রেডিওলজি (radiology) হল আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার এমন একটি অত্যাধুনিক মেডিকেল প্রযুক্তি যার সাহায্যে শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গের হাই রেজল্যুশন ছবি তোলা হয়। মূলত চৌম্বক ক্ষেত্র এবং বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে কম্পিউটারের সাহায্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত অনুসন্ধানের জন্য কোন অস্ত্রোপচার ছাড়াই সম্পূর্ণ বেদনাহীন এই প্রক্রিয়ায় শরীরের অভ্যন্তরের হাই রেজল্যুশন ছবি তোলা হয়ে থাকে। এই বিষয়ে যাঁরা পারদর্শী হন তাঁদের রেডিওলজিস্ট বলা হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই রেডিওলজিস্টদের দক্ষতা ও পারদর্শিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
সময় যত এগিয়েছে রেডিওলজির ক্ষেত্রটি ততই উন্নত হয়েছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং কৌশল যুক্ত হয়েছে। রেডিওলজির অন্তর্গত সর্বাধিক ব্যবহৃত ইমেজিং পদ্ধতিগুলি হল – এক্স-রে, সি টি স্ক্যান, এমআরআই, আল্ট্রাসোনোগ্রাফি এবং নিউক্লিয়ার মেডিসিন ইমেজিং।
এক্স -রে: উনিশ শতকের শেষে ১৮৯৫ সালে ভিলহেল্ম কনরাড রন্টজেনের এক্স -রে আবিষ্কারের হাত ধরে প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানে রেডিওলজি শাখার আগমন। ক্যাথোড রে টিউব নিয়ে গবেষণাগারে পরীক্ষা করার সময় ঘটনাচক্রে তিনি এক্স-রে আবিষ্কার করেন এবং দ্রুত বুঝতে পারেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর গুরুত্ব কতখানি। ‘অন আ নিউ কাইন্ড অব রে’জ‘ নামক একটি গবেষণাপত্রে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত এক্স-রে সম্পর্কে বিশদে বর্ণনা করেন যেটি প্রকাশ হওয়া মাত্র বিজ্ঞানী মহলে সাড়া পড়ে যায়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক্স-রের আবিষ্কার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে দেখা দেয়। কোন অস্ত্রোপচার ও রক্তপাত ছাড়াই এই প্রথমবার চিকিৎসকরা দেহের বাইরে থেকেই দেহের অভ্যন্তরস্থ অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে দেখতে পেলেন। দ্রুতই চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল এক্স-রে। এই আবিষ্কারের কারণে ১৯০১ সালে রন্টজেন নোবেল পুরস্কার পান।
সমগ্র বিংশ শতাব্দীজুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র জুড়ে এক্স- রের ব্যবহার তো বৃদ্ধি পেলই সেই সাথে ক্রমাগত আরও উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠলো এই প্রক্রিয়া। ১৯২০ সালে ফ্লুরোস্কোপ আবিষ্কারের সাথে সাথে সেই প্রথমবার চিকিৎসকরা সরাসরি দেহের অভ্যন্তরের এক্স-রে ছবি দেখতে পেলেন। ১৯৩০ সালে সি টি স্ক্যানারের আবিষ্কারের সাথে দেহের অভ্যন্তরের অঙ্গগুলির আরও বিশদ এবং উচ্চমানের ছবি তোলা সম্ভব হল।
সি টি স্ক্যান: এক্স -রের সাহায্যে এই সি টি স্ক্যান করা হলেও, এক্ষেত্রে শরীরের নির্দিষ্ট অংশের দ্বিমাত্রিক লম্বচ্ছেদের অনেকগুলি প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয় এবং তা আবার বিভিন্ন দিক থেকে। সবকটি প্রতিচ্ছবি মিলিয়ে একটি ত্রিমাত্রিক রূপ হিসেবে ফটোগ্রাফিক প্লেট থেকে শরীরের ঐ অংশের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়।
শরীরের অভ্যন্তরীণ টিউমার নির্ণয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে কিনা ও হৃদযন্ত্রের রোগ নির্ণয়ে অথবা হৃদপিণ্ডের রক্তবাহে কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা জানার জন্য সি টি স্ক্যান ব্যবহার করা হয়।
এমআরআই: রেডিওলজির এই ক্ষেত্রটি ক্রমাগত উন্নত হয়েই চললো বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে। এবার আগমন হল ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং ও আল্ট্রাসাউন্ডের। সিটি স্ক্যানের থেকেও আরও বিশদে চিকিৎসকরা এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে দেহের ভেতরের অঙ্গগুলির ছবি তুলতে সক্ষম হলেন যা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে এক লাফে অনেকটা এগিয়ে দিল।
এই এমআরআই প্রযুক্তির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয় ১৯৪৬ সালে যখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পদার্থবিদ ফেলিক্স ব্লচ এবং এডওয়ার্ড মিলস পুরসেল চৌম্বকীয় অনুরণন প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেন। আশির দশকে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক, স্টনি ব্রুক-এর গবেষকরা প্রথম ক্লিনিক্যাল এমআরআই স্ক্যানার তৈরি করেছিলেন, যা শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র এবং রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে মানবদেহের ছবি তৈরি তুলতে সক্ষম হয়েছিল। মানবদেহের প্রথম এমআরআই ছবি ১৯৭৭ সালে তৈরি হয় এবং ১৯৮০ সালে প্রথমবার পূর্ণাঙ্গ মানব শরীরের জন্য এমআরআই স্ক্যানার তৈরি হয়।
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় শরীরের অভ্যন্তরীণ কোন অঙ্গের সমস্যা নির্ধারণে এমআরআই অত্যন্ত কার্যকরী একটি চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে দেখা দিয়েছে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ছবি, হৃদপিন্ডে কোন সমস্যা কিংবা হৃদপেশীর ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে এই প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি : আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বা ইউএসজি একটি মেডিক্যাল ইমেজিং পদ্ধতি যেখানে অত্যন্ত উচ্চ কম্পাঙ্কবিশিষ্ট শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে থাকা বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও টিস্যুর হাই রেজল্যুশন ছবি তোলা হয়।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ব্যবহারের অন্যতম সুবিধা হল শরীর মধ্যস্থ অঙ্গগুলির বিশদ ছবি তুলতে এটিতে এক্স -রে ও সিটি স্ক্যানের মত আয়নিত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করা হয় না। পরিবর্তে শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে এখানে ছবি তোলা হয়ে থাকে। ফলত রোগীদের বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং শিশুদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং সুরক্ষিত মাধ্যম।
পঞ্চাশের দশক থেকে গবেষকরা মেডিকেল ইমেজিংয়ে আল্ট্রাসনিক তরঙ্গের ব্যবহার সম্ভব কিনা সে বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৪২ সালে অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট কার্ল দুসিক মস্তিষ্কের টিউমার চিহ্নিতকরণের জন্য আল্ট্রাসনিক তরঙ্গ ব্যবহারের উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার ইয়ান ডোনাল্ড ও তাঁর সহকর্মীরা গর্ভাবস্থা নির্ণয়ের জন্য শব্দ তরঙ্গ ব্যবহারের একটি পন্থা আবিষ্কার করেন। তাঁরা এই প্রক্রিয়াটির নাম দেন ‘আল্ট্রাসনিক ফীটাল সেফালোমেট্রি’ (ultrasonic fetal cephalometry)। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা গর্ভস্থ ভ্রূণের মাথার আকার পরিমাপ করতে সক্ষম হন।
রেডিওলজির অনেক ধরণের ব্যবহারের মধ্যে অন্যতম একটি ব্যবহার হল রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হাড় ভেঙেছে কিনা তা চিহ্নিত করতে এক্স-রে ব্যবহৃত হয়। আবার সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই ব্যবহার হয় শরীর মধ্যস্থ টিউমার, সংক্রমণ এবং অন্যান্য অবস্থা শনাক্ত করতে। এছাড়া কেমোথেরাপির মত চিকিৎসা পদ্ধতিতেও রেডিওলজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
রেডিওলজির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ন্যূনতম অস্ত্রোপচার করে কেবল ছবির সাহায্যে দেহ মধ্যস্থ অঙ্গগুলির চিকিৎসা করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বায়োপ্সি পদ্ধতি যেখানে শরীরের মধ্যে থেকে অতি সামান্য পরিমাণে টিস্যু সংগ্রহ করা হয় পরীক্ষার জন্য। আবার শরীরে ক্যাথিটার প্রবেশ করিয়ে দেহ মধ্যস্থ সমস্যার প্রকৃত অবস্থা নির্ণয় করতেও রেডিওলজি ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত অস্ত্রোপচার পদ্ধতির তুলনায় অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা যায় এই পদ্ধতিতে। ফলত দিন দিন এই পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা করার প্রবণতা বাড়ছে।
রেডিয়েশন বা বিকিরণ পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এই রেডিওলজি । এই প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত উচ্চ শক্তি সম্পন্ন বিকিরণের মাধ্যমে ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলিকে নির্মূল করা হয়ে থাকে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি এখন অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে।
সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে রেডিওলজি পদ্ধতির আগমন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব এনে দিয়েছে। এক কথায় বলা যায় চিকিৎসাপদ্ধতির প্রচলিত ধারাটিকে আমূল বদলে দিয়েছে এই রেডিওলজি। চিকিৎসকদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন বর্তমানে রেডিওলজিস্টরা যাঁদের সঠিক রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসকরা বর্তমানে চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করেন। আগামী দিনে রেডিওলজি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই আশা করাই যায়।