আলফ্রেডো ডি স্টেফানো

আলফ্রেডো ডি স্টেফানো

বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের খোঁজ মিলবে যাঁদের অসামান্য দক্ষতা, কৌশল এবং কৃতিত্বকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয় আজও। তেমনই একজন ফুটবলার ছিলেন আর্জেন্টিনার আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (Alfredo Di Stéfano)। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় হলেও তিনি কেরিয়ারের অধিকাংশ ম্যাচ স্পেনের হয়ে খেলেছেন। বর্তমানে তিনি স্পেনের ফুটবল ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ গোলদাতা। সমগ্র কেরিয়ারে তিনি দুই বার ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জিতেছেন। বিভিন্ন ক্লাবের কোচ হিসেবেও সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কোন কোন ফুটবল বিশেষজ্ঞ তাঁকে ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে সম্পূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

১৯২৬ সালের ৪ জুলাই আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের পার্শ্ববর্তী বারাকাসে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নামও ছিল আলফ্রেডো ডি স্টেফানো ছিলেন ইতালীয় আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত। স্টেফানোর মায়ের নাম ইউলালিয়া লৌলহে গিলমন্ট ।

পরিবারেই ফুটবল খেলার একটি পরিবেশ পেয়েছিলেন স্টেফানো। তাঁর বাবা রিভার প্লেট ক্লাবের একজন প্রাক্তন ডিফেন্ডার ছিলেন। হাঁটুতে গুরুতর আঘাত পাওয়ার কারণে ১৯১২ সালে অকালেই অবসর নিতে হয়েছিল তাঁকে। মূলত বাবাকে দেখেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন স্টেফানো। পাড়া ফুটবলের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় ফুটবল ক্লাব যেমন, বারাকাস, ইউনিডোস ওয়াই ভেনসেরেমোস এবং ফ্লোরেস জেলার ইমানে ফুটবল খেলে বড় হয়েছেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো । অনেকেই তাঁর ফুটবল প্রতিভাটি লক্ষ্য করেছিলেন। 

বই  প্রকাশ করতে বা কিনতে এই ছবিতে ক্লিক করুন।

১৯৪৪ সালে স্টেফানোর বাবা রিভার প্লেট ক্লাবকে ছেলের জন্য সুপারিশ করে একটি চিঠি লেখেন। ক্লাবের তরফ থেকেও যুবদলের সঙ্গে স্টেফানোর অডিশনের আমন্ত্রণ জানিয়ে পাল্টা একটি টেলিগ্রাম করা হয়। অডিশনে ডি স্টেফানো মুগ্ধ করেন ক্লাব কর্তৃপক্ষকে এবং রিভার প্লেটের দ্বিতীয় টিমে নিজের নাম নিশ্চিত করে নেন। পরের বছরই রিভার প্লেটের প্রথম দল লা মাকুইনার প্রধান তারকা ফুটবলার মোরেনো স্পেনের ক্লাবে খেলার সুযোগ পাওয়ায় তাঁর জায়গায় খেলার সুযোগ চলে আসে স্টেফানোর কাছে। ১৯৪৫ সালে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়নশিপের দ্বাদশতম দিনে হুরাকানের বিপক্ষে উনিশ বছর বয়সে প্রথম দলের হয়ে খেলতে নামেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো । শেষ পর্যন্ত রিভার প্লেট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে এবং এটাই ছিল স্টেফানোর জীবনের প্রথম শিরোপা।

হুরাকানের বিপক্ষে স্টেফানোর অসামান্য খেলা দেখে হুরাকানের সভাপতি প্রস্তাবে তাঁকে হুরাকানে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলে স্টেফানো রাজি হয়ে যান সেই প্রস্তাবে। হুরাকানের হয়ে ২৫টি খেলায় ১০টি গোল করেন তিনি। হুরাকান থেকে  সপুনরায় রিভার প্লেটে ফিরে আসেন স্টেফানো। ফিরে আসার পর রিভার প্লেট দলের লা মাকুইনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন স্টেফানো। কোচের সিদ্ধান্ত এবং নিজের দক্ষতায় স্টেফানো সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতে শুরু করেন৷ ১৯৪৭ সালের আর্জেন্টাইন প্রাইমার ডিভিশন কাপ জয়ে স্টেফানোর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২৭টি গোল করে সেই লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন তিনি। 

১৯৪৭ সালে রিভার প্লেট কোপা আলদাও কাপ জয় করে। এটি স্টেফানোর প্রথম আন্তর্জাতিক ক্লাব ট্রফি জয়। উল্লেখ্য যে সেই বছরেই কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে স্টেফানোর প্রথম আন্তর্জাতিক আত্মপ্রকাশ হয়।

১৯৪৮ সালে আর্জেন্টাইন চ্যাম্পিয়নশিপের সময়, পেডেরনেরা এবং ডি স্টেফানোর নেতৃত্বে পেশাদার ফুটবলার তকমা পাওয়ার দাবিতে ফুটবলাররা ধর্মঘট ডাকে। ফলে ফেডারেশন টুর্নামেন্ট স্থগিত করে দেয়। তাঁদের ধর্মঘটেও কর্তৃপক্ষ সাড়া না দিলে আর্জেন্টিনার সেরা ফুটবলাররা জাতীয় দল ছেড়ে বেশিরভাগ কলম্বিয়ার হয়ে খেলতে চলে যায়। ১৯৪৯ সালের ৩১ জুলাই আর্জেন্টিনায় তাঁর শেষ খেলাগুলির মধ্যে একটি ম্যাচে গোলরক্ষকও হয়েছিলেন স্টেফানো।

পেডেরনেরার সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টেফানো কলম্বিয়ার মিলোনারিওস দলে যোগ দিতে সম্মত হন। সেবছর ৯ আগস্ট তিনি তাঁর সতীর্থ নেস্টর রসির সঙ্গে গোপনে কলম্বিয়া চলে যান। ডি স্টেফানো মিলোনারিওসের হয়ে ২৯২টি খেলায় মোট ২৬৭টি গোল করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে ক্যাম্পিওনাটো প্রফেশনাল লীগে ১৪টি খেলায় ১৬টি গোল করে লীগ চ্যাম্পিয়ন করেন তাঁর দলকে। ১৯৫১ এবং ১৯৫৩ সালে আরও দুইবার এই খেতাব স্টেফানো এনে দেন তাঁর দলকে এবং এরপর সালেও জিতেছিলেন এই কাপ। কলম্বিয়ান লীগ জয়ের বছরগুলিতে সর্বোচ্চ স্কোরার হয়েছিলেন তিনি।

১৯৫২ সালের মার্চ মাসে, রিয়াল মাদ্রিদ একটি প্রীতি টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে কলম্বিয়াকে আমন্ত্রণ জানায় তাঁরা। স্টেফানোর ক্লাব মিলোনারিওস এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে এবং এটি জিতে নেয়। এরপর মিলোনারিওস ডি স্টেফানোর নেতৃত্বে হাঙ্গেরি এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে পরাজিত করে । মিলোনারিওস কলম্বিয়াতে ফিরে আসার পরপরই, বার্সেলোনার পরিচালকরা বুয়েনস আইরেসে যান এবং রিভার প্লেটের সাথে স্টেফানোর সঙ্গে চুক্তি করা নিয়ে কথা বলেন। মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনার মধ্যে স্টেফানোকে কেন্দ্র করে একরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শুরু যায়। ১৯৫২ সালের বড়দিনে মিলোনারিওসের সাথে চুক্তিবদ্ধ স্টেফানো ঠিক করেন ফুটবল ছেড়ে ব্যবসা করবেন। 

বার্সেলোনার সঙ্গে অনেক টানাপোড়েনের পর অবশেষে চার বছরের চুক্তিতে স্টেফানো রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন ১৯৫৩ সালে। ২৭ বছর বয়সী স্টেফানো ১৯৫৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মাদ্রিদে আসেন এবং ঠিক পাঁচদিন পরে সাদা জার্সিতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। ২৫ অক্টোবর স্টেফানো তাঁর প্রথম ক্লাসিকো খেলেন বার্সেলোনার বিপক্ষে। রিয়াল দুই দশক পরে ১৯৫৪ সালে স্টেফানোর কৃতিত্বে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে। ১৯৫৩-৫৪ মরসুমে লা লীগার সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সালে রিয়াল মাদ্রিদ প্রথমবার ল্যাটিন কাপ জেতে।

টানা দুইবার স্প্যানিশ কাপে জয়ের ফলে মাদ্রিদ ১৯৫৫-৫৬ মরসুমে ইউরোপীয়ান কাপের প্রথম স্প্যানিশ প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। সার্ভেটের বিপক্ষে ইউরোপীয়ান কাপে স্টেফানো প্রথম তাঁর অভিষেক ম্যাচ খেলেন। লীগে ২৪টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হন তিনি। ১৯৫৬ সালে তাঁরা রেইমসকে ৪-৩ ব্যবধানে পরাজিত করে ইউরোপীয়ান কাপ জয় করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে স্পেনের নাগরিকত্ব পান ডি স্টেফানো।

১৯৫৭ সালে স্টেফানো ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জেতেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে লা লীগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে এই পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি৷ ১৯৫৮-৫৯ সালের লা লীগাতে পঞ্চম এবং শেষবারের মতো লীগের সর্বোচ্চ স্কোরার হন তিনি। মূলত তাঁর একার কৃতিত্বেই টানা চারবার ইউরোপীয়ান কাপ জেতে রিয়াল মাদ্রিদ। ১৯৫৯ সালে পুনরায় দ্বিতীয়বার ব্যালন ডি’অর খেতাবে সম্মানীত করা হয় তাঁকে।

১৯৬৩-৬৪ সালের মরসুম ছিল রিয়াল মাদ্রিদে স্টেফানোর শেষ মরসুম। ২০ আগস্ট প্রথম ম্যাচ খেলার পর ২৪ আগস্ট স্টেফানোকে ভেনিজুয়েলার ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মড ফোর্সেস পোটোম্যাক হোটেলে অপহরণ করে এবং তিনদিন পরে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়। মূলত স্টেফানোর অনুপস্থিতির কারণেই সেবার মাদ্রিদ ট্রফি  জিততে পারেনি। মোট এগারো বছর মাদ্রিদে খেলেছিলেন স্টেফানো। টানা পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস কাপের প্রতিটির ফাইনালে গোল করেছিলেন তিনি। তিনি ৫১০টি খেলায় ৪১৮টি গোল করেন, যার মধ্যে ৩৯৬টি অফিসিয়াল ম্যাচে ৩০৮টি গোল করেন স্টেফানো। ১৯৬৪ সালে মাদ্রিদ ছেড়ে এস্পানিওলে চলে যান স্টেফানো। এস্পানিওলের সাথে ৬০টি ম্যাচে ১৪টি গোল করার পর, তিনি ১৯৬৬ সালে ৪০ বছর বয়সে একজন খেলোয়াড় হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।

ক্লাব ফুটবল ছাড়াও আন্তর্জাতিক ফুটবলেও স্টেফানোর অবদান অনস্বীকার্য। আর্জেন্টিনার হয়ে মোট ৬টি ম্যাচে ৬টি এবং স্পেনের হয়ে ৩১টি খেলায় মোট ২৩টি গোল করেন তিনি। তবে কোনো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয়নি স্টেফানোর। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপের সময় বলিভিয়ার বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করেন স্টেফানো। সেই টুর্নামেন্টেই কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন তিনি। ১৯৫১ সালে কলম্বিয়ান পাসপোর্ট ছাড়াই কলম্বিয়া একাদশের হয়ে চারটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। সেকারণে ফিফা ১৯৫৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনার হয়ে স্টেফানোর অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে স্পেনের হয়ে অভিষেক করেন স্টেফানো। ১৯৬২ সালে স্পেনকে বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করেও পেশির আঘাতের কারণে খেলতে পারেননি তিনি। ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপের পর তিনি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে অবসরের পর স্টেফানো বিভিন্ন দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রথমত ১৯৬৭-৬৮ সালে এলচে ক্লাবের কোচ হয়েছিলেন তিনি। এরপর আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়রার্সকে ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ, লা লীগা ইত্যাদি শিরোপা জয়ে একজন কোচ হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর ফিরে আসেন ভ্যালেন্সিয়ার কোচ হিসেবে। ১৯৭৪-৭৫-এর মৌসুমে স্পোর্টিং ক্লাবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন৷ ১৯৮২-৮৪ এবং ১৯৯০-৯১-এর মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন স্টেফানো। এছাড়াও ১৯৭৬-৭৭-এ কাস্তেলোন, ১৯৭৯-৮০-তে ভ্যালেন্সিয়া, ১৯৮১-৮২-এর মৌসুমে রিভার প্লেটের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৫ সালে পুনরায় বোকা জুনিয়রার্স এবং ১৯৮৬-৮৮ সালে তৃতীয়বার ভ্যালেন্সিয়ার কোচ হয়েছিলেন তিনি। 

২০১৪ সালের ৫ জুলাই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার পর স্টেফানোকে মাদ্রিদের গ্রিগোরিও মারানন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে এই কিংবদন্তি ফুটবলার আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর মৃত্যু হয়েছিল।

আপনার মতামত জানান