অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় (Ajay Kumar Mukhopadhyay)একজন বিখ্যাত বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ ও ষষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
১৯০১ সালের ১৫ এপ্রিল অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকে অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় এর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম শরৎ মুখোপাধ্যায়, তিনি ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী। মেদিনীপুরে জন্ম হলেও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল হুগলীতে। আইন ব্যবসার কারণেই শরৎ মুখোপাধ্যায় তমলুকে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি তমলুকের বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হয়েছিলেন। অজয় কুমারের ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজীবন।আরেক ভাই সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। অজয় কুমারের স্ত্রী গীতাও ছিলেন কমিউনিস্ট।
অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় যৌবনে স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্বে অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে তমলুক। সেই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়াকালীন গান্ধীজীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশকে ব্রিটিশ মুক্ত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন অজয়। ১৯৪২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ দল নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। এই স্বাধীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন অজয়। সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে সেই দায়িত্ব গ্রহণে এগিয়ে আসেন তিনি। এর জন্য পুলিশ তাঁকেও কারারুদ্ধ করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ উপনির্বাচন। এই নির্বাচনে অজয় তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনে জয়লাভ করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়। অজয় সেচ ও জলপথ বিভাগের মন্ত্রী রূপে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি গ্রাম-বাংলার অনেক জলাভূমি সংস্কার করেছিলেন। এর ফলে সেচব্যবস্থার প্রভূত পরিবর্তন হয়েছিল ও সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ বিশেষত তাঁর জন্মভূমি মেদিনীপুর জেলা কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। অজয় কুমারেরর প্রচেষ্টায় ১৯৬২ সালে তমলুকে ১২৫ শয্যা বিশিষ্ট মহকুমা হাসপাতাল তৈরি হয়। এই হাসপাতাল তৈরিতে তখনকার দিনে ১২ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল।
বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর প্রফুল্লচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। এই মন্ত্রীসভাতেও অজয় কুমার সেচ ও জলপথ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই সময় সরকারের অন্দরমহলে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে। দুর্নীতি সহ আরো অনেক কারণে কংগ্রেস সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। দলের হারিয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে মাদ্রাজের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কামরাজ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনায় স্থির হয় কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতে মন্ত্রীসভার সদস্য কমানো হবে এবং নেতাদের দলের সংগঠন তৈরির কাজ করতে হবে।
মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন অজয়। দলের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য গ্রামে-শহরতলিতে ঘুরে ঘুরে জনসভা করতে থাকেন তিনি। কিন্তু দলে প্রবল হয়ে ওঠে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তার চাপে অজয়কে কংগ্রেসের জেলা ও রাজ্য সভাপতির পদ থেকে অপসারিত করা হয়। এরপর ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার শ্যামস্কোয়ারে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে জন্ম নেয় ‘বাংলা কংগ্রেস’ নামের এক নতুন দল। এই দলের সদস্যপদ গ্রহণ করে অজয় কংগ্রেসের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।
১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বাংলা কংগ্রেস সহ চারটি দল একত্রে ‘পিপলস ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট’ গঠন করে। এই নির্বাচনে জয়লাভ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। গঠিত হল পশ্চিমবঙ্গের প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু এই সরকার স্থায়ী হল না। এরপর অন্তর্বর্তী নির্বাচনেও জয়লাভ করে মুখ্যমন্ত্রী হন অজয়। এই সময় রাজ্যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নকশালবাড়ি আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগে ১৯৬৯ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন পার্কে বাংলা কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে অনশন সত্যাগ্রহে বসেন অজয়। নিজমুখে নিজের সরকারকে আখ্যা দেন ‘অসভ্যের সরকার’। স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেন, “আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হলে ছেঁড়া জুতোর মতো মন্ত্রীত্ব ছেড়ে চলে যাব, তবুও আদর্শভ্রষ্ট হব না।” পদত্যাগ করেন অজয়। বেতার ভাষণে জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, “এই অবস্থায় গদি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করা মানে জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।”
১৯৭১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃতীয়বার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন অজয়। কিন্তু মাত্র ৮৩ দিনে এই সরকারের পতন হয়। পুনরায় তিনি কংগ্রেসে ফিরে এসে ১৯৭২ সালে তমলুক থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন। এই সময় থেকেই তিনি আস্তে আস্তে রাজনৈতিক জগত থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ১৯৭৭ সালে সতীশ সামন্ত লোকসভা নির্বাচনে সুশীলকুমার ধাড়ার কাছে পরাজিত হলে পুরোপুরিভাবে রাজনীতি থেকে সরে আসেন অজয়। জন্মভূমি তমলুক ত্যাগ করে কলকাতায় গিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন তিনি।
সারাজীবন অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে কাটিয়েছেন অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। জনগণের মঙ্গলই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। অকৃতদার ছিলেন, নিরামিষ খেতেন আজীবন। গান্ধীবাদী হওয়ার জন্য খদ্দরের পোশাক পড়তেন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আদর্শের জন্য লড়াই করেছিলেন তিনি। তার জন্য কখনো কখনো চরম মূল্য দিতে হলেও তিনি একবারের জন্যও আদর্শভ্রষ্ট হননি।
১৯৭৭ সালে ভারত সরকার অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়কে ‘পদ্ম বিভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৮৬ সালের ২৭মে ৮৫ বছর বয়সে কলকাতায় অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।
2 comments