এক্স-রে ইমেজিং

এক্স রে ইমেজিং ।। X-Ray Imaging

বর্তমান পৃথিবীতে হাত-পা কিংবা শরীরের কোথাও চোট পেলে, হাড় ভেঙে গেলে সবার আগে চিকিৎসকেরা সকলেই এক্স-রে করানোর পরামর্শ দেন। সেই এক্স-রে প্লেটেই ধরা পড়ে ভিতরে হাড় ভেঙে গেছে কিনা। আবার ক্যান্সারের চিকিৎসাতেও এক্স-রশ্মি প্রয়োগ করে ক্যান্সার-কোষ ধ্বংস করা হয়। কালো এক্স-রে প্লেট আলোয় ধরে আমরা অনেকেই দেখেছি, কিন্তু ঠিক কীভাবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই এক্স-রশ্মি ব্যবহৃত হয়ে থাকে জানি কী? চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে বলা হয় এক্স-রে ইমেজিং (X-Ray Imaging)। তাহলে চলুন এই বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদে জেনে নেওয়া যাক।

এক্স রশ্মি একপ্রকারের তড়িৎ-চৌম্বকীয় বিকিরণ। এটি একপ্রকার উচ্চ-ভেদনক্ষমতাযুক্ত অদৃশ্য রশ্মি। দ্রুতগতি সম্পন্ন কোনও ইলেকট্রন কোনও ধাতুকে আঘাত করলে তা থেকে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উচ্চ ভেদনক্ষমতা সম্পন্ন যে অদৃশ্য রশ্মি নির্গত হয় তাকেই এক্স রশ্মি বলা হয়। ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিদ উইলহেল্ম রন্টজেন এক্স রশ্মি আবিষ্কার করেন। নিম্নচাপে তড়িৎমোক্ষণ নলে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় রন্টজেন লক্ষ্য করেন যে মোক্ষণ নলের পাশে রাখা বেরিয়াম প্ল্যাটিনোসায়ানাইড পাতের উপর ক্যাথোড রশ্মি পড়ে একপ্রকার প্রতিপ্রভা তৈরি হয়েছে। পাত ও মোক্ষণ নলের মধ্যে পুরু ধাতব পাত রেখেও একই ফল পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী রন্টজেন। এরপর তিনি মোক্ষণ নল ও পিছনে রাখা পর্দার মাঝে হাত রেখে দেখেন যে পর্দার উপর হাতের হাড়ের স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে। এই ঘটনা থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে এই অদৃশ্য রশ্মি কখনই ক্যাথোড রশ্মি নয়। কারণ ক্যাথোড রশ্মি মোক্ষণ নলে আঘাত করার পরেই নল থেকে এক প্রকার অজ্ঞাত রশ্মির উৎপত্তি হয় এবং প্রতিপ্রভা দেখা যায়। এই অদৃশ্য রশ্মি সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না বিজ্ঞানী রন্টজেনের। তাই একে তিনি এক্স রশ্মি নামে চিহ্নিত করেন। গণিতে ও পদার্থবিদ্যায় অজানা কোনও কিছুকে ‘এক্স’ (X) নামে চিহ্নিত করা হয় বলে একেও একইভাবে নামকরণ করা হয়। এক্স রশ্মি আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন উইলহেল্ম রন্টজেন। সাধারণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে এক্স রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম হওয়ায় এটি যে কোনও পদার্থকে ভেদ করে চলে যেতে পারে। এক্স রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য হল ১০-৮ মিটার থেকে ১০-১৩ মিটার। আর এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে এক্স রশ্মিকে দুভাগে ভাগ করা হয় –

ক) কঠিন এক্স রশ্মি (Hard X-Ray) : এই ধরনের এক্স রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনেক কম হয়। উচ্চ ভেদনক্ষমতা সম্পন্ন এই ধরনের রশ্মি মোক্ষণ নলে উচ্চ বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করে পাওয়া যায়।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

খ) কোমল এক্স রশ্মি (Soft X-Ray) : মোক্ষণ নলে নিম্ন বিভব পার্থক্যে নিম্ন ভেদনক্ষমতা সম্পন্ন তুলনামূলক বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য সম্পন্ন এই এক্স রশ্মিকে বলা হয় কোমল এক্স রশ্মি।

বিভিন্ন ধাতুর প্রতি এক্স রশ্মির ভেদনক্ষমতার কারণে যে কোনও গাঁথুনিতে ফাটল, অসামঞ্জস্যতার নির্ণয়ে এক্স রশ্মির ইমেজিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া যাত্রাপথের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিমানবন্দরে বা রেল স্টেশনে এক্স রে ইমেজিং পদ্ধতির মাধ্যমে লাগেজ বা যাত্রীর শরীরে লুকোনো অবৈধ দ্রব্য খুঁজে বের করা যায়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক্স রশ্মির ব্যবহার বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরের বিভিন্ন কলার মাঝখান থেকে হাড়ের কিংবা অভ্যন্তরীণ গঠনের ইমেজিং-এর মাধ্যমে এক্স রশ্মির ব্যবহারের সাহায্যে চিকিৎসকেরা রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে বিশেষ শাখায় রোগ নির্ণয়ে এই এক্স রশ্মির ব্যবহার সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হয় তাকে ‘রেডিওলজি’ (Radiology) বলা হয়। আর অন্যদিকে যে শাখায় চিকিৎসা প্রদানে এক্স রশ্মির ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে ‘রেডিওথেরাপি’ (Radiotherapy) বলা হয়। রন্টজেন এই রশ্মি আবিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যেই প্রথম চিকিৎসা ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়েছিল। এক্স রশ্মি খুব সহজেই মানব শরীরের নরম কলা ভেদ করতে পারে, কিন্তু ক্যালশিয়াম ও ফসফেট দ্বারা গঠিত হাড় ভেদ করতে পারে না। ফলে এই নীতিকে কাজে লাগিয়ে ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর আমাদের শরীরের নির্দিষ্ট অংশ রেখে এক্স রশ্মি প্রযুক্ত করা হলে প্লেটের উপর শরীরের ঐ অংশের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এক্স রশ্মির ব্যবহার করা হয় তা হল –

১) সরে যাওয়া হাড়, হাড়ের ফাটল, ভেঙে যাওয়া হাড় ইত্যাদির শনাক্তকরণ

২) দাঁতের গোড়ায় ঘা ও ক্ষয় নির্ণয়

৩) অন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা নির্ণয়ের জন্য পেটের মধ্য দিয়ে এক্স রশ্মি পাঠানো

৪) পিত্তথলি ও কিডনির পাথর শনাক্তকরণ

৫) ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি শনাক্তকরণ

৬) রেডিওথেরাপির দ্বারা ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ক্যান্সারের চিকিৎসা

শরীরের ভিতরে কোনও নরম কলার প্রতিচ্ছবি তোলার জন্য শরীরের ভিতরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রেডিওপেক বস্তু বা কন্ট্রাস্ট মিডিয়া (Contrast Media) প্রবেশ করিয়ে রেডিওগ্রাফ নিতে হয়। অন্যদিকে স্তনের প্রতিচ্ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় কোমল এক্স রশ্মি উৎপাদনকারী মেমোগ্রাফ যন্ত্র (Memograph Machine)। তাছাড়া রোগ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে কম্পিউটেড রেডিওগ্রাফি (Computed Radiography), ডিজিটাল রেডিওগ্রাফি (Digital Radiograophy), কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (Computed Tomography) ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ২০১০ সাল পর্যন্ত সমস্ত বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৫০ কোটি এক্স-রে ইমেজিং করা হয়েছে নানাবিধ চিকিৎসার জন্য।

উপরের তালিকায় উল্লিখিত পদ্ধতিগুলিকে একত্রে ‘প্রোজেকশনাল রেডিওগ্রাফি’ (Projectional Radiography) বলা হয়। তবে এই ধরনের এক্স-রে ইমেজিং (X-Ray Imaging) মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ প্রতিচ্ছবি তুলতে সহায়ক নয়। ডেন্টাল রেডিওগ্রাফির (Dental Radiography) সাহায্যে দাঁতের গহ্বর শনাক্ত করা যায়। এই পদ্ধতির আরেকটি প্রকারভেদ হল এঞ্জিওগ্রাফি (Engiography) যেখানে ধমনী ও শিরা সহ রক্ত সংবহনতন্ত্রের সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে রক্তনালীতে একটি আয়োডিনযুক্ত কন্ট্রাস্ট এজেন্ট (Contrast Agent) ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় যাতে রক্তবাহের মধ্যে কোনও ক্ষতি হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে কম্পিউটেড টোমোগ্রাফিকে সংক্ষেপে সিটি স্ক্যান (CT Scan) বলা হয়। এক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন দিক থেকে দ্বিমাত্রিক এক্স-রে ইমেজিং-এর সাহায্যে প্রতিচ্ছবি সংগ্রহ করা হয়। এর ফলে লম্বচ্ছেদ জাতীয় দ্বিমাত্রিক ছবিগুলি একত্রে একটি ত্রিমাত্রিক সামগ্রিক রূপরেখা তৈরি করে। আরেকটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল ফ্লুরোস্কোপি (Fluroscopy)। এক্ষেত্রে ফ্লুরোস্কোপের মধ্যে থাকা এক্স রশ্মির উৎসকে কাজে লাগিয়ে রোগীর শরীরে আবারও একটি কন্ট্রাস্ট এজেন্ট প্রবেশ করিয়ে উপস্থিত সময়ের অভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন হৃদপিণ্ডের ধমনীতে প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা দেখার জন্য হৃদপিণ্ডে ক্যাথিটার প্রবেশ করানো হয়। আবার খাদ্যনালীর কোনও সমস্যা শনাক্তকরণের জন্য বেরিয়াম আইসোটোপ খাদ্যনালীর ভিতরে প্রবেশ করানো হয়। সবশেষে উল্লেখ করতে হয় রেডিওথেরাপির কথা। এই বিশেষ পদ্ধতিতে অধিকাংশ সময় ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। এক্স-রে ইমেজিং করার সময় যে পরিমাণ রেডিয়েশন প্রয়োগ করা হয়, তার থেকে অনেক বেশি মাত্রায় রেডিয়েশন দেওয়া হয় এই চিকিৎসায়। কম শক্তিসম্পন্ন এক্স রশ্মি ব্যবহৃত হয় ত্বকের ক্যান্সারের চিকিৎসায় আর অন্যদিকে বেশি শক্তিসম্পন্ন এক্স রশ্মি ব্যবহৃত হয় মস্তিষ্ক, ফুসফুস, প্রস্টেট, স্তনের ক্যান্সারের চিকিৎসায়।

তবে এই এক্স-রে ইমেজিং পদ্ধতি চিকিৎসাক্ষেত্রে বর্তমানে বহুলভাবে ব্যবহৃত হলেও এক্স রশ্মির অনিয়ন্ত্রিত ও প্রয়োজনীয় প্রয়োগের কারণে জীবন্ত কোষও বিনষ্ট হতে পারে এবং মানবদেহে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ফলে চিকিৎসাক্ষেত্রে একারণে দক্ষ রেডিওলজিস্টের সহায়তা নেওয়া হয় এই ধরনের এক্স-রে ইমেজিং করার সময়।    

2 comments

আপনার মতামত জানান