগাবিটস প্রতি সেকেন্ড’। এবারে দেখে নেওয়া যাক এই 2G 3G 4G 5G -এরা কীভাবে কাজ করে ও এদের পার্থক্য কী কী আছে।
এই ধরণের তথ্য লিখে আয় করতে চাইলে…
আপনার নিজের একটি তথ্যমূলক লেখা আপনার নাম ও যোগাযোগ নম্বরসহ আমাদের ইমেল করুন contact@sobbanglay.com এ
সেলফোনের ক্ষেত্রে প্রথম প্রযুক্তির যে উন্নত ধাপটি নেওয়া হয় তা হল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তিকে 1G থেকে 2G তে পরিণত করা। রেডিও সংকেতের ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসে এই 1G থেকে 2G পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। ১৯৭৯ সালের 1G নেটওয়ার্ক ব্যবহার করত অ্যানালগ সংকেত যার পরিবর্তে ১৯৯৩-এ আসা 2G নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত হয় এর চেয়ে আরও উন্নত ডিজিটাল সংকেত। এই 2G নেটওয়ার্ক 1G নেটওয়ার্কের চেয়ে আরও সুরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের চ্যানেল ব্যবহার করে থাকে। এই 2G নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি Code-division multiple access (CDMA) (কোড ডিভিশন মাল্টিপল অ্যাক্সেস (সিডিএমএ)) ব্যবহার করে থাকে যার ফলে এক তারবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থায় একই ফ্রিকোয়েন্সিতে অনেকে কথা বলতে পারে। আবার এখানে ব্যবহারকারী সকলের কথাগুলিকে সাংকেতিক ভাবে প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সিতে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, এই প্রযুক্তিতে অনেক ব্যবহারকারী একই চ্যানেল ব্যবহার করে কথা বলতে পারেন, এই ব্যাপারটিকে বলে মাল্টিপ্লেক্সিং (multiplexing)। এই প্রযুক্তি আরেক ডিজিটাল তারবিহীন সেলুলার বা মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে যার নাম Global System for Mobile Communications (GSM) (গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস (জিএসএম) । এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট রেডিও তরঙ্গে একই সাথে আটটি কল করা যায়। 1G-র ক্ষেত্রে কেবল ফোন করা যেত। 2G-র ক্ষেত্রে কিন্তু ফোনের পাশাপাশি এসএমএস (sms ) এবং এমএমএস (mms) ও পাঠানো যায়। এই প্রযুক্তিতে ইন্টারনেটও ব্যবহার করা যায়। তাহলে 1G-এর পরিবর্তে যে পরিষেবাগুলি আমরা 2G-তে পেয়ে থাকি সেগুলি হল- ফোন কল ছাড়াও আমরা এখানে কনফারেন্স কল করতে পারি, এখানে এসএমএস ও এমএমএস ইত্যাদি পাঠাতে পারি, এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারি, আন্তর্জাতিক কলও করতে পারি। এর ডেটা স্পিড (data speed) হল 64 kbps। 2G পরিষেবা 30 থেকে 200 KHz (কিলোহার্জ) ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডউইডথ (bandwidth) এর মধ্যে কাজ করে।
এবার জেনে নেওয়া যাকে ২০০১ সালে আসা 3G নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির বিষয়ে। এই 3G নেটওয়ার্ক তারবিহীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা ওয়েব ব্রাউজিং, ইমেল, ভিডিও ডাউনলোড করা, পিকচার শেয়ার করা এবং অন্যান্য স্মার্টফোনে আজকাল আমরা যা যা ব্যবহার করে থাকি তার সবই আছে এই 3G নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে। স্বল্প খরচে সুন্দর ভয়েস শোনার পাশাপাশি আরও বেশি ডেটা ধারণ করার ক্ষমতা ও আদান-প্রদানের জন্য এবং আরও নানান কাজকর্মের জন্য এই প্রযুক্তিকে আনা হয়। জিএসএমকে ভিত্তি করে আরও উন্নত Universal Mobile Telecommunications System (UMTS) (ইউনিভার্সাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম (ইউএসটিএম) ) এর কোর বা মুখ্য নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আর এই সিস্টেমের ফলে 2G-র অন্যান্য সুবিধাগুলির পাশাপাশিও এটি আরও দ্রুত হারে ডেটা আদান প্রদান করতে পারে। এই 3G প্রযুক্তি ডেটা ট্রান্সফার স্পিড দিতে পারে 2 Mbps। এর ক্ষেত্রে ব্যান্ডউইথ এবং ডেটা আদান-প্রদানের হার 2G-র থেকে অনেক বেশি। এর ব্যান্ডউইথ হল 15-20 MHz (মেগাহার্জ)। এর ডাটা ক্যাপাসিটি বা ডাটা ধারণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং এর ব্রডব্যান্ডও অনেক বেশি। এই 3G নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন-এর দ্বারা উল্লেখিত ‘ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশনস – ২০০০ (International Mobile Telecommunications – 2000) বা IMT-2000 মেনে কাজ করে। এর একটা শর্তই হলো যে ডেটা স্পিড 200 Kbps-এর উপর হতে হবে।
এরপর এলো আরও উন্নত 4G নেটওয়ার্ক। এর আগমন কাল হল ২০০৯ সাল। 3G-র থেকে আরও বেশি দ্রুত, আরও সুন্দর কোয়ালিটি এবং আরও ক্যাপাসিটি নিয়ে এই নতুন প্রযুক্তির আগমন। ডেটা আদান-প্রদানের হার প্রযুক্তির দিক দিয়ে 3G ও 4G নেটওয়ার্কের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যে দুই প্রযুক্তির উপর 4G নেটওয়ার্ক দাঁড়িয়ে আছে সেগুলি হল মাল্টিপল ইনপুট মাল্টিপল আউটপুট (Multiple Input Multiple Output) বা সংক্ষেপে MIMO এবং অর্থগণাল ফ্রিকোয়েন্সি ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং (Orthogonal Frequency Division Multiplexing) বা সংক্ষেপে OFDM। MIMO-র ক্ষেত্রে প্রেরক এবং গ্রাহক দুজনেই একাধিক অ্যান্টেনা ব্যবহার করে তাদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে। আর OFDM-এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংকেত পাঠানো যেতে পারে একই মাধ্যমে এবং একই সময়ে।উচ্চ গতিতে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য এই নেটওয়ার্ক লং-টার্ম ইভলিউশন (Long-Term Evolution) বা LTE স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করে থাকে। তারবিহীন ক্ষেত্রে তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম স্ট্যান্ডার্ড ওয়াইম্যাক্স (WiMAX )-ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যদিও 4G সর্বত্রই পাওয়া যায় তবুও অনেক নেটওয়ার্ক 4G স্পিডের কাছাকাছি যেতে পারে না, সেই কারণে নিরাপদ ইন্টারনেট সংযোগের জন্য 4GLTE ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর ক্ষেত্রে সুন্দরভাবে মাল্টিমিডিয়া, ভয়েস এবং ভিডিও সমস্ত কিছুই পাওয়া যায়। খুব দ্রুত হারে, খুব বেশি ক্যাপাসিটিযুক্ত এবং খুব স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট আমরা পেতে পারি আর এই ইন্টারনেটের স্পিড হল 20 Mbps বা তার বেশি।আজ সারা বিশ্বে প্রায় সর্বত্র এই নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
একেবারে সদ্য অর্থাৎ ২০১৮ সালে আসা 5G নিয়ে কাজ এখনও হচ্ছে। খুব দ্রুত হারে ডাটা আদান-প্রদান করা, উচ্চমানের কানেক্টিভিটি, নেটওয়ার্কের বিলম্ব বা ল্যাটেন্সি কম হওয়া এবং আরো অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত 5G নেটওয়ার্ক এর পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার কাজ এখনও চলছে। বিভিন্ন ডিভাইসের সাথে কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ স্থাপন করা, ব্যাটারির ক্ষয় কম করা, এবং তারবিহীন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে এই নেটওয়ার্ক এর উপর প্রযুক্তিবিদেরা কাজ করে চলেছেন। এই নেটওয়ার্কে সর্বোচ্চ স্পিড হচ্ছে 35.46 Gbps যা কিনা 4G-র থেকে ৩৫ গুণ বেশি। বৃহদায়তন মাইমো (Massive MIMO), মিলিমিটার তরঙ্গে মোবাইলের যোগাযোগ ঘটানো (Millimeter Wave Mobile Communications), ক্ষুদ্র সেল, ওয়াই-ফাইয়ের মতো লাই-ফাই (Li-Fi) ইত্যাদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে। এই নেটওয়ার্কের সাহায্যে আমরা ইন্টারনেট স্পিড প্রতি সেকেন্ডে 10 জিবি পেতে পারি। আর এই নেটওয়ার্কের সাহায্যে আমরা কম করে দশ হাজার কোটি মানুষকে যুক্ত করতে পারব। তাই, পরবর্তী দশকটি 5G-রই হতে চলেছে।
এখানে এক নজরে 2G 3G 4G 5G প্রযুক্তিগুলির পার্থক্য দেখে নেব। বলাবাহুল্য, নতুন প্রযুক্তিতে পুরানো সবরকম ব্যবহার আরও সহজে সম্ভব আর তার সঙ্গে নতুন ফিচার তো যোগ হয়েছেই।
- | 2G | 3G | 4G | 5G |
---|---|---|---|---|
সূচনাকাল | ১৯৯৩ | ২০০১ | ২০০৯ | ২০১৮ |
প্রযুক্তি | GSM | WCDMA | LTE, WIMAX | MIMO, OFDM |
ইন্টারনেট পরিষেবা | ন্যারোব্যান্ড | ব্রডব্যান্ড | আল্ট্রা ব্রডব্যান্ড | তারবিহীন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব |
ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডউইড্থ | 25 MHz | 25 MHz | 100 MHz | 30-300 GHz |
বিশেষ সুবিধা | মাল্টিমিডিয়া (এসএমএস, এমএমএস), ইন্টারনেট এক্সেস এবং SIM এর সূচনা | উচ্চ পর্যায়ের সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক রোমিং কল | আরো দ্রুত গতি, গ্লোবাল মোবিলিটি | অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা, উচ্চ গতি, কম লেটেন্সি |
প্রায়োগিক দিক | কল করা, মেসেজ করা | ভিডিও কনফারেন্স, মোবাইল টিভি, জিপিএস | দ্রুতগতির এপ্লিকেশন ব্যবহার | হাই রেজুলিউশন ভিডিও স্ট্রিমিং, যানবাহন, রোবোট ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা, এমনকি চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। |
তথ্যসূত্র
- https://rantcell.com/
- http://net-informations.com
- https://searchmobilecomputing.techtarget.com/
- https://www.cloudflare.com/
- https://lifi.co/
