আব্রাহাম মাসলো

আব্রাহাম মাসলো

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ছিলেন আব্রাহাম মাসলো (Abraham Maslow)। তাঁর প্রবর্তিত ‘চাহিদা সোপান তত্ত্ব’-এর (Hierarchy of Needs) জন্যেই তিনি সুপরিচিত। মানসিক স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার তত্ত্ব বিষয়ে তাঁর এই মতবাদ বিংশ শতাব্দীর বোদ্ধামহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলির বিষয়ে ব্রান্ডিস বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রুকলিন কলেজ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিউ স্কুল ফর সোশ্যাল রিসার্চ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন আব্রাহাম মাসলো। মানুষের সমস্ত ইতিবাচক গুণাবলীর উপর জোর দেওয়ার কথাই তিনি বারবার বলেছেন। ২০০২ সালে প্রকাশিত সাধারণ মনোবিজ্ঞানের একটি সমীক্ষায় বিংশ শতাব্দীর সবথেকে বেশি উল্লিখিত মনোবিজ্ঞানীদের তালিকায় দশম স্থান অর্জন করেন আব্রাহাম মাসলো।

১৯০৮ সালের ১ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে আব্রাহাম মাসলোর জন্ম হয়। তাঁর বাবা-মা কিয়েভ থেকে পলাতক প্রথম প্রজন্মের ইহুদি অভিবাসী ছিলেন। তাঁদের সাত সন্তানের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আব্রাহাম মাসলো। বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার জার শাসনের থেকে বাঁচতে নিউ ইয়র্কে পালিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। মাসলোর শৈশব খুব একটা সুখকর ছিল না, বেশিরভাগ সময়েই একাকীত্বের মধ্যে তাঁর শৈশব কেটেছে। গ্রন্থাগারেই বই পড়ে বেশিরভাগ সময় কাটাতেন তিনি।

নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন মাসলো। পরে মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহের বশে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি, মনোবিদ হ্যারি হার্লোকে সেখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। এই মানুষটিই মাসলোর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আব্রাহাম মাসলো মনোবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৩৭ সাল থেকে ব্রুকলিন কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেন আব্রাহাম মাসলো। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি কলেজের বোর্ড সদস্যও ছিলেন। এই সময়পর্বে গেস্টাল্ট মনোবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়ারথেইমার এবং নৃতত্ত্ববিদ রুথ বেনেডিক্টের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন মাসলো। মাসলো বিশ্বাস করতেন এই দুই ব্যক্তি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী আর তাই মাসলো তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার সম্পর্কে নোটস নিতে শুরু করেন। এই কাজটি তাঁর গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। মূলত আচরণবাদের প্রতিই আকৃষ্ট ছিলেন আব্রাহাম মাসলো। এই মতবাদের দ্বারা শর্তসাপেক্ষে মানুষের ব্যবহার যে বদলাতে পারে, সেই তথ্যকেই তুলে ধরে। ব্যবহারিক যৌক্তিকতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে কুকুর এবং বাঁদরদের নিয়েও এই আচরণবাদের পরীক্ষা করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম দিকের বেশ কিছু কাজ মূলত কুকুরের রাগ ও বিরক্তি প্রকাশের ধরন বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল। এছাড়া ইতিবাচকতা (Positivism) তত্ত্বের দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হন মাসলো।

১৯৫০ সাল নাগাদ মানবতাবাদী মনোবিজ্ঞান (Humanistic Psychology) তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে ওঠেন মাসলো। তাঁর চাহিদা সোপান তত্ত্ব, আত্মপ্রতিষ্ঠার তত্ত্ব (Self Actualization), শিখর অভিজ্ঞতা (Peak Experience) ইত্যাদি এই মানবতাবাদী মনোবিজ্ঞান তত্ত্বেরই অন্তর্ভুক্ত বিষয়। মাসলো বুঝতে পেরেছিলেন যে ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব এবং স্কিনারের আচরণগত তত্ত্ব মানুষের জীবনের নেতিবাচক দিকগুলির উপরেই নিবদ্ধ রয়েছে। তিনি আরও অনুভব করেছিলেন যে এই তত্ত্বগুলি মানুষের সমস্ত সম্ভাবনা এবং সৃজনশীলতাকে উপেক্ষা করে। এর বিপরীতে মাসলোর তত্ত্বগুলি মানুষের সর্বজনীন মঙ্গল এবং নিজের পূর্ণ সম্ভাবনার দিকটিকে আলোকিত করে। ১৯৬১ সালে আব্রাহাম মাসলো যৌথভাবে ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্টিক সাইকোলজি’ প্রকাশ করা শুরু করেন এবং ১৯৬৯ সালে প্রকাশ করেন ‘জার্নাল অফ ট্রান্সপার্সোনাল সাইকোলজি’। মনোবিজ্ঞানের জগতে মাসলোর বিশেষ অবদানের কথা আজও স্মরণ করায় এই দুটি জার্নাল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাসলোর বৌদ্ধিক চিন্তা-চেতনার দিশা বদলাতে থাকে। এই সময়েই দর্শনশাস্ত্রের বদলে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে গভীর গবেষণা শুরু করেন তিনি। মাসলোর বয়স তখন ৩৩ বছর এবং তিনি দুই সন্তানের বাবা তখন। এই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই আব্রাহাম মাসলো তাঁর গবেষণাকর্মটি এগিয়ে নিয়ে যান এবং ক্রমে আত্মপ্রতিষ্ঠার তত্ত্বটি (Self Actualization) প্রণয়ন করেন। ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাসলো তাঁর বিখ্যাত চাহিদা সোপান তত্ত্বটির অবতারণা করেন। মাসলো তাঁর ‘মানব প্রেষণা তত্ত্ব’ (Human Motivation Theory) সাইকোলজিক্যাল রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশ করেন ১৯৪৩ সালে। এই গবেষণাপত্রে তিনি বলেন যে, পাখিরা বাসা বাঁধার জন্য, মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জন্য, সন্তান প্রতিপালনের জন্য কিংবা ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। এইসব কাজের জন্য তাঁরা নিজেদের অন্তর থেকেই একপ্রকার তাগিদ অনুভব করে। কখনও তা ক্ষুধা-তৃষ্ণা-যৌনতার মত শারীরিক তাগিদ, আবার কখনও তা আত্মরক্ষার তাগিদ, সামাজিক স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার তাগিদ ইত্যাদি। একেই মাসলো প্রেষণা (Motivation) বলছেন। এই প্রেষণার ভিত্তি স্বরূপ চাহিদা পূরণের নানাবিধ ক্রমপর্যায়কে মাথায় রেখেই মাসলো তাঁর ‘চাহিদা সোপান তত্ত্ব’ প্রণয়ন করেন। আব্রাহাম মাসলো মনে করেন জীবজগতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের আবশ্যিক কিছু চাহিদা পূরণ হওয়া দরকার। মাসলো এইরকম পাঁচটি চাহিদার কথা বলেছেন তাঁর তত্ত্বে –

১) দৈহিক চাহিদা (Physiological Needs)

২) নিরাপত্তার চাহিদা (Safety Needs)

৩) ভালবাসা ও একাত্মতার চাহিদা (Need for Love and Belongingness)

৪) আত্মমর্যাদার চাহিদা (Esteem Needs)

৫) আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা (Need for Self-Actualization) 

একটি পিরামিডের আকারে চাহিদাগুলিকে সাজিয়েছেন মাসলো যেখানে প্রাথমিক চাহিদাগুলি থাকে একেবারে নিচের স্তরে এবং সবার উপরে থাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা। যে কোনও মানুষ তাঁর প্রাথমিক চাহিদাগুলি পূরণ করার পাশাপাশি সর্বদাই উচ্চতর চাহিদাগুলি পূরণের চেষ্টা করতে থাকে। আব্রাহাম মাসলো মনে করেন এই চাহিদা পিরামিডের প্রথম চারটি স্তর হল মানুষের ন্যূনতম চাহিদা, এগুলি পূরণ না হলে অন্য উচ্চতর চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ অন্তর থেকে প্রেষণা অনুভব করেন না। জৈবিক চাহিদাগুলি মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলি পূরণ না হলে মানুষ কখনই আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা সম্পর্কিত তাগিদ অনুভব করেন না। আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদার তত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে মাসলো বলেছেন যে, প্রতিটি মানুষই তাঁর মধ্যে থাকা বিশেষ ক্ষমতা ও দক্ষতার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে চান। ফলে এই তাগিদ তাঁর সমগ্র জীবন ধরেই তাঁকে সক্রিয় রাখে। মানুষ চায় তাঁর সকল জৈবিক চাহিদা পূরণ হওয়ার পরে পৃথিবীর অন্য মানুষের মনে সে যাতে চিরস্থায়ী আসন লাভ করতে পারে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে। মাসলো এই পিরামিডে বর্ণিত চাহিদাগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন –

ক) অভাবমূলক চাহিদা (Deficiency Needs)

খ) বৃদ্ধিমূলক চাহিদা (Growth Needs)

শারীরবৃত্তীয় চাহিদা, সামাজিক, নিরাপত্তা ও সম্মানের চাহিদা অভাবমূলক চাহিদার অন্তর্গত। অভাববোধ থেকেই এই চাহিদাগুলির জন্ম। অন্যদিকে মাসলো পিরামিডের একেবারে সর্বোচ্চ স্তরটি বৃদ্ধিমূলক চাহিদা যা কিনা অভাববোধের বদলে ব্যক্তির বেড়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে আসে। আব্রাহাম মাসলো নিজে তাঁর এই তত্ত্বকে ‘ইতিবাচক মনোবিজ্ঞান’ (Positive Psychology) বলে চিহ্নিত করেছেন কারণ তা মানুষের মনের ইতিবাচক দিকগুলিকেই অধ্যয়ন করে। যদিও অনেকে মাসলোর এই তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছেন কারণ মানুষের জীবনে সর্বদা চাহিদাগুলি এই পিরামিডের মত সজ্জিত থাকে না, কখনও কখনও কোনও চাহিদা বেশি গুরুত্ব পায়, কোনওটা আবার কম গুরুত্ব পায়। এমনকি বহু সমালোচক এও মনে করেছেন যে, মৌলিক চাহিদাগুলি অপূর্ব থাকলেও আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং আত্মমর্যাদার স্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

১৯৭০ সালের ৮ জুন ৬২ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কের বাড়িতে গুরুতর হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে আব্রাহাম মাসলোর মৃত্যু হয়।  

2 comments

আপনার মতামত জানান